- বিশেষ আয়োজন
- বিজয়ের মাসে অম্লমধুর রোমন্থন
বিজয়ের মাসে অম্লমধুর রোমন্থন

একটা সুখানুভূতি নিয়ে প্রতিবছর বাঙালির জীবনে ডিসেম্বর আসে। স্বাধীনতার সুখ, শৃঙ্খলমুক্তির আনন্দ, মুক্ত জীবনে নির্মল নিঃশ্বাস গ্রহণ- সে কী কম কথা! একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলো ছিল মুক্তিকামী বাঙালির জীবনে আতঙ্কের, কিন্তু হতাশার নয়। একটা দৃঢ়প্রত্যয় প্রতিমুহূর্তে আমাদের উজ্জীবিত করত। জাতীয় জীবনের এই তমসাচ্ছন্ন কাল অনতিবিলম্বে শেষ হবে- শুধু সময়ের অপেক্ষা। এ ভরসাই একাত্তরের বাঙালির জীবনে ছিল আলোকবর্তিকা- তারা জয় করেছিল মৃত্যুভয়কে। অতঃপর কেটে গেছে ন্যূনাধিক অর্ধশতাব্দী।
১৯৬৯-এর দিনগুলোতে ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশ উন্মাতাল হয়ে উঠেছিল। আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু এবং সংশ্লিষ্ট বরেণ্যজন। চতুর্দিক লাখো কণ্ঠের স্লোগানে স্লোগানে মুখর- 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা; তোমার দেশ আমার দেশ/ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ; জয় বাংলা!'
'৭০-এর প্রলয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের দক্ষিণাংশ। প্রাণ হারায় প্রায় ১০ লাখ আদম-সন্তান, অগণিত পশুপাখি। দুর্গত জনপদ এবং সেখানকার অসহায়-নিরন্ন জনগণের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা- শোনাচ্ছেন আশার বাণী, দিচ্ছেন বেঁচে থাকার প্রেরণা। অন্যদিকে, পাকিস্তান সরকার নির্বিকার চিত্তে অবলোকন করছে মানবেতর জীবনযাপনকারী বাঙালিদের। এসে গেল '৭০-এর সাধারণ নির্বাচন-বাঙালিদের সুদে-আসলে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাবনিকাশ করার মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু '৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।'
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর বার্তা পেয়ে বিভিন্ন সেনানিবাসের বাঙালি অফিসার ও জওয়ান, ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), পুলিশ ও আনসার বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে মূল শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ- ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কৃষক-শ্রমিক- যাকে বলে গণশক্তি। দখলদার বাহিনী রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে এবং তিন দিন পর বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ১৯৭২-এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্ত বঙ্গবন্ধুর লন্ডন হয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাজসিক আগমন।
জনতার অশ্রুসিক্ত ভালোবাসার ছোঁয়া নিয়ে লোকারণ্য পথে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আসতে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগল। থেকে থেকে স্লোগান 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। নেতা মঞ্চে আরোহণ করে বুকভরা ভালোবাসা আর সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে জনসমাগম অবলোকন করলেন। তিলমাত্র ঠাঁই নেই। আজকে আর ৭ মার্চের ভাষণ নয়- এ যেন আরেক মহামানব, তার চিরচেনা বজ্রকণ্ঠ আবেগাপ্লুত। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করছেন। তিনি কথা বলছেন স্বজনদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। নেতার চোখে আনন্দাশ্রু। দেশ স্বাধীন! আনন্দ যে বাঁধ মানে না। কিন্তু তার দেশবাসী কেমন আছে, কতজন প্রাণ দিয়েছে, কত প্রিয় মুখ হারিয়ে গেছে- তার তো হিসাব নেই। অজানা আশঙ্কায় মুখমণ্ডলে বিষাদের ছায়া। তবু তাকে কথা বলতে হচ্ছে। নেতার চোখে জল। জনতার চোখও অশ্রুসিক্ত। এ যেন হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের সম্মিলন। আত্মীয়ের সঙ্গে পরমাত্মীয়ের বহু কাঙ্ক্ষিত মিলন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বক্তব্য শেষ হলে জনতা যেন জেগে উঠল- জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! অতঃপর শেষ বিকেলে বিভিন্ন পথে বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে কলকণ্ঠে নিজ নিজ অনুভূতি প্রকাশ করতে করতে সমবেত জনতা গৃহমুখী।
আমরা উচ্ছ্বসিত চার বন্ধু যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও রোকেয়া হলের মধ্যবর্তী রাস্তা অতিক্রম করছিলাম, ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম উর্দি পরিহিত চারজন ভারতীয় শিখ জওয়ান তাদের ভাষায় সহাস্য উত্তেজনায় আলোচনা করছিল। আমাদের একজন হঠাৎ তাদের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'সর্দারজি, লিডার কো ক্যায়সা দেখা?' প্রত্যুত্তরে জনৈক সর্দারজি বললেন, 'জ্যায়সা সোনা থা বাহাদোর কো অ্যায়সাই দেখা!' গর্বে গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করল- 'সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে।'
সম্ভবত '৭১-এর এপ্রিল-মে মাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ঢাকা কলেজে বদলির চিঠি পেয়েছিলাম। কিছুদিন পর ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকা কলেজে গেলে অধ্যক্ষ মহোদয় তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, 'বদলির আদেশ তো আগেই পেয়েছিলেন, আসতে দেরি হলো কেন?' তখনই আমাকে যোগ দিতে হলো।
শিক্ষকদের কমনরুমের লাগোয়া ছোট একটি কক্ষ প্রধানত বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তবে সেখানে সহমর্মী ও সমমতাবলম্বী অন্যান্য বিভাগের দু-চারজন শিক্ষকও আসতেন। কয়েকজন শিক্ষক সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। এরা প্রধানত অবাঙালি ও কট্টর পাকিস্তানপন্থি। এরাই ছিল অধ্যক্ষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী এবং তার পরামর্শক ও কলেজের অভ্যন্তরীণ খবরাখবর সরবরাহের আড়কাঠি।
মে মাস থেকেই আমাদের আতঙ্ক-উৎসাহ-উত্তেজনা ক্রমাগত বেড়ে চলছিল। খোদ ঢাকা শহরেই দখলদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা ও সাফল্যের সঙ্গে বোমা ও গ্রেনেড আক্রমণ গেরিলা যোদ্ধাদের সক্রিয় উপস্থিতি ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের সংবাদ, বিবিসির খবর এবং সন্ধ্যার পর স্বাধীন বাংলা বেতারে চরমপত্র এবং দেশাত্মবোধক গান আমাদের মনোবল অটুট রেখেছে। এ সময় আকাশবাণীর ভূমিকাও ছিল স্বস্তিদায়ক। দেশের অভ্যন্তরে কাদের সিদ্দিকীর রণকৌশল ও সাফল্য তাকে প্রায় রূপকথার নায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ১৭ ও ১৮ মে ১৯৭১-এ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছয় জায়গায় গ্রেনেড ছোড়া হয়। ১৫ আগস্ট রাতে নৌ-কমান্ডোরা একই সময়ে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজগুলো ধ্বংস করেন। বহির্বিশ্বে এই খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়।
যতদূর মনে পড়ছে, '৭১-এর ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের কক্ষে চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা আলোচনায় নিমগ্ন, এমন সময় অধ্যাপিকা সুলতানা বেগম (প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক মুসা সাহেবের ভ্রাতৃবধূ) উপস্থিত হলেন। তার চোখেমুখে অপরূপ জেল্লা। জানালেন মোনায়েম খানের নিধন সংবাদ। ১৩ অক্টোবর রাতে মোনায়েম খানকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক- পরবর্তীকালে 'বীরপ্রতীক' খেতাবপ্রাপ্ত এবং তার আরেক সহযোদ্ধা। আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়ার মিনি সংস্করণ অধ্যক্ষ সাহেব নাজিল হয়ে বললেন, "কী ভেবেছেন? আপনাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থাকবে। আমেরিকার 'সেভেন্থ্ ফ্লিটের' নাম শুনেছেন? এসে গেছে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। আপনাদের সব খবরই আমি রাখি।" যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই গোঁ গোঁ করতে করতে ক্ষিপ্ত ষণ্ডের মতো বেরিয়ে গেলেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে হানাদার বাহিনীকে। তারা এখন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। নভেম্বরের শেষার্ধ। চারদিক থেকে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের চমকপ্রদ সাফল্যের সংবাদ। অসহিষ্ণু পাকিস্তান মরিয়া হয়ে নিজ কফিনে শেষ পেরেকটি টুকল ৩ ডিসেম্বর, '৭১-এ লাহোর ফ্রন্টে ভারত আক্রমণ করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্ভবত তখন কলকাতায়। তিনি তৎক্ষণাৎ দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন এবং লোকসভার অনুমোদনক্রমে পাকিস্তানের আক্রমণের যথাযোগ্য জবাবদানের নির্দেশ দেন। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর আগে ভুটানও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৩ ডিসেম্বর থেকে উভয় দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ঢাকার আকাশে দেখা গেল ভারতীয় মিগ ও পাকিস্তানি স্যাবার জেট। এই প্রথম এবং সম্ভবত শেষবার দুই বিবদমান পক্ষের বিমান যুদ্ধ, যাকে বলে 'ডগ স্কাইট' সানন্দে উপভোগ করলাম। অবশ্য আকাশযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ, ভারতীয় বিমানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থানে নির্ভুল আক্রমণে তৎকালীন পাকিস্তানের 'হাওয়াই আড্ডা' প্রথম দফাতেই রফা হয়ে গেছে। পশ্চিম সীমান্তেও পাকিস্তানি বাহিনীর একই হাল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে ভারতের একটি পরিত্যক্ত বিমান নিয়ে দুই দুঃসাহসী বাংলাদেশি বৈমানিক চরমতম ঝুঁকি উপেক্ষা করে খুবই নিচু দিয়ে এসে নারায়ণগঞ্জের তেলের ডিপো ধ্বংস করে দেয়।
আমাদের মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, সঙ্গে রয়েছে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা- মুক্তাঞ্চলে সাধারণ মানুষও বেরিয়ে এসেছে 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে। প্রাণভয়ে হানাদার বাহিনী তখন ক্যান্টনমেন্টমুখী। শুধু আনুষ্ঠানিক বিজয়ের দিনক্ষণের অপেক্ষা।
সম্ভবত ১০-১১ ডিসেম্বর ভারতীয় প্লেন থেকে লিফলেট নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে বর্বরতা বন্ধ করে অনতিবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় এবং জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানায়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে এ দেশি আলবদর, আলশামসের সদস্যরা বাংলাদেশকে চিরতরে পঙ্গু করার হীন উদ্দেশ্যে ১৪ ডিসেম্বর দেশের বহু কৃতী সন্তানকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৫ তারিখ সকালেই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, দু-এক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই চাপা উত্তেজনা। বিবিসি ও আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ শুনছি। পুরান ঢাকার ৮১ নম্বর ভাগলপুর লেনের বাড়ির ছাদ থেকে বহু হুমকির মুখেও বাংলাদেশের পতাকা নামানো হয়নি। শেষ পর্যন্ত এটি বিবর্ণ ও শতচ্ছিন্ন হয়ে শুধু বাঁশের দণ্ডটি খাড়া ছিল। রাত ১১টা নাগাদ বিবিসি ও আকাশবাণী থেকে জানানো হলো, পাকিস্তান আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরের যে কোনো শুভক্ষণে আরেকটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী। পূর্বোক্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা জয় বাংলা পতাকার জন্য আবদার করলে গৃহকর্ত্রী মাটির তলায় সযত্নে রক্ষিত একটি টিনে পলিথিনে মোড়ানো প্রার্থিত পতাকা বের করে দিলেন এবং সেটি ওই বংশদণ্ডেই উড্ডীন হলো। নওয়াবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির সম্মুখের বিশাল বটগাছের ওপরেও ১৬ তারিখ সকালে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল।
১৬ ডিসেম্বর অপরাহেপ্ত রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লে. জে. নিয়াজি ভারতীয় লে. জে. অরোরার কাছে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করে পরাজয় মেনে নেন। যে টেবিলে এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটি বর্তমানে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
পুনরায় স্মৃতিতে ঢাকা কলেজে ফিরে যাব। ১৭ ডিসেম্বর মহাউল্লাসে আমরা শিক্ষক লাউঞ্জে সমবেত হই এবং ১৮ তারিখে ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের এক জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। এ সভার আয়োজনে ইংরেজি বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক মো. হারুন-উর রশিদ (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) বিশেষভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সক্রিয় প্রচেষ্টায় অধিকাংশ শিক্ষক সভায় উপস্থিত ছিলেন। অধ্যক্ষ মহোদয় সভা শুরু হওয়ার পূর্বেই হাজির। তার কৃত্রিম হাসি এবং নিজেকে প্রফুল্ল দেখানোর চেষ্টা উপস্থিত শিক্ষকদের তীক্ষষ্ট দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পারেনি। প্রথমেই মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা, এ দেশের সংগ্রামী জনতা, নিবেদিতপ্রাণ মিত্রবাহিনী এবং বন্ধুদেশগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অধ্যাপক হারুন-উর রশিদ সভার সূচনা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অধ্যক্ষের বাংলাদেশ বিরোধিতার চিত্র তুলে ধরেন। মাঝেমধ্যে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। তার মর্মস্পর্শী বক্তব্য শেষ হলে অধ্যক্ষ সাহেব নিজের বক্তব্য তথা সাফাই দিতে শুরু করলেন এবং স্বমূর্তি ধারণ করে হারুন সাহেবের ওপর দোষারোপ করতে লাগলেন। তার সাফাই-সংগীতের পর প্রবীণদের বক্তব্য প্রত্যাশিত ছিল। তারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। প্রায় ৩০ সেকেন্ডের মতো অতিক্রান্ত হলে কৃষকায় এক নবীন প্রভাষক (পরে তিনি জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন) মিনিট দশেক বক্তৃতা করলেন- অত্যন্ত সহজ-সরল কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে। তিনি সভাপতি মহোদয়কে সম্বোধন করে অধ্যক্ষ সাহেবের চোখে চোখ রেখে বললেন, "আপনার নির্লজ্জ দুঃসাহস আমাদের হতবাক করছে। বিগত কয়েক মাস আপনি যা করেছেন, তা অমার্জনীয়। আপনি আমাদের হাতে মারেননি বটে, কথায় মেরেছেন। আপনার অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে হবে, আমাদের জানা নেই। তবে ঢাকা কলেজ-চত্বরে আপনার স্থান হবে না। এ সভা থেকে ঢাকা কলেজে আপনাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো। আজকেই আপনাকে কলেজ ছেড়ে যেতে হবে- আপনি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকবেন।" বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রওশন আরা রহমানের মার্জিত ভাষায় অধ্যাপক হারুন ও ঠোঁটকাটা প্রভাষকের বক্তব্য সমর্থন করে বক্তৃতার পর কয়েকজন বক্তা একই ধারায় কথা বললেন। অতঃপর, অধ্যক্ষের বিদায় এবং তার জায়গায় এলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মো. নোমান। সভার পরদিন ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সেই কৃশকায় প্রভাষকের উদ্দেশে স্মিতহাস্যে বললেন, 'এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়!'
বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। দেশ বিধ্বস্ত, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্ন। একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর আপ্রাণ প্রচেষ্টা। স্বাভাবিক কারণেই সদ্য স্বাধীন দেশ কিছুটা অরাজকতার সম্মুখীন। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত তখনও থেমে নেই। যুদ্ধজয়ী বেকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজবিরোধীদের হাতেও রয়েছে অস্ত্র এবং সেগুলোর অনভিপ্রেত ব্যবহার হচ্ছে। প্রশাসন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অভিমত, 'ক্রান্তিকালে এমন অঘটন অস্বাভাবিক নয়। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এখন প্রকাশ্য শত্রু নেই, কিন্তু তাদের হাতে অস্ত্র আছে। সব মুক্তিযোদ্ধার মনমানসিকতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি এক নয়। আদর্শিক অনৈক্য তো রয়েছেই। বর্তমান চিত্র তারই প্রতিফলন।' ড. আহমদ শরীফের ভাষ্য, 'অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত, যোগাযোগ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত। এগুলো তেমন কিছু নয়। সবচেয়ে ভয়ংকর আমাদের তরুণ সমাজের চারিত্রিক অবক্ষয়। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলেও যে মানসিক-চারিত্রিক-সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে, সেটা পূরণ হতে সময় লাগবে।'
বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হৃদয় এবং দেশ গড়ার কারিগর তাজউদ্দীন আহমদের মস্তিস্কের সম্মিলনে দেশ যখন অগ্রগতির মুখে, তখনই ঘটল চরম বিপর্যয় বাঙালি জাতির। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, উচ্চাভিলাষী সেনাবাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট দুর্বৃত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। এই আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর আস্তিনে লুকিয়ে থাকা কালসাপ খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ। পরে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ঘাতক কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুকের বক্তব্যে এই ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের সম্মতি ও সম্পৃক্তির কথা উঠে আসে- এটি প্রমাণসাপেক্ষ হলেও জিয়া ও তার পরিবারের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে এর সমর্থন মেলে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যাতে ভবিষ্যতে বিচারের সম্মুখীন হতে না হয়, এ জন্য তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে খন্দকার মোশতাক 'ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স' বা দায়মুক্তি আইন করেন। জিয়াউর রহমান এই খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। ৩ নভেম্বর, '৭৫-এ ক্ষমতাচ্যুতির পূর্বে মোশতাকের নির্দেশে ১৫ আগস্টের কুশীলবরা ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গ্রথিত এবং উদ্দেশ্যও ছিল অভিন্ন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের শাসনভার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
আমরা জানি, পিতা-মাতা-ভ্রাতা-স্বজন হারানোর বেদনা কত মর্মান্তিক, দুঃসহ। রক্ত বিভাজন সম্ভব কিনা, সেটা বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। আর এ দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক আত্মিক এবং আত্মা অবিভাজ্য।
আদর্শলিপির দুটো বাক্য যুগোপযোগী না হলেও ভুলতে পারি না- 'সদা সত্য কথা বলিবে, অপ্রিয় সত্য যথাসম্ভব বর্জন করিবে।' জীবনের উপান্তে এসে উপলব্ধি করছি, ঝুঁকি নিয়েও সমাজ ও দেশের মঙ্গলের জন্য অপ্রিয় সত্য বলা আবশ্যিক।
গণতন্ত্রের বরপুত্র বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল এবং সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ১৯৭২ সালের সংবিধান কোনোরকম সংশোধনী ব্যতীত পুনর্বহাল করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে আত্মীয়করণ অবশ্যই পরিহার্য। সর্বোপরি জনসাধারণের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। বিগত কয়েকটি উপনির্বাচন এবং সিটি করপোরেশনগুলোতে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে আবারও যদি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ওঠে, সেটা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হবে না।
মন্তব্য করুন