করোনা মহামারি বা এই কভিড-১৯ সমগ্র পৃথিবীকেই যেন সংকটের নতুন একটা মাত্রায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে গেছে। সম্ভবত আরও বড় রকমের পরিবর্তন সামনে আসবে। সারা পৃথিবীই করোনা প্রতিরোধে আটঘাট বেঁধে নামলেও আমরা তেমন কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। আশু কোনো ফলাফল পাবো বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, টিকা আবিস্কারের মুখ দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ আমরা প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করেছি। পরে মার্চ মাসের শেষ দিকে সরকার সারাদেশে সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করলেন। সে অর্থে সম্পূর্ণ 'লকডাউন' না করে জরুরি কয়েকটি সেবা খাত চালু রেখে সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো। তারপর এপ্রিল গেল, মে মাস গেল- অবস্থার ক্রমেই অবনতি হলো; জুন মাসে এসে প্রচণ্ড রকমের সংক্রমণ দেখা দিলো সারাদেশে। এর ভেতর দিয়েই আমরা আমাদের জীবন ধারণের উপায় খুঁজে বের করতে চাইলাম। অনেকেই অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ চলল কিছুদিন। কিন্তু যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, দিন এনে দিন খায় যারা, তাদের অনেকেই ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে পড়ে গেলেন। এই কষ্টের ভেতর পড়ে গেলেন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষও। ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশক বা ছাপাখানায় যারা কাজ করতেন- একেবারে শুরুতেই তারা একটা আঘাত পেলেন। আরেকটা আঘাত এলো সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে সরাসরি জড়িত যারা- যেমন ধরা যাক যারা রাস্তায়, ট্রেনে, স্টেশনে গান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন; কিংবা গ্রামে-গঞ্জে এ ধরনের কোনো কিছু করে দিন চালাতেন, তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামে-গঞ্জে ক্ষেত-খামারে খেটে খাওয়া মানুষ- তারা অল্প দিনের জন্য হলেও একটা ভয়ানক দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলেন যে, এখন তারা কী করবেন? সামনের দিনটা কী হবে? তাদের রুটিরুজি তখন প্রায় বন্ধ হয়ে যায় যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ খুবই দ্রুত এটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আমাদের ব্যক্তি উদ্যোগ ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষি ব্যবস্থাকে সচল রাখতে পেরেছিলাম; যা আমাদের জাতীয়ভাবে অর্থনীতি ও খাদ্য খাতকে তাৎক্ষণিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু যে কথাটা আমি বলতে চাই- যে করোনার কারণে আমাদের ভেতরে ভেতরে সামাজিক কাঠামোতে ভাঙন তৈরি হয়ে গেল- তার প্রাথমিক আঘাতটা স্পষ্ট হয়ে উঠল শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের সকল ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই একটা অচলাবস্থা নেমে এলো। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল, এখনও বন্ধ। শিক্ষার্থীরা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল প্রতিষ্ঠান এবং নিজেদের থেকে। এই বিচ্ছিন্নতাটা আমরা অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। তবে একটি শিক্ষাবছর নষ্ট হয়ে গেল, এখন আমরা অটোমেশনের কথা বলছি। কিন্তু একটি বছর কম কথা নয়; মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে, জীবনের সময়গতভাবে যে ঘাটতি তৈরি হয়ে গেল- এটা অপূরণীয়।
মানুষের পাশাপাশি পশুপাখির মধ্যেও এ সংকট দেখা গেছে। আমি বিশেষ করে লক্ষ্য করেছি, শহুরে বানর এবং হনুমান খাদ্যের অভাবে পড়ে গিয়েছিল। কারণ অনেকেই গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট এসবও বন্ধ- তাই তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এখনও অনেক বানর-হনুমান বাস করে। তা ছাড়া পাখি ও কুকুরকেও কোথাও কোথাও খাদ্য সংকটে পড়তে হয়েছে। আমার বাসায় দেখেছি বানরেরা সে সময়টাতে ঘরে ঢুকে উৎপাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘরে ঢুকে যায়, খাবার খোঁজে।
এখন এই যে খাওয়া বনাম রোগ, এই যে উভয় সংকট- আমি জীবন ধারণ করব নাকি সংক্রামক ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য লড়ব? করোনা প্রতিরোধ মানে বলা হলো, পরস্পর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলা, হাতে গ্লাভস্‌ পরা, মুখে মাস্ক পরা, বাইরে থেকে এলে বা নিয়মিতই সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করা। মেলামেশার সব জায়গা বন্ধ হয়ে গেল, স্কুল-কলেজ-সিনেমা হল-মিলনায়তন অর্থাৎ যেসব জায়গায় মানুষের ভিড় হতে পারে, তেমন সব জায়গা পরিহার করা হলো। পৃথিবী জুড়েই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে করোনা প্রতিরোধে চেষ্টা চালিয়ে গেল মানুষ।
আরেকটা বড় ঝুঁকির মুখে পড়ল পর্যটন খাত। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল তার চেয়ে দ্বিগুণ বেগে। চতুর্দিকে কেবল করোনা আক্রান্ত রোগীর ছড়াছড়ি। তাদের চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিতে এবং সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে নিয়মিত বা সাধারণ রোগীরা তাদের চিকিৎসা নিয়ে সাংঘাতিক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল। অনেক রোগীই বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে লাগল। করোনাভাইরাসে মৃতদের সৎকার নিয়ে ভয়াবহ একটা নতুন পরিস্থিতি দেখতে লাগল বিশ্ববাসী এবং বাংলাদেশের মানুষও। এসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে লাগল। মানুষের সামাজিক বিশ্বাসে হঠাৎ করেই যেন একটা বিচ্ছিন্নতাবোধের সংক্রমণও নিয়ে এলো করোনা।
এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে মানুষ এখন আবার স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। আবার সবাই জীবিকায় ফেরার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসও কয়েকশ বার জিন বদলেছে। সংক্রমণ কিন্তু চলছেই। প্রতিদিনই মৃত্যুর হার ওঠানামা করছে। সম্প্রতি মৃত্যুহার বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া অদেখা, অলিখিত এমন অনেক মৃত্যুই ঘটেছে যেগুলো করোনামৃত্যু কিনা সেগুলো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে করোনার প্রভাবের কথা যদি সংক্ষেপে বলি- এবার পহেলা বৈশাখের চিরাচরিত আয়োজন ব্যাহত হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়নি। ঈদের স্বাভাবিক আনন্দও ব্যাহত হয়েছে। এখন দুর্গাপূজায় সচরাচরের মতো উৎসব আমেজও দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে আমরা শুরুর কয়েক মাস শুধু অফিস পাহারা দেওয়ার মতো করে সপ্তাহে এক দিন যেতাম। আমাদের বড় একটি কর্মকাণ্ড গবেষণা, বড় আরেকটি কর্মকাণ্ড প্রকাশনা- এগুলো বলতে গেলে প্রায় বন্ধই ছিল। বাংলা একাডেমির ছাপাখানাটি মোটামুটি বড় একটি ছাপাখানা; সেটিও বন্ধ রাখতে হয়েছিল। বই বিক্রয়কেন্দ্রের কাজও বন্ধ ছিল। এসব দিক দিয়ে আর্থিকভাবে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার- সেখানে করোনার কারণে গবেষক-পাঠকদের সমাগম শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এ তো কেবল বাংলা একাডেমির চিত্র, এর বাইরে সারাদেশেও শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল পরিসরই এমন স্থবির হয়ে পড়েছিল। শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার, লোকশিল্প ফাউন্ডেশন- এমন সব প্রতিষ্ঠানই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতির সীমা হিসাব করবার মতো নয়। যার সঙ্গে দেশের লেখক-সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ডের ক্ষতিও রয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ইনস্টিটিউট, গণমাধ্যম ও সংশ্নিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মরত প্রচুর মানুষের জীবনযাত্রা ভয়াবহ রকম ওলটপালট হয়ে গেছে। অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে সামান্য অনুদানের জন্য বহু মানুষের যে আকুতি আমরা দেখেছি তা অভাবনীয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমরা সাধ্যমতো সামান্য হলেও সহায়তা করার চেষ্টা করেছি।
এই করোনাকালে আমরা আরও কয়েকটি বড় দুর্বিপাকে পড়েছি। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো বন্যা। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বহু জেলা বন্যায় ভেসে গেছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার এ আঘাত এখনও পর্যন্ত চলমান। বন্যা-পরবর্তী সংক্রামক ব্যাধি করোনার সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
কিন্তু এ সবকিছুর মধ্যেও আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কারণ জীবন জেগে থাকবে। জীবন এখানেই থেমে যাবার নয়। ২০২০ সালে আমরা অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করেছি। সে বইমেলাটি উৎসর্গ করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাকে। বছরটি তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। ২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। তাই ২০২১ সালের বইমেলাটি স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী লাখো শহীদের প্রতি উৎসর্গ করব আমরা। সেভাবেই পরিকল্পনামাফিক আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এই সংকটময় পরিস্থিতির কারণে বইমেলা আয়োজনে যদিও এখনও অনেক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান, তবু আমরা এখন পর্যন্ত আশা করছি ২০২১ সালের বইমেলাটি আমরা করব। সাধারণভাবেই আমরা সেটি করার চেষ্টা করব। এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি শক্তভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে। সরকার যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পূর্বশর্তেই আমাদের বইমেলাটি করার অনুমতি দেবেন। ভার্চুয়াল বইমেলা করার কথা আমরা এখনও ভাবছি না। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাসহ বিশ্বে অনেক জায়গায় ভার্চুয়ালভাবে বইমেলার আয়োজন চলছে আমরা দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির এ মাসব্যাপী বইমেলাটি কেবল একটি বইমেলা নয়, এটি বাঙালির মিলনমেলা, এটি বাঙালি চেতনা চর্চার মেলা, আমাদের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার মিলনমেলা। তাই আমরা সর্বান্তকরনে চাইছি সাধারণভাবে হলেও বইমেলাটি হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই আমাদের সাবধান করেছেন যে, আগামী শীতে করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ আসতে পারে। আমরা সেইসব দুশ্চিন্তা অনিশ্চয়তা সঙ্গে করেই প্রস্তুত হচ্ছি। আশা করছি পৃথিবীর সব মঙ্গলকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনায় আমরা এই দুর্যোগ থেকে অচিরাৎ মুক্তি পাবো; করোনার টিকা আবিস্কার হবে। এবং তার ফলে স্বস্তির সঙ্গে আমরা সবকিছু এগিয়ে নিয়ে যেত পারব, ঘুরে দাঁড়াতে পারব জীবনের দিকে।
লেখক
কবি
মহাপরিচালক
বাংলা একাডেমি

বিষয় : জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে

মন্তব্য করুন