- বিশেষ আয়োজন
- স্বাস্থ্য ও অর্থব্যবস্থার সংকট উত্তরণের পথ
জীবন চাকা ঘুরছে
স্বাস্থ্য ও অর্থব্যবস্থার সংকট উত্তরণের পথ

বছরের প্রথম দিকে করোনার আবির্ভাবে লোকজন হকচকিয়ে যায়। কারণ রোগটি অচেনা, অপরিচিত। সতর্কতা মানতে গিয়ে অনেক মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। অফিস-ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় চলাচল নিম্নতম পর্যায়ে নেমে যায়। দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতায়, বন্ধুত্বের চর্চায় বিঘ্ন ঘটে, আত্মীয়তা ঝিমিয়ে পড়ে, পরিচিতজনরাও যেন অচেনা হয়ে ওঠে। কেউ কারও বাসায় যায় না। অফিস খোলার পরেও সবাই যেন লুকিয়ে থাকে। দোকানপাট খুলল, কিন্তু ক্রেতার অভাব। ব্যাংক খুলল, কিন্তু ঢুকতে হবে একজন করে। বড় বড় শপিংমল খুলেছে- কিন্তু একসঙ্গে প্রবেশ করবে কোথাও পাঁচজন, কোথাও দশজন।
করোনা মানুষের চেহারাও পাল্টে দিয়েছে। মাস্ক দিয়ে নাক-মুখ ঢাকা। অনেকে মাথার চুল ঢেকেছে। কেউ আবার ফেসশিল্ড পরেছে। দেখে চেনার উপায় নেই। মাস্কের ওপর নামটা লিখে দিলে চিনতে সুবিধা হতো। পরস্পরের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারও মতে তিন ফুট। কারও মতে ছয় ফুট। নিয়মাচার মানতে মানতে কখন যে আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, পেছন ফিরে না তাকালে বোঝার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশের করোনার একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা উল্লেখ না করলে করোনার প্রতি অবিচার করা হবে। বৈশিষ্ট্যটা একটা কৌতুকের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করছি।
আমরা সবাই জানি, করোনা সারাবিশ্বে ছড়িয়েছে চীনের উহান প্রদেশ থেকে। আমরা এও জানি যে, একই জিনিস বিভিন্ন মানে তৈরি এবং বিভিন্ন মূল্যে বিক্রির দক্ষতা চীনাদের মধ্যেই দেখা যায়। যে দেশ বেশি দামে কিনতে চায়, তারা ভালোমানের পণ্য পাবে। আবার একই রকম দেখতে কম দামে পাবে, যারা সস্তায় চায়। করোনা বিতরণেও চীন একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। সর্বোচ্চ শ্রেণির করোনা প্রেরিত হয়েছিল আমেরিকায়। দ্বিতীয় শ্রেণিরটা পাঠানো হয় ইউরোপসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে। আর নিস্তেজ শ্রেণির করোনা এসেছিল বাংলাদেশে বন্ধুত্বের নির্দশনা হিসেবে। তাই কোনো কোনো উন্নত দেশে মৃতের হার ১২% ছাড়িয়েছে। মধ্যম দেশগুলেতে করোনার মৃত্যুহার ৮ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। আর বাংলাদেশে মৃত্যুহার দেড় শতাংশেরও কম। সারা পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যুহারের গড় হলো ৫%-এর একটু বেশি। চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের নিগূঢ় রহস্যের প্রকাশ করোনার মৃত্যুহারে। ফলে বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্ব আরও দৃঢ়তর হয়েছে কিনা বলতে পারব না, স্বল্প মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি প্রদর্শনা করার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্যবিদরা যতই মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন, জনগণ ততই তা উপেক্ষা করতে পছন্দ করছে। কেউ বলছেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আবার কেউ বলছেন, নিঃশ্বাসে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড আবার প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে ক্ষতি করছে। হ্যান্ড গ্লোভস ক্ষুদ্র মহলে প্রচলন শুরু হয়েছিল। এখন প্রায় বন্ধ।
করোনায় মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা সেরে উঠলেও স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে খাবারে পুষ্টিমান বজায় রাখা সবার সাধ্যে কুলায় না। স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যাপকতর হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। সে জন্যই স্বাস্থ্য এবং অর্থব্যবস্থা একসঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছি।
স্মরণ করা যাক করোনার শুরুর দিনগুলোর কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল। কারণ রোগটি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা দূরের কথা, কোনো ধারণাই ছিল না আমাদের। এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি হলো। রোগীর কাছে গেলেই রোগ হবে। ভাবখানা এমন যে, রোগীর দিকে তাকালেই বুঝি রোগ হয়ে যাবে! শুরু হলো বিচ্ছিন্নতা। অফিস-আদালত, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ। গার্মেন্টসহ বড় শিল্প বন্ধ। হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকা ছাড়ছে। অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারী বেকার। মধ্যপর্যায়ের অনেকে ছাঁটাইয়ের শিকার। ঢাকায় 'টু লেট' নোটিশে ভরে গেল। সবাই গ্রামমুখী। এই পরিস্থিতির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা যাক।
যারা দিন আনে, দিন খায়, তারা উপোস। সরকার তাদের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রোগ্রাম হাতে নিল। প্রথমদিকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয় অনহারির কাছে। কাজটি সুকঠিন। কিছুটা সহজ হলো এ কারণে যে, নিম্ন আয়ের সবাই না-খাওয়া। শিগগিরই প্রকাশ পেল, শুধু দরিদ্ররাই নয়, নিম্ন মধ্যবিত্তরাও অনেকে উপোস। রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি এসে খাবার সংগ্রহ করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাজেটের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে- ব্যয়ের পথে কিছু টাকা লুট হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। হয়তো হবে। অর্থব্যবস্থার অদক্ষতায় লুট হয়ে থাকে। তবে আমাদের কাছে ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রশ্ন অধিক গুরুত্ব বহন করেছিল। তাই ব্যয়-অপব্যয়সহ ক্ষুধানিবৃত্তির কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছিল।
করোনার ক্ষতি হিসাবায়ন এখনও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব মতে, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯% হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হারও ১০% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ অঙ্ক ছাড়িয়েছে। এই তথ্যটুকু থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বড় একটা দিক উন্মোচিত হবে। এই শতাব্দীর প্রথমে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমবেশি ৪০% ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টার ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখে। ফলে ক্রমাগত উন্নতি হতে হতে ২০%-এ নেমে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও কমিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্যহারের নিচে নামানোর সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। উল্লেখ্য, মার্কিন মুলুকের মতো ঐশ্বর্যশালী দেশের দারিদ্র্যহার তখন ১৬% ছিল। কিন্তু করোনার আক্রমণে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
দারিদ্র্যহার বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ সরকার অনুসৃত ভুল অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতি নিয়ে সমস্যা নেই। বাজার অর্থনীতির ব্যষ্টির মধ্যে কয়েক প্রকার ভিন্ন অর্থনীতি রয়েছে। বাজার অর্থনীতিকে একটি সরলরেখা (পড়হঃরহঁরঃু) কল্পনা করলে, সর্বডানে রয়েছে 'পুঁজিবাদী অর্থনীতি,' মাঝে রয়েছে 'কল্যাণ অর্থনীতি' এবং সর্ববামে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি'। শেষোক্তটি আবার দুই প্রকার- কম্যুনিষ্ট অর্থনীতি এবং অকম্যুনিস্ট সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি'। এ সবই কমবেশি বাজার অর্থনীতিতে চলমান। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য 'কল্যাণ অর্থনীতি' অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে এই নীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, 'মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না, আয়-বৈষম্য থাকবে না।' এখানে থাকবে না বলতে সর্বনিল্ফেম্ন থাকবে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার একদিকে মুজিববর্ষ পালন করছে, অন্যদিকে মুজিবের অর্থনীতির একদম উল্টোদিকে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশে এখন মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য চরম পর্যায়ে রয়েছে। জিনি সহগ বেড়ে এখন প্রায় দশমিক পাঁচ। অন্যদিকে পালমা অনুপাতেও পালমা অনুপাত এখন বিপর্যয়কর তিন। ফলে অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ এখন চরম আয় বৈষম্যের দেশ। সরকার শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি তো জনসংখ্যার বড়জোর দশভাগের মধ্যে সীমিত। নব্বই ভাগ মানুষ আয় বৈষম্যের শিকার, যা বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি এবং দেশের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ।
বৈষম্যের বিষয় অন্যদিন আলোচনা হবে। আজ বৈষম্যের ফলাফল নিয়ে কথা বলব। গত দুই যুগের ক্রমাগত তীব্র আয়-বৈষম্যের ফলে শকতরা দশ ভাগ লোক অতি ধনী, আরও দশ ভাগ ধনী হয়েছে। তারপরের কুড়ি ভাগকে বলা যায় মধ্যবিত্ত। বাকি ষাট ভাগের মধ্যে চল্লিশ ভাগ সরাসরি দরিদ্র এবং বাকি ২০ ভাগ তথাকথিত নিম্নবিত্ত। করোনার ফলে পরিসংখ্যানে বাস্তব চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। ৪০% মানুষ সম্বলহীন আর বিশভাগ মানুষ স্বল্পবিত্ত। অর্থাৎ দেশের ৬০% বিত্ত সংকটে।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী? আমরা ধরে নিচ্ছি করোনা আর বেশি জ্বালাবে না। পুনরাবৃত্তি হলে করণীয়ও ভিন্ন। যে ক্ষতি হয়েছে, সেটুকু পূরণ করার উপায় নিয়ে কথা বলব। বিত্ত হারাতে যত সময় লাগে, বিত্ত গড়তে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন। ইংরেজিতে বলে, ঝষড়ি নঁঃ ংঃবধফু রিহং :যব ৎধপব। শ্নথ হলেও লেগে থাকলে জেতা যায়। প্রথমেই দেশের বাজেটের দিকে তাকাতে হবে। করোনার নামে ব্যয়-অপব্যয় যা হয়েছে, তা কীভাবে পূরণ হবে?
আমাদের বাজেটে সেফটি-নেট হিসাবে ২০% বিত্তহীনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। বর্তমান সরকার আসার পর থেকে এই প্রোগ্রামগুলোতে অর্থায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে. যদিও তা যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতিতে বিত্তহীনের সংখ্যা বেড়ে ৩৯% হলে সেফটি নেট প্রোগ্রামে অর্থ বরাদ্দ সরাসরি দ্বিগুণ করতে হবে। সেটা করতে গেলে অন্যান্য খাতে বরাদ্দ কমাতে হবে। খাত সমন্বয়ের এই কাজটা সহজ হবে না।
আরও কয়েকটি বাস্তব অবস্থার দিকে নজর দেওয়া যাক। অনেক মানুষ চাকরিচ্যুত বা কর্মচ্যুত হয়েছেন। তাদের পুনর্নিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গার্মেন্ট শিল্প মোটামুটি চলছে। কিন্তু অনেক বৃহৎ-মাঝারি শিল্প এখনও গতি পায়নি। ঢালাও ব্যবস্থা না নিয়ে এগুলোকে চিহ্নিত করে প্রতিটির সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। এ জন্য একটি টাস্কফোর্স কাজ করতে পারে। তবে স্বনিয়োজিতদের সমস্যা ভিন্ন। শুধু ঋণ দিলেই হবে না। এদের জন্য ভিন্ন একটি টাস্কফোর্স হতে পারে। যারা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে সমাধানের নির্দেশনা দেবেন এবং পরিপালনে সহায়তা করবেন। কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে কৃষিশিল্প ও হস্তশিল্পের জন্য সংযোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব এবং তহবিল প্রদান করা যেতে পারে।
সরকার বেশ কিছু ঋণ সুবিধা দিয়েছে। তবে ঋণ কিন্তু সর্বগ্রাসী নয়। ঋণের সঙ্গে অন্যবিধ সহযোগিতা ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন। এ জন্য বিভিন্ন সেক্টরের জন্য সংস্থা চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে লিঙ্কেজ সৃষ্টির ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সবশেষে মূল সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় আয়ের সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। এ জন্যেই বঙ্গবন্ধু 'আয় ও সম্পদের সমবণ্টনের' কথা বলেছিলেন। সংবিধানে লিখেও দিয়েছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নীতিমালা অবজ্ঞা করে 'বল্কগ্দাহীন পুঁজিবাদের' নীতি গ্রহণ ও চর্চা করছি। এ ব্যবস্থায় নিম্ন আয়ের ৪০% মানুষ 'রোজ-আনা রোজ-খাওয়া' পর্যায়ে থেকে যাবে। এক মাস চলার মতো সঞ্চয়ও তাদের থাকবে না। সেইসঙ্গে মোটা হতে থাকবে শীর্ষ দশ ভাগ মানুষ। সরকার কি নীতি পাল্টাতে পারবে? সরকার কি 'মোটাতাজা মানুষদের' কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? সরকার কি বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতিতে ফেরত যেতে পারবে? আজ শুধু প্রশ্ন রেখেই শেষ করছি।
লেখক
অর্থনীতিবিদ
প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন