১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৪ বছর। কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের খবর পরদিন যখন জানতে পারলাম, ভেতরে তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকলাম।

এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গ্রামে গ্রামে নির্যাতন চালাতে শুরু করে তখন অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। অবশ্য আমাদের গ্রাম মহিষমুন্ডার অবস্থান বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল বলে তখন পর্যন্ত সেখানে পাকিস্তানি হানাদাররা পৌঁছাতে পারেনি। তবুও বসে থাকিনি। দূর গ্রামের যে সব লোকজন ভারতে যাচ্ছিলেন তাদের সঙ্গে যোগ দিই এবং জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের ওপর দিয়ে মঙ্গলবাড়ি হয়ে হেঁটে ভারতে প্রবেশ করি। প্রথমে আমাদের ঠাঁই হয় কামারপাড়া ক্যাম্পে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিরামপুর ক্যাম্পে। সেখানে মুক্তিকামী শত শত কিশোর আর যুবকের দেখা পেলাম। তবে পরিচিতদের মধ্যে শুধু আমাদের পার্শ্ববর্তী ঊনাহত সিংড়া গ্রামের লোকমান হোসেনের দেখা পেলাম।

ক্যাম্পগুলো থেকে কাদের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে সেটির সিলেকশনের দায়িত্বে ছিলেন আ স ম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজ (প্রয়াত)। ক্যাম্পে কয়েকদিন থাকার পর ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের পাঠানো হলো আসামের হাফলং এলাকায়। সেখানে ট্রেনিং শেষে বিপুল সংখ্যক স্টেনগান ও গ্রেনেড দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অক্টোবরের প্রথম দিকে আমাদের ২৫ জনের একটি দলকে দেশে পাঠানো হলো। আমরা ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলেও ভারী অস্ত্র নিয়ে দিনের বেলা চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শুধু রাতের বেলা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আসতাম। এভাবে তিন রাত হাঁটার পর এক সময় দুপচাঁচিয়ার তালোড়া এলাকার বেলঘরিয়া গ্রামে মুজিব বাহিনীর বৃহত্তর বগুড়ার কমান্ডার এবিএম শাহজাহানের (প্রয়াত) বাড়িতে যাই। তবে আমাদের অবস্থানের খবর পাকিস্তানি হানাদাররা জেনে যাওয়ায় এক রাতে তারা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরাও অস্ত্র হাতে জবাব দিতে শুরু করি। দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু সময় গুলিবিনিময় চলে। তবে কৌশলগত কারণে আমরা পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে পিছু হটে পাশের গ্রামে চলে যাই। তারপর আমরা দুপচাঁচিয়া ও কাহালু এলাকা হানাদারমুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করি।

মুজিব বাহিনীর বগুড়া অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন দুপচাঁচিয়ার তালোড়ার এবিএম শাহজাহান ভাই। তিনিই আমাদের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন, আর তার ডেপুটি ছিলেন পাশের কাহালু উপজেলার হোসেন আলী ভাই। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। এক সময় বেড়ে তা ৮৫ জনে উন্নীত হয়। সহযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মনোবলও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আমরা অক্টোবর মাসেই স্থানীয় কড়িমামুজা এলাকায় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করি। এরপর কাহালুর পাঁচপীর মাজার সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিই। ওই সময় ব্রিজের পাহারায় নিয়োজিত রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করা হয়েছিল। অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে ক্যাম্পে থাকা রাজাকাররা টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। একইভাবে শিকড় গ্রামেও আমরা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি।তবে বড় লড়াইটা হয়েছিল দুপচাঁচিয়া থানা আক্রমণকালে। সেদিন ছিল ৯ নভেম্বর। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে এবিএম শাহজাহান ও হোসেন আলী ভাইয়ের নেতৃত্বে আমিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল এক বাহিনী প্রস্তুত। আমরা দুপচাঁচিয়া-তালোড়া সড়কের পাশে অ্যাম্বুশ করি। সেখান থেকে সেনা আর রাজাকারদের টহল দেখা যাচ্ছিল।

এক সময় শত্রুরা রেঞ্জের ভেতর চলে আসে। আমাদের কমান্ডার 'ফায়ার' বলতেই আমরা সবাই একসঙ্গে থানা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করি। শত্রুপক্ষও পাল্টা গুলি বর্ষণ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা আমাদের লক্ষ্য করে শেল মারতে শুরু করে। কয়েকটি শেল এসে আমাদের ওপর পড়ে। একটি শেলের আঘাতে আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল আর ডান পায়ের হাঁটুর নিচে জখম হয়। ওই অবস্থায় আমি মহিষমুন্ডায় নিজ গ্রামে ফিরে যাই। সেখানেই কয়েকদিন চিকিৎসা চলে। কিছুদিন পর আমি সুস্থ হয়ে যাই, আর ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীও আত্মসমর্পণ করে।

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবিএম শাহজাহান ভাইয়ের নির্দেশে তার নিজ এলাকা তালোড়ায় যাই এবং সেখানকার মুক্তিকালীন ক্যাম্পে সমবেত হই। তারপর সেখান থেকে একদিন বগুড়ায় গিয়ে বাসভাড়া করে ঢাকায় গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করি।

সম্মুখযুদ্ধে আমি ছাড়াও আমাদের দলের আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন। অন্যরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। কারণ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যে আবেদন করতে হয় সেটি তাদের জানা ছিল না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার এবিএম শাহজাহান এবং ডেপুটি কমান্ডার হোসেন আলী ভাইসহ অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে আমরা যারা জীবিত আছি তারাসহ পুরো জাতি তাদের অবদান চিরদিন স্মরণ রাখবে। া

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা


অনুলিখন :: মোহন আখন্দ
ব্যুরো প্রধান, বগুড়া ব্যুরো

বিষয় : দুপচাঁচিয়া থানায় আক্রমণ করি

মন্তব্য করুন