- বিশেষ আয়োজন
- করোনায় সব বদলেছে; হিংসাবাদ রয়ে গেছে
করোনায় সব বদলেছে; হিংসাবাদ রয়ে গেছে

চীন দেশ পৃথিবীর সকল বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সভ্যতার শুরু থেকেই। কাগজসহ নানাবিধ সংযোজন চীন যুক্ত করেছে সভ্যতায়। সেই চীন দেশের উহান নামক একটি শহরের নাম শোনা হয়নি পৃথিবীর বেশির ভাগ জীবিত মানুষের। কারণ এই দেশটি নিজেদের বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মেলাতেই চায়নি এক সময়। পরে যখন আবার যুক্ত হতে শুরু করে তখন উহান শহরের চেয়ে সেখানে তৈরি হওয়া দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে যতটা আগ্রহ ছিল, এর উৎস নিয়ে ততটা আগ্রহ ছিল বলে প্রমাণ নেই। কিন্তু সেই উহানের একটি মাছবাজার রাতারাতি পৃথিবীময় পরিচিতি পেল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে। কারণ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতেই এই সামুদ্রিক মাছের বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং কর্তৃপক্ষ জানাল যে, এখান থেকে নতুন ধরনের একটি অণুজীব (ভাইরাস) মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে এবং তা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে। জানুয়ারিজুড়ে গণমাধ্যমেই কেবল এই ভাইরাস নিয়ে আলোচনা চলতে থাকল এবং আমরা সেখান থেকেই জানতে পারলাম যে, এই অণুজীবের নাম কভিড-১৯, এবং এর ডাকনাম 'করোনা'।
চীন সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায়শই উদ্ভট এবং প্রায় মনগড়া তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সে রকমই একটি খবর বিশ্বময় আলোড়ন তুলল যে, চীনের এই উহান সংলগ্ন এলাকার আকাশে সালফার বা অ্যামোনিয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, কারণ ভাইরাস-আক্রান্ত অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলায় আকাশের এই অবস্থা হয়েছে। যথারীতি নিজেকে বন্ধ করে রাখা চীন এই সংবাদের প্রতিবাদ করেছে, যেমনটি সব সময় করে থাকে, চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র। সংবাদমাধ্যমে চীনে এই ভাইরাসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নিয়ে ভয়াবহ সব সংবাদ ভাইরাল হতে শুরু করে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ই একজন চিকিৎসকের বরাত দিয়ে উহানের প্রতিটি বাড়িতে এই ভাইরাস কী করে ঢুকছে এবং আক্রান্তদের চীনা রাষ্ট্রযন্ত্র কী অমানবিকভাবে আলাদা করে ফেলছে এবং জীবিতদের কী মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হচ্ছে, তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হলেও সাধারণ মানুষ চীনের এসব ভূমিকায় খুব একটা বিস্মিত হয়নি। কারণ চীন তো সকলের কাছে সব সময় বিস্ময়। কিন্তু সেই বিস্ময়ের ঘোর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যখন ইউরোপেও হঠাৎই একজন করোনা রোগীর সন্ধান মিলল। সিঙ্গাপুরে কাজ করা সেই ভদ্রলোক ছুটিতে 'স্কিইং' করতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের আলপস পর্বতে। সেখান থেকেই এই ভাইরাস প্রথমে ইউরোপে প্রবেশের সুযোগ পেল এবং রাতারাতি ইউরোপকে আক্রান্ত করে ফেলল। তবু, তখনও আতঙ্ক তেমন ছড়ায়নি যতদিন না সেখানকার (পড়ূন ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি) হাসপাতাল আর বৃদ্ধাবাসগুলো ভরে উঠতে লাগল এই ভাইরাসজনিত রোগীদের দ্বারা।
শুরুতে বিশেষ করে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপ বিষয়টিকে চীনের দোষ এবং নিজস্ব নাগরিকদের কেবল সতর্ক করাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশনগুলো সংবাদ প্রচারে যেসব ছবির ব্যবহার করছিল তাতে সাধারণ মানুষের ভেতর উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। তখনই 'লকডাউন' বলে একটি শব্দ রাতারাতি প্রয়োগ হতে দ্যাখা গেল সর্বত্র। প্রথমে এলাকাভিত্তিক এবং তারপর গোটা শহর। এটা ফেব্রুয়ারির শেষের দিককার কথা। মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক, সাধারণ মানুষ গণপরিবহনে উঠে কী করবে বুঝতে পারে না, হাসপাতালগুলো তখনও কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে না। ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে আড়ে-ঠেরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল।
মার্চ এলো। ইংল্যান্ডে প্রথম দফাতেই প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩০-এ গিয়ে দাঁড়াল শুধু হাসপাতালগুলোতেই। এ সময় কেউ নজরই দেয়নি বৃদ্ধাবাসগুলোতে কী হচ্ছে তা নিয়ে। ইতালি এবং স্পেন থেকে আসা মৃতদের সংখ্যার খবর গণমাধ্যমও ধারণ করতে পারছিল না, কারণ এখনকার গণমাধ্যমকর্মীদের কারোরই এত সংখ্যায় মৃত্যুর খবর প্রকাশের অভিজ্ঞতা নেই। অভিজ্ঞতা নেই বড় কোনো বিপর্যয়ের খবর প্রকাশেরও। মহাযুদ্ধের পরে স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতি নিয়ে খবর প্রকাশ করতে করতে গণমাধ্যমের একটি নতুন ধারা দাঁড়িয়েছে। এর পরে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, ইসরায়েল যেখানে কেন্দ্রে থাকে এবং ফিলিস্তিন কিংবা সুদানের দারফুরের ক্ষুধাক্রান্ত শিশুর ছবি প্রকাশকেই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দায় ও দায়িত্ব ছিল বলে ধরা হয়। ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে যখন এত সংখ্যার মৃত্যু নিয়ে যুঝতে হলো তখন কাকে রেখে কার কথা লিখবে, কোন্ দেশকে প্রাধান্য দেবে, কোন্ সভ্যতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে; এ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ একটা ফাঁপরেই পড়তে হলো গণমাধ্যমকে। কিন্তু এর ফলে জনমানসে আতঙ্ক ছড়াল ভয়ংকরভাবে।
অনেকেরই এ কথা মনে থাকার কথা যে, ইউরোপের অন্যান্য দেশসহ যুক্তরাজ্যে 'লকডাউনের' ঘোষণা আসার আগেই বড় বড় সুপারমার্কেটে জিনিসপত্র রাখার তাক খালি হতে শুরু করল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সবার আগে খালি হলো এবং টান পড়ল 'টয়লেট পেপার'-এ। কেন আর সবকিছু রেখে টয়লেট পেপার নিয়ে এ রকম টানাটানি, আতঙ্ক এবং শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র, এটা নিয়ে গবেষণা হবে নিশ্চয়ই পরে। কিন্তু তখন সাধারণ মানুষকে লাইন দিয়ে, লাইন ভেঙে এবং কখনও কখনও দোকানে ঢুকে জোরপূর্বক টয়লেট পেপার সংগ্রহের প্রবণতা মানবমনের বিচিত্র আচরণের অন্যতম প্রমাণ হিসেবে করোনাজনিত মহামারির সূচনালগ্নে চিহ্নিত হয়ে থাকল। তখনও করোনার আক্রমণকে মহামারি হিসেবেই দেখা হচ্ছিল, মানে ইংরেজিতে যাকে 'এপিডেমিক' বলা হয়, কিন্তু এপ্রিলের পর থেকে এই শব্দটি বদলে গেল 'প্যানডেমিক'-এ, বাংলায় হলো 'অতিমারি'। শব্দের বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপন, জীবনাচরণ, জীবনবোধ এবং জীবনের বাস্তবতা এই এপ্রিলের শেষে এসেই তছনছ হয়ে নতুন ও ভিন্নরূপে এসে সামনে দাঁড়াল। মানুষ তার স্বভাবজাত প্রবণতা থেকে কেবল 'নিজে বাঁচলে বাপের নাম'-এর প্রমাণ দিয়ে দোকান থেকে গাড়িভর্তি করে জিনিসপত্র এনে বাড়িতে জমানো শুরু করল। বাধ্য হয়ে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ 'রেশন-ব্যবস্থা' চালু করল, ধনতন্ত্রে বসবাসকারীদের কাছে এ এক অপার বিস্ময়, এও হয়? হতে পারে? আপনার কাছে অর্থ আছে? আপনার সামর্থ্য আছে কিন্তু আপনি আপনার চাওয়া অনুযায়ী কিনতে পারবেন না? তাহলে আর 'চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে'-র সফলতা থাকল কোথায়? নানাবিধ তন্ত্র নিয়ে চিন্তকদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠাটা এই করোনাকালের অন্যতম অর্জন হিসেবে দেখছেন পণ্ডিতরা। খ্রিষ্টান ধর্মগুরু পোপ তো বলেই দিয়েছেন যে, ক্যাপিটালিজমের ব্যর্থতাকে করোনা নগ্নভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছে সভ্যতার সামনে। বক্তব্য হিসেবে এই বাক্য তুমুল, তীব্র এবং ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কার জন্মদানকারী, বিশেষ করে একেশ্বরবাদী ধর্মোৎসারিত এই ধনতন্ত্রের জন্য।
প্রথমেই দেশে দেশে সরকারগুলোর স্বাস্থ্য বিভাগের অকার্যকারিতা এবং নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের অবহেলাজনিত বাস্তবতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল মানুষের চোখের সামনে। এতদিন ধরে তবে কাকে মানুষ রাষ্ট্র মেনেছে? কাকে ভোট দিয়েছে? কারা প্রতিশ্রুতির জালে প্রলুব্ধ করে মানুষকে আসলে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়েছে- এসব প্রশ্ন মানুষের ভেতর ছায়া ফেলতে শুরু করল। কারণ, কী উন্নত কী অনুন্নত প্রতিটি দেশেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করল এই করোনা আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগাক্রান্ত মুমূর্ষু কিংবা চিকিৎসা-প্রয়োজন যে কোনো মানুষকে ইউরোপের হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। কারণ তাদের সেই সক্ষমতা ছিল না। এমনিতেই চিকিৎসাসেবার বাণিজ্যিকীকরণ রাষ্ট্রগুলোকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছিল কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতাবাদ যে এতটাই প্রকট সেটা করোনা প্রমাণ না করলে আগামী আরও বহুদিন মানুষকে এই ভ্রমেতেই বসবাস করতে হতো যে, আমরা তো আর অনুন্নত দেশ নই যে, আমাদের পথে-ঘাটে শেয়াল-কুকুরের মতো মারা যেতে হবে? আমরা উন্নত জাতি, আমাদের গণতন্ত্র উন্নত, আমাদের মৌলিক অধিকার সমুন্নত, আমরা পৃথিবীর ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্যই ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত। করোনা অতিমারি এই ভুল বিশ্বাসের বেদিতে এমন এক আঘাত দিয়েছে যে, জুলাই মাস নাগাদ গোটা বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে হুড়মুড় করে। এত যে যোগাযোগের বড়াই, এত যে বিশ্বগ্রাম বলে চেঁচামেচি সব কেমন ফুটো হওয়া বেলুনের মতো চুপসে যেতে শুরু করল, পৃথিবীজুড়ে কেবল মৃত্যুর খবর, আক্রান্তের খবর। এতটা নেতিবাচক সত্য, রূঢ় ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি পৃথিবী তার জ্ঞাত ইতিহাসে হয়েছিল কেবল মহাযুদ্ধকালে। তাও প্রচারণার অভাবে পৃথিবীর প্রান্তসীমায় থাকা মানুষেরা এসব মহাযুদ্ধ সম্পর্কে কেবল বোমার শব্দ কিংবা খাদ্যাভাবের কারণেই বুঝতে পেরেছিল, যেখানে এ রকম কিছু ঘটেনি সেখানে মহাযুদ্ধের কোনো স্মৃতি নেই। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে সে সময় কিছু না থাকায়, ইন্টারনেটের মতো মানবাবিস্কৃৃত কোনো 'বিনা তারের যোগাযোগ' ব্যবস্থা না থাকায় মহাযুদ্ধ, মহামারি কিংবা তৎপরবর্তী বিপর্যয়টা এ যাবৎ স্থানিক পর্যায়ে ছিল, বৈশ্বিক বলতে কেবল সেই প্রথম মহাযুদ্ধের পরপরই ঘটা 'স্প্যানিশ ফ্লু'র মহামারি। আফ্রিকার দিকে 'ইবোলা'র আঙুল তোলা আর হঠাৎ হঠাৎ সার্স, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, নিপাহ্ ভাইরাস এসবের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ছিল বটে কিন্তু মানুষ তাতে সর্বোতভাবে আতঙ্কিত হয়েছিল বলে জানা যায় না। কিন্তু করোনা মাত্র ছয় মাস ধরে পৃথিবীময় যে তাণ্ডব চালাল তাতে জুলাইয়ের শেষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ লাখের কাছাকাছি; যাকে গণমাধ্যম 'হাফ এ মিলিয়ন' বলে প্রচার করায় মানুষের ভেতর এই আশঙ্কাই গেড়ে বসল যে, পৃথিবী-জীবনের এই বুঝি শেষ, এরপর কেবল মৃত্যু এবং কেবলই মৃত্যু। ব্যক্তির জীবন হলো ঘরবন্দি। পশ্চিমে এই 'লকডাউনের' শুরুতে মানুষ প্রথমেই ভাবল, যাক কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো হবে। বুঝতে পারেনি কেউই যে, এই যে ঘরবন্দি থেকেও জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালু রাখার একটা নতুন অধ্যায় শুরু হবে তা শেষ পর্যন্ত করোনাপূর্ববর্তীকালীন অবস্থায় ফিরবে কিনা, যাকে আমরা 'স্বাভাবিক' বলে মনে করছি। দ্রুত মানুষ এই নতুন ঘরবন্দি ব্যবস্থাকে 'নতুন স্বাভাবিক' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলো। কারণ সামনে এর বিকল্প কিংবা পুরোনো 'স্বাভাবিক'-এ ফিরে যাওয়ার কোনো পথের চিহ্ন পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল না। সম্পর্কের টানাপোড়েনের সঙ্গে নিজেকে আধুনিক, সভ্য, সমতাভিত্তিক ইত্যাদি গালভরা বিশেষণে ভূষিত করা পশ্চিমেও ঘরের ভেতর 'নারী' হয়ে উঠল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, অতিমারির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল নারী নির্যাতন। মানুষের ভেতরে বসবাস করা জন্তুটা মানুষের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো ঘরের ভেতর- এ আরেক মহাবিপর্যয় বটে।
মানুষ আর কিছু না পেয়ে আঁকড়ে ধরল ইন্টারনেট বা অন্তর্জালকে। মানুষের জানালা লাগে, মনের, ঘরের এবং পৃথিবীর। অন্তর্জাল সেই জানালাটাই হয়ে উঠল দ্রুত। গোটা বিশ্ব যুক্ত হলো এই সংযোগ-ব্যবস্থায়। মূলধারার গণমাধ্যমের সমান্তরালে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেশে দেশে জনপ্রিয়তম ধারায় এরই মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছিল সেখানেই করোনাভাইরাস এবং এর আক্রমণ নিয়ে শুরু হলো বহুবিধ প্রচারণা। সত্য, অর্ধসত্য, কিঞ্চিৎ মিথ্যে এবং সম্পূর্ণ মিথ্যেরা মিলেমিশে এতটাই একাকার হয়ে গেল যে, ডালে-চালে মিশিয়ে নির্যাতিত বউকে বাছতে দেওয়ার মতো কুচুটে শাশুড়ির মতো হয়ে উঠল অন্তর্জাল। নেটিনাগরিকজনের দিনরাত একাকার হয়ে গেল এই অন্তর্জালভিত্তিক যোগাযোগ, প্রচারণা এবং কল্পিত-অকল্পিত-পরিকল্পিত সকল প্রকার তথ্যের 'আদান-প্রদান-বিতরণ-বিনিময়'-এ।
জুলাইতেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এতদিন রমরমিয়ে চলা মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, মাসখানেক পরেই পৃথিবীর সামগ্রিক জিডিপি নেমে এলো গড়ে ১-এর একটু ওপরে। পৃথিবীর পক্ষে বিশেষ করে পশ্চিমা বাণিজ্যিক ধ্যান-ধারণা কিংবা উঠতি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর (সমাজতন্ত্র বলতে কোথাও তেমন কিছুই নেই আর) জন্য এই ভয়ংকর বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহরে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা যখন হাজার ছাড়ানো শুরু করল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত হতে হতে প্রায় ত্রিশ লাখেরও বেশি আমেরিকান 'চাকুরি নেই' বলে নাম নিবন্ধন করল। যুক্তরাজ্যের মতো দেশ, যে কিনা এমনিতেই ব্রেক্সিট নিয়ে মহা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল করোনা অতিমারি দেশটির 'সার্ভিস-নির্ভর' 'আনপ্রোডাকটিভ' অর্থনীতিকে খাদে ফেলে দিল এক ধাক্কায়। চীন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উৎপাদক-অর্থনীতির দেশগুলো ভাবল তাদের কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু না, পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধসে পড়ায় তারাও পড়ল বিপর্যয়ে। তবে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বয়স্ক বাঙালিরা এ ক্ষেত্রে পড়ল চরম বিপাকে, কারণ কোনোভাবেই কোনো জায়গা থেকে পান জোগাড় করা সম্ভব হলো না। আর ওদিকে বাঙালি ব্যবসায়ীরা হুট করে দিল পানের দাম শখানেক গুণ বাড়িয়ে। মোটামুটি পাঁচটি পান পঁচিশ পাউন্ডে বিক্রির গল্পও শোনা গেছে। এটি অতিরঞ্জিত তথ্য কিনা তা নিশ্চিত করা না গেলেও কাছাকাছি সত্যের গল্প।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে করোনা কী বিপর্যয় নিয়ে আসবে কিংবা আদৌ করোনা বলতে কিছু আছে কিনা, সে প্রশ্ন নিয়ে প্রথমে বেশ সরব আলোচনা হলো কিছুদিন। কিন্তু তারপরই শুরু হলো ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্ন 'গুজব'। সে এক ভয়াবহ বিস্টম্ফারণ। এর সঙ্গে অচিরেই যুক্ত হয়ে গেল স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে বকাবাজি। কখনও বলা হচ্ছে করোনা নেই, কখনও বলা হলো করোনা আছে, কখনও করোনা কিচ্ছু করতে পারবে না আমাদের, কখনও করোনা কিছু করবে বটে তবে ক্ষতি হবে না, কখনও আবার করোনা এ দেশকে একেবারে পথে বসিয়ে দেবে ধরনের কথাবার্তা মানুষের মনকে বিষিয়ে দিল। এখানেও ঘোষণা হলো লকডাউন, আবার রাজধানী থেকে লাখ লাখ মানুষ গাদাগাদি করে এই লকডাউনের কারণেই ফিরে গেল গ্রামে- করোনা যে একটি ছোঁয়াচে এবং জীবাণুবাহী রোগ সে কথা ভুলে ঈদ-পার্বণ-শোকে আমাদের মেলামেশা যেন অর্গলহীন হয়ে উঠল। সরকার কখনও লকডাউন না মানলে শাস্তির বিধান দিল, কখনও বলা নেই কওয়া নেই তৈরি পোশাকের কারখানা খুলে দিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের আবার গাদাগাদি করে ফেরার সুযোগ করে দিল। ক্ষতি কতটুকু তাতে হয়েছে সে কথা এখনকার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিরূপণ করা না গেলেও তখন গোটা বিশ্ব এই অনিয়মের খবর ফলাও করে প্রচার করেছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনা অতিমারিতে কত লাখ মানুষ মারা যাবে তার হিসাব-নিকাশ চলতে লাগল সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ মানুষের কথাতেই। কিন্তু 'কোথা থেকে কখন কী হলো' বাংলাদেশে যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা আঘাত বসাতে পারল না করোনা। কিন্তু তাই বলে যারা চলে গেলেন এই করোনার শিকার হয়ে তাদের মধ্যে পরিচিত এবং বাংলাদেশের জন্য প্রাণাতিপাত করা নমস্য ব্যক্তিদের সঙ্গে হাজারখানেক অপরিচিতের নাম যোগ হলো।
আগস্টের শেষে এসে করোনা-অতিমারি যেন একটু দম নিতে শুরু করল। ইতালি, স্পেন, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে মধ্য মার্চ থেকে ক্রমাগত মৃতের সংখ্যা, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল সেসব দেশে উল্লেখযোগ্য হারে এই সংখ্যা পড়তি পথে হাঁটতে শুরু করল। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এই সংখ্যা এখনও ক্রমবর্ধমান, এখনও সেখানে আক্রান্ত ও মৃতের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। প্রশ্ন উঠছে, কাছাকাছি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও ভারতে কেন করোনা এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াতে পারল? প্রকৃতির কোন সে অমোঘ আরক বাঙালি-শরীরে থাকায় ভারতের তুলনায় এখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম? প্রকৃতির এ খেলায় বাঙালি কি তবে এবার বিজয়ী হলো? এড়াতে পারল কি বড় কোনো দুর্ঘটনা? করোনা অতিমারিকালে এ সত্যিই এক স্বস্তিদায়ক বাতাসের মতো আরামচিন্তা।
মার্চের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অবধি পৃথিবী সম্পূর্ণ আটক থাকল। ব্যতিক্রম ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো নড়চড় নেই, স্থবির পৃথিবীতে লন্ডনের মতো বড় শহরে হেঁটে গেলে মনে হতো এ শহর পরিচিত নয়, কোনো ভয়ংকর ভূতুড়ে কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি-ভিত্তিক সিনেমার সেট। যে কোনো মুহূর্তে বিকট চেহারার কোনো প্রাণী এসে চোখের পলকে চোখের সামনে যা পাবে তাই-ই ধ্বংস করে ফেলবে। আবহ সংগীত হিসেবে নাগরিক পাখিরা ফিরে এলো শহরে। ছোট্ট শহরে বিশাল শরীরের গাঙচিলগুলো হাহাকার করে ফিরতে লাগল, কেউ আর তাদের জন্য খাবার কিনে নিয়ে গিয়ে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাগর-ফেরতা নদীর কিনারে বসে ছুড়ে ছুড়ে খাওয়ায় না, এভাবে খেতে খেতে তাদের অভ্যেসটাই বদলে গিয়েছিল। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাবারের আশায় তারা চেঁচিয়েছে, হয়তো তখন অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরা হয়নি বলে মাছেদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় তারাও শহরঘেঁষা নদীতে এসে ঢুকেছে আর বড় বড় গাঙচিলের জন্যও খাবার জোটানোর পথ খুলে গেছে। প্রকৃতি সবুজ থেকে সবুজতর হয়েছে। যে লন্ডন ও তার আশেপাশের আকাশ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার বিমান চলাচল করে এই আকাশ-বাতাসকে কলুষিত করেছে তা চার মাস বন্ধ থাকায় দূষণমাত্রা কমে নির্মলতা ফিরেছে। ফলে পাখি ফিরেছে, আরও কী কী ফিরেছে তা মানুষ জানে না।
মানুষ না চাইলেও প্রকৃতির উপকারই হয়েছে হয়তো কিন্তু মানুষ কী করেছে? মানুষ নিজে বাঁচতে চেয়েছে একা, ধরেই নিয়েছে যে, এ যাত্রায় বয়স্ক এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা কাউকে আর বাঁচানো যাবে না। স্বাভাবিককালে যে শহরতলির রাস্তায় প্রতিবেশীর সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়েছে সেই রাস্তাতেই অ্যাম্বুলেন্স এসে প্রতিদিন একের পর এক প্রতিবেশীকে নিয়ে গেছে, তারা ফিরেছে কিনা আর সে খবর অজানা। হয়তো যে প্রতিবেশী এই অ্যাম্বুলেন্সগুলোর যাতায়াতের দিকে নজর রেখেছিল তার খবরটিও বাকিরা জানে না, তিনি আছেন কি নেই। মানুষের এই অসহায়ত্বই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে বছরের শুরু থেকে এই শেষ পর্যন্ত। অর্থনীতিতে ধস, সামাজিকতায় ধস, রাজনীতিতে ধস- মানুষের হাতে তবে আর থাকলটা কী?
দেশে দেশে অতিমারি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, সমাজের ভেতর যে অনৈক্য এবং রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা এতটাই প্রবল করে তুলতে সফল হলো যে, করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর তার সৎকারে পিতা তার সন্তানকে কিংবা সন্তান তার পিতার ক্ষেত্রেও কখনও কখনও অস্বীকৃতি জানিয়েছে, লাশ ফেলে রেখে গেছে বনে-বাদাড়ে। উন্নত রাষ্ট্রে তবু রাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে, নিউইয়র্কেও মৃতদের জন্য করা হয়েছে গণকবর, যন্ত্র দিয়ে সৎকার করা হয়েছে লাশের। মানুষের ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা আর মূল্যহীনতা এতটা উদগ্র আর স্পষ্ট হয়েছে যে, এই বিপরীতে মানুষে মানুষে প্রেম, ভালোবাসা কিংবা আস্থার জায়গাটা ফিরে আসতে এখনও হয়তো বহুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রেমহীন সমাজে কিংবা পরিবারে নারী ও শিশুর (কন্যা ও ছেলে উভয়েই) ওপর সহিংস যৌন আক্রমণ এই অতিমারিকাল শেষ হতে না হতেই চরম আকার নিয়েছে। শহর ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলো গ্রামে ফিরে গিয়ে শিকার হচ্ছে অপরিমেয় সহিংসতার। কারণ এতদিন তাদের অনুপস্থিতিতে যারা তাদের সম্পত্তি ভোগদখল করেছে তারা কেন ছাড়বে? তারা তো সেটাকে এতদিন অধিকার হিসেবেই ভেবে এসেছে, সুযোগ হিসেবে নয়। এখন সে অধিকার কেড়ে নিতে চাওয়ায় সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কে জানে এই সংঘর্ষ, এই অনিশ্চয়তার শেষ কোথায়।
মজার ব্যাপার হলো, এই করোনা অতিমারি পৃথিবীর সকল ইতিবাচক সূচকে ধস নামিয়েছে, কেবল পারেনি কোনো নেতিবাচক সূচককে ধসাতে। এখনও আর সবকিছু ছাপিয়ে পৃথিবীময় দাপিয়ে ফিরছে হিংসা, ধর্মবিদ্বেষ, ক্ষুদ্র ও দুর্বলের ওপর সংখ্যাগুরু ও সবলের আঘাত, এখনও অর্থ ও বিত্তবানরা টাকার পাহাড় বানিয়ে চলেছেন, ধনী দেশগুলো এখনও অন্যায্য অবরোধ বজায় রেখেছে দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলোর পর, এখনও দেশে দেশে দমনপীড়ন দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার কৌশল করে যাচ্ছে সরকারগুলো; এখনও পৃথিবীতে বয়ে যাওয়া করোনা-পূর্ববর্তীকালের বিদ্বেষবাস্প সমানভাবে বহমান; চলমান শুরু হওয়া যুদ্ধসকল; করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির লক্ষ্যে টিকা আবিস্কার হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে চলছে মিথ্যাচার, বাণিজ্য এবং রাজনীতি। আজও (২৫ অক্টোবর ২০২০) পৃথিবীর ২১৫টি রাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ হাজার ৫০৮ এবং আজকের দিনে ঘটে যাওয়া মৃতের সংখ্যা নিয়ে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৪ হাজার ৩১২-তে। এই অতিভারী লাশের বোঝা নিয়ে এখনও 'হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী', অতিমারিও যা দমাতে পারেনি।
'মানুষ কি তবে লাশ হয়ে যাবে
তবু হিংসারে নাহি ত্যাজিবে? '
লেখক
কবি
কথাশিল্পী
মন্তব্য করুন