করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। অচলাবস্থা চলছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কবে নাগাদ এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে, তা জানে না কেউ। এ সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ইউনেস্কোর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টি দেশের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন (৯০ শতাংশ) শিক্ষার্থী এখন গৃহবন্দি। ফলে সশরীরে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষা অর্জনের পথ রুদ্ধ। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় 'সংসদ টেলিভিশনে' ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি কার্যক্রম প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। পরীক্ষামূলকভাবে একটি শ্রেণির কার্যক্রম প্রচার করা হয়। পরে প্রতিদিন সাতটি প্রতি সপ্তাহে ৩৫টি ক্লাস প্রচার করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বাসায় বসেই নিজ নিজ বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠলাভ করতে পারছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ছিল নিয়মিত ক্লাস। প্রত্যেকে বাসায় নিরাপদে থেকে স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারের সাহায্যে অনলাইন ক্লাসে জয়েন করেছে। এর আগে কয়েকটি ডেমো ক্লাস নেওয়া হয়। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত হচ্ছে গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিটস। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রয়েছে আলাদা মেইল। সেই মেইল দিয়ে গুগল ক্লাসরুমে লগইন করে অংশ নিচ্ছে অনলাইন ক্লাসে। কখনও ফেসবুক লাইভ কিংবা জুম ব্যবহার করে শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিচ্ছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এই আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) বা সমমানের পরীক্ষা হয়নি। পরীক্ষার্থীর ফলাফল কী হবে, সেটি ঠিক হবে তার জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। ভারত প্রশাসিত কাশ্মীরে উন্মুক্ত স্থানে পাঠদান এরই মধ্যে একটি সমাধান হিসেবে চালু হয়ে গেছে। হিমালয়ের বরফ ঢাকা পাহাড়ি পরিবেশে খোলা জায়গায় স্কুলে শিশুরা লেখাপড়া করছে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে। ফিনল্যান্ডে জঙ্গলে স্কুল বেশ জনপ্রিয়। দেশটিতে বন-জঙ্গলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে লেখাপড়া শেখার সংস্কৃতি বহুদিনের।
ডেনমার্কেও উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ দিনে ক্লাস করার প্রথা চালু রয়েছে। বহু শিক্ষক এবং স্কুল নিয়মিতভাবে এই বিশেষ দিনে বাইরে স্কুল শিক্ষার আয়োজন করেন। ডেনমার্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কভিড-১৯-এর মধ্যে এই সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৩০টি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটি আরও বাড়তে পারে। যার ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। এদিকে এই অচল অবস্থা বিরাজ করছে মাসের পর মাস পৃথিবীব্যাপী। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিতে পারছে না। আর শিক্ষক পারছে না শিক্ষা প্রদান করতে। জীবন তো আর থামিয়ে রাখা যায় না। ঠিক সেভাবেই শিক্ষা কার্যক্রমও থেমে থাকা উচিত নয়। যেহেতু সবাই বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে সেক্ষেত্রে বাড়িতে বসেও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশেও স্বল্প ব্যাপ্তিতে অনলাইনে শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি চলছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'জুম অ্যাপ্লিকেশন' ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিডিরেন (বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক) সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করবে। এই প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ক্লাস লেকচারের পাশাপাশি ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে এবং নিজের মতামতও প্রকাশ করতে পারছে। বাংলাদেশে ই-লার্নিংয়ের চর্চা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয়নি এখনও। বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সংশ্নিষ্ট বোদ্ধাগণ ই-লার্নিয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। যার বেশির ভাগই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও এ ধরনের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে প্রায় সব ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লেখাপড়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে। তাই তাদের পক্ষে ই-লার্নিংয়ের ব্যবস্থা করা কঠিন নয়। অনেক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জুম অ্যাপ্লিকেশন, মাইক্রোসফট, গুগল ক্লাসরুম ব্যবহার করে অনলাইনে পাঠদান করছে।
আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের সুবিধা নেই, তারা সহজেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে দিতে পারে।
বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। ফলে তাদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূরে গিয়ে হাজার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে লেখাপড়া করতে হবে না।
চীনের উহানে যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে লকডাউন পরিস্থতি বিরাজ করছিল, তখন উহানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বাড়িতেই ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষকের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেরেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে চীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। চীনের ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচ হাজারেরও বেশি কোর্স অনলাইনভিত্তিক করে ফেলতে সক্ষম হয়।
ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সব শিক্ষার্থীকে এই ই-লার্নিং পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই সুযোগ লাভ করে, এমনকি কিছু কোর্স বিশ্বব্যাপী সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি কোর্স হাবের ব্যবস্থা করে, যা পাঁচ লাখ সত্তর হাজার মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি Ding Talk ZJU নামক একটি অ্যাপ তৈরি করে, যা প্রায় তিন লাখ মানুষকে আকৃষ্ট করে। সমস্যা তবুও থেকেই যায়, কারণ অনেক শিক্ষকই প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ নয়। আর তাই ZJUফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে তিন হাজার ৬৭০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। শুধু তাই নয়, প্রায় এক হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীকে এই ডিসট্যান্স এডুকেশনের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কম খরচে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টরনেট সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সঙ্গে শিক্ষার্থীরা পেল্গব্যাক এবং কোর্সওয়্যার প্যাকেজ পাচ্ছে; যার মাধ্যমে কোনো লেকচার ফলো না করতে পারলেও পরে সহযোগিতা পেতে পারে। ZJU তাদের অনলাইন শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল স্মার্ট ক্যাম্পাস তৈরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে তাদের অনলাইনে পাঠদানের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়।

বিষয় : বদলে যাওয়া শিক্ষাক্ষেত্র

মন্তব্য করুন