মানব সভ্যতা অনেকবার বীভৎস অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে রোগবালাই নিয়ে। প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত- এ সবই দেখেছে। বাঁচতে লড়েছে। আমাদের প্রজন্ম বইয়ে পড়েছি সেসব। উপন্যাসে এ নিয়ে হাহাকারের ছোঁয়া পেয়েছি। কিন্তু আধুনিক বিশ্ব সভ্যতায় করোনার মতো মারি আঘাত করবে, তা কখনও কেউ ভাবিনি।
শুরুতে এমন ছিল, করোনা আসতে পারে, নাও পারে বাংলাদেশে। এমন একটা ভাবনার গোড়াতে প্রায় সকলেই স্বাভাবিক জীবনের ধারায় চলেছে। কিন্তু এলো তারা। এলো ঝাঁক বেঁধে। দল ধরে। থমকে গেল জনপদ। দিশেহারা। জানে না প্রতিরোধ কী করে করতে হয়।
যখন এলো এবং সাথে নিয়ে এলো মৃত্যুর শীতলতা। একসাথে সকলেই হতবিহ্বল। তবে এটাও জাদুর মতো, বাংলাদেশে অনেক ভীতির হীমশীতলতার পরও ইউরোপের মতো এখানে মৃত্যু ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। তবুও আছে বিভীষিকা।
আমি নিজেও পুরো পরিবারসহ আক্রান্ত হয়েছি। হাসপাতালে ছিলাম দু'সপ্তাহ। পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায়। হাসপাতালে সিট পাবার পূর্বে আতঙ্কে ছুটেছি হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল। একটা সিট দরকার আমার জন্য। বাঁচতে চাই। বহু দেনদরবারে ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট হাসপাতালে পুরুষ নয়, ফিমেল ওয়ার্ডে জায়গা পেলাম। বাঁচতে হবে। সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও অসহনীয় খরচে মরার জোগাড়!
হাসপাতালে প্রত্যক্ষ করেছি একটুখানি অক্সিজেন পেতে করোনা আক্রান্তদের কী হাহাকার! বুক খামচে ধরে আছে। ফুসফুসে বাতাস ঢোকে না!
মানুষের এমন বিচলিত আর অসহায় পরিস্থিতির মাঝে ধনী, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষেরা নির্ভর করেছে অলৌকিক না দেখা ঈশ্বরের কৃপার ওপর। কিন্তু এও সত্য, করোনার মতো অদৃশ্য শত্রুর সাথে আলিঙ্গনের ভীতির মঝেও অনেকে লুটেছে, লুটছে। ভরেছে পকেট দু'হাতে। স্বাস্থ্য খাতের করুণ হাল। দায়িত্বপ্রাপ্তরাই ডুবে গেছে দুর্নীতিতে। এ হলো অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান বাংলাদেশের খবিশ চিত্র। পুঁজির খেলায় মুনাফা লুটবার মানসিকতা মানুষকে জানোয়ারে রূপান্তরিত করে- এ তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
করোনা শুধু মৃত্যুই উপহার দেয়নি; আমাদের জীবনযাপন ধারাও বদলেছে। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। আড্ডাখানায় ধুলোর পরত। কাছের প্রিয়জনকে ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রাখতে পরস্পর গেছি সরে। ব্যক্তিগত বিলাপের সুরেই বলি, এমন দূরত্বের মাঝেই আমরা হারালাম আমাদের বড়ভাই ডক্টর মাহমুদ রিজা শহীদকে। চোখের জল সামলে ঢাকা মেডিকেলের করোনা আইসিইউ ইউনিটে ও যখন দিনরাত লড়ছিল, তখন পুনরায় আক্রান্ত হবার আতঙ্কে আমরা কেউ কাছে যাইনি। শুধু ওর পুত্র ছিল রাতদিন ওর পাশে। এমন বিষণ্ণতার ভেতর এগোচ্ছে পুরো দুনিয়া। আমাদের বাংলাদেশে।
এর বাইরে আবার মানুষ যখন নিজেকে বন্দি করেছে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে, তখন জেগে উঠেছে প্রকৃতি তার আপন জগৎ নিয়ে। অব্যবহূত ফুটপাতের কিনারে আনন্দ শিহরণ নিয়ে বেড়ে উঠেছে সবুজ ঘাস। বুনো ফুলের রং বাহার। এ হলো জগতের নিয়ম, প্রকৃতিও হাঁক দেয়। 'আমাকেও বাঁচতে দাও'- গৃহবন্দি মানুষ তখন কোরাস করে বলছে, তোমাদের বাঁচার অধিকার আছে। গান গেয়ে, কবিতা পড়ে অনলাইন মাতিয়ে তুলছে। এ ধারায় ভেঙে ফেলেছে প্রচলিত টেলিভিশন এবং পত্রিকার আদল। গড়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত মিডিয়া জগৎ।
প্রকৃতির এমন রূপের মাঝে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের দিন খেটে খাওয়া, ছোট ব্যবসায় করা বা অতি সাধারণ চাকুরে হাঁসফাঁস করছে। তাদের পকেটে অর্থ শুকিয়ে আধমরা। তারপরেও শিকল ভেঙে মানুষেরা সকল বিধি ছুড়ে ফেলে বেরিয়েছে রাস্তায়। প্রতিটি ছোট শহর হতে রাজধানীর পথে উপচেপড়া মানুষের স্রোত। পথে বেরিয়েও তাদের জীবনমান ফিরছে না আগের জায়গায়। এটা রূঢ় বাস্তবতা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, করোনায় বাংলাদেশের ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষের আয় কমে গেছে। আর পরিবার হিসাবে আয় কমেছে ৭৪ শতাংশ পরিবারের। অনেক সাহস, অনেক লড়েও তারা থিরথির করে কাঁপছে পরিবারের ভরণ-পোষণ মেটাতে। এটা রুদ্র না ঠেকানো গেলে, তাদের দারিদ্র্য আরও বাড়বে।
দিন কয়েক আগে জার্মান নিউজ সংস্থা ডয়চে ভেলের একটা রিপোর্টে ব্র্যাক, ডেটাসায়েন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষা নিয়ে বলেছে, 'করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের আর্থনৈতিক অবস্থার এই চিত্র পাওয়া গেছে।'
করোনা এবং জাতীয় বাজেট ২০২০-২০২১ :নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কৌশল পুনর্বিবেচনা' শিরোনামে এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী এই করোনার সময় চাকরি হারিয়েছেন। তাদের একটি অংশ এরই মধ্যে দেশে ফিরেছে। বাকিরা ফেরার অপেক্ষায়।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনায় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা ১০ কোটিরও বেশি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছেন। যাদের এখন দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। তাদের মধ্যে চার কোটি ৭৩ লাখ উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং তিন কোটি ৬৩ লাখ মানুষ উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
যেসব পরিবার থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। গত মার্চ থেকে মে মাসে তাদের পারিবারিক উপার্জন ৭৪ শতাংশ কমে গেছে।
সার্বিকভাবে এই করোনায় অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যের মৃত্যু হলে নারী ও শিশুদের মধ্যে অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হওয়ার উচ্চ আশঙ্কা সৃষ্টি হবে।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়, দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া খাদ্য এবং নগদ সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না।
মূলত করোনা একটি নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে মাস কয়েক আগের এ হতাশার চিত্রটির মাঝে এখনকার আলোর রেখা হলো, বাংলাদেশেরর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কোরবানি ঈদের আগে সরকারের নিষেধাজ্ঞা শিথিল ও গণপরিবহন সচল থাকায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। ফলে ক্রমেই গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে। হাসি ফুটছে ব্যবসায়ীদের মুখে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এসেছে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স, পুঁজিবাজারে ফিরেছে গতি।
করোনা অর্থনীতির নানা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও তুলনামূলক শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও কৃষি খাত। বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত টানা তিন মাসে রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, তা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সের ওপর ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এর পর থেকেই বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরেও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রয়েছে। এ কারণেই বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করে।
অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে সরকারের বেশ কয়েকটি উদ্যোগ সহায়তা করেছে বলে মনে করি। অনস্বীকার্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১,০৩,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহের সঙ্গে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। তবে রাজস্ব আয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এখনও নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। সে কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে আরও সময় লাগবে। এ জন্য করোনা মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোয় নীতি সহায়তাসহ প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
সবটা মিলিয়ে এটা স্বচ্ছ- আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। আগের পর্যায়ে সহজে পৌঁছুবে না। সময় লাগবে। তবে পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক দৌড়ের সড়কে আধুনিক দেশগুলোরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বছরখানেক লেগে যাবে। আমাদেরও সে সময় লাগবে বলেই ধারণা। তবে এখানে আলো ফেলে বলা ভালো, বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই অবস্থায় রাখাই সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য প্রবৃদ্ধি নিয়ে না ভেবে উৎপাদন, বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে আগে ভাবতে হবে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আমাদের অর্থনীতিকে সহায়তা করছে। আমাদের নতুন করে রপ্তানি আদেশও আসছে। সবদিক বিবেচনায় আমরা মৃদু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
তার ফলও হাতে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। আইএমএফের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। ভারতের সাথে তুলনায় এগোনো আমার কাছে দারুণ কিছুু নয়। তবে এটি একটি উল্লাসের সৃষ্টি করেছে এ প্রেক্ষিতে, আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। এটা প্রমাণিত। অর্থনৈতিকভবে এগিয়ে যাচ্ছে আসছে শীতে করোনার একটা প্রবল ধাক্কা আর আশঙ্কা মাথায় নিয়েই। জনগণ গ্রীষ্ফ্মের অভিজ্ঞতাকে সাথে রেখে আগামী শীতে এ রোগের যে কোনো আঘাতকে মোকাবিলা করবে বলেই প্রস্তুত নিজের মতো করে। আশা করি, করোনা ভ্যাকসিন বিশ্বে বাজারজাত হলে বাংলাদেশের মানুষের জন্যও সহজতর করবেন তিনি।
আমরা তো লড়তেও জানি। আমরা ভালোবাসতেও জানি। আর আমাদের নেতা শেখ হাসিনাও জানেন কী করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সকলে সবিস্ময়ে দেখছি, চোখের সামনে প্রমত্ত পদ্মার ওপর ৩৪তম স্প্যান বসল। এখন পাঁচ কিলোমিটার সেতু অপূর্ব গর্বে আকাশ ছুঁইছে। এ করোনাকালে পদ্মা নদীর ওপর তরতর করে বেড়ে ওঠা সেতু, হার না মানা বাংলাদেশের ফুটে ওঠা সূর্যমুখী।
লেখক
কবি
প্রাবন্ধিক

বিষয় : তবুও জীবন ধায়

মন্তব্য করুন