
৭০ সালে নির্বাচন এবং আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির সময় স্কুলে লেখাপড়া অবস্থাতেই ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পরপর বুঝতে পারি যুদ্ধ আসন্ন। মনে মনে আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের খবর শোনার পর সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। আমরা ৩০-৩৫ জন বন্ধু মিলে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যাই ওপার বাংলায়। ভারত সীমান্তে টানা ১৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে সমন্বিতভাবে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের এবং কোম্পানি কমান্ডার রফিজ উদ্দিন রাফিজের নেতৃত্বে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পাই। জামালপুর, শেরপুর, বকশিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পিয়ারপুরসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো শত্রুমুক্ত করার এরিয়া নির্ণয় করে দেন সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের। আগস্টের পর ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন কর্নেল হামিদুল্লাহ খান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেই সব দিনের প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। এক বেলা খেয়ে দু'বেলা না খেয়ে কখনও পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে কখনও অন্যের বাড়িতে রাত কাটিয়ে যুদ্ধ করেছি। আমি মোট ছয়টি গেরিলা অপারেশনের সক্রিয় সম্মুখযোদ্ধা ছিলাম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে সংঘটিত হওয়া ১৪ নভেম্বরের মাঝরাতে জামালপুর ফেরিঘাটে পাকিস্তানিদের গোলাবারুদ ও রসদ বয়ে নিয়ে যাওয়া দুটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেওয়ার শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশন। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টারশেলের আঘাতে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাই।
ধানোয়া কামালপুরে মিলিটারিদের বড় একটি ক্যাম্প ছিল। রাত ২টায় খবর আসে, ওরা জামালপুরের ফেরিঘাট হয়ে দুটি লঞ্চে গোলাবারুদসহ প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে শেরপুর দিয়ে বকশিগঞ্জে যাবে। খবর পেয়ে আমরা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কমান্ডারের নির্দেশে ঘাটের পাশে পজিশন নিই। হানাদার বাহিনী যখন লঞ্চ নিয়ে ঘাট অতিক্রম করা শুরু করে তখন কমান্ডার তার স্টেনগানের ট্রিগার চাপলেন, আমরাও গুলি করা শুরু করি। মিলিটারিদের লঞ্চের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চার্জলাইটটা তখন ঘুরে ঘুরে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানছিল, আর সেই মোতাবেক তারা গুলি করছিল। হঠাৎ আলোটা আমার পাশে এক সহযোদ্ধার ওপর গিয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে গুলির আঘাতে মুহূর্তেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় সে। এই অবস্থায় নিলডাউন পজিশনে চলে যাই আমি এবং হাতে থাকা থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে থাকি। এমন সময় আমার অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে লঞ্চ থেকে, ওই শেলের আঘাতে উড়ে যায় আমার ডান হাত ও ডান পা। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জানতে পারি বন্ধুরা আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। সেদিন হানাদারদের দুটো লঞ্চই ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের দলের পাঁচ মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৫ জন দেশি এবং ভারতীয় সৈনিক নিহত হয়।
আমি যুদ্ধে গেছি, এমন খবর মালোপাড়ায় ছড়িয়ে পড়লে মিলিটারিরা হামলা করে প্রায় পুরো গ্রামে অগ্নিসংযোগ এবং অসংখ্য মা-বোনকে নির্যাতন করে। নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদারমুক্ত হতে থাকে। দিকে দিকে বিজয়ের পতাকা উড়তে থাকল। যুদ্ধ শেষে বেশ কিছুদিন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম আমিসহ অনেকে। সেখানে আমাদের দেখতে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তোমরা যা হারিয়েছ হয়তো তা আমি দিতে পারব না। আজও আমার কানে বেজে উঠে বঙ্গবন্ধুর সেই কথা। পরবর্তী সময়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসি নিজ গ্রামে।
আমার দেখভাল করার জন্য বাবা-মা পাশের গ্রামের কৃষ্ণা রানীর সঙ্গে বিয়ে দেন আমাকে। আমার স্ত্রীর বয়স ছিল তখন ১৪ বছর। দেশ বাঁচানোর অসম সংগ্রাম শেষে শুরু হয় আমার নতুন এক জীবন সংগ্রাম। সংসারের খরচ চালাতে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি, আজও এভাবেই পড়িয়ে যেতে হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর প্রাইভেট পড়ানোর সামান্য টাকায় অভাবের সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে পাঁচজনের সংসার প্রায় একাই চালাতে হচ্ছে। আমার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এখনও পাইনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ ট্রাস্টে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আবেদন জমা দিয়েছি। তবে এই ভাতা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট অফিসে ঘুষ না দিলে টাকার ব্যবস্থা হবে না বলে জানানো হয়েছে আমাকে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা অনুলিখন :: কবীর উদ্দিন সরকার হারুন, ফুলবাড়িয়া প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন