
দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১৯৭১ সাল। মাস মনে নেই, তবে এটা মনে আছে- যুদ্ধ শুরু হয়েছে দুই-তিন মাস। মঙ্গলবার মনে আছে এ কারণে যে, আমাদের এলাকায় সপ্তাহে দুই দিন হাট বসতো, শনিবার আর মঙ্গলবার, এ কারণে মনে আছে। আর ১৯৭১ সাল বাঙালির জীবনে যেমন আনন্দের; আবার আমার মতো লক্ষ মানুষের জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়। সেই যে অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গিয়েছে জীবন, আর এই সুন্দর পৃথিবীর আলোর সন্ধান মেলেনি।
১৯৭১ সাল। যৌবনে পা দিয়েছি সবেমাত্র। পৃথিবীটা যত না সুন্দর, মধুময় ও আনন্দের- আমার চোখে তার চেয়ে অনেক সুন্দর। দিন-রাত বলে কথা নেই, চোখ ভরে থাকে স্বপ্ন দিয়ে। বাহ! জীবন, পৃথিবী এত সুন্দর, এক সময় ইচ্ছে জাগতে থাকে, পৃথিবী জয় করব। যদিও কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। তাতে কি? স্বপ্ন দেখা যাবে না?
আমরা চার বোন, কোনো ভাই নেই। আমি মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। আমার বড় দিদি আছে একজন। আর দুই বোন আমার ছোট। বাবা দোকানদারি করতেন। মোটামুটি ভালোই ছিলাম। দিদির বিয়ে পাকা হয়ে গিয়েছিল। এরই মাঝে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের শুরু থেকেই আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি আর্মিরা এসে গ্রামে ক্যাম্প করে ফেলে। তখন থেকেই আমরা প্রতিদিন পালিয়ে থাকতাম। এরই মাঝে একদিন আমাদের গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিন আমাদের গ্রাম থেকে অনেক লোক ধরে নিয়ে যায়। পরদিন লোকে বলাবলি করতে থাকে পুরুষদের গুলি করে মেরে ফেলেছে। আর নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রেখেছে। প্রথম দিনই আমাদের এলাকায় হানা দেয় আর্মিরা, কারণ আমাদের এলাকাটা ছিল হিন্দু এলাকা। দিন দিন অন্যায়, অত্যাচার বাড়ছে। এক সময় এমন একটা পর্যায় চলে আসে যে, গ্রামে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতিই নেই। পালিয়ে থাকার মতোও আর পরিবেশ ছিল না। তাই আস্তে আস্তে গ্রাম ছাড়তে থাকে লোকজন।
একসময় বাবা আর কাকারা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারত চলে যাওয়ার। আমরা রওনাও দিয়েছিলাম ভারতের উদ্দেশে। দুই রাত ও এক দিন হাঁটার পর আমরা সবাই ধরা পড়ি আর্মিদের হাতে। আমাদের চোখের সামনে বাবা, দুই কাকা, এক কাকার দুই ছেলে আর ঠাকুরমাকে গুলি করে মেরে ফেলে এবং মা, আমার চার বোন ও দুই কাকিমাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। তখন আমার বড় দিদির বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। আর আমার ১৬-১৭ বছর। ছোট বোনটার বয়স তখন ১৫-১৬ বছর। একেবারে ছোট বোনটার বয়স ছিল ১৩ বছর। বড় বোনের নাম কাঞ্চন, আমার নাম শেফালি, তার পরের বোনের নাম সন্ধ্যা, একেবারে ছোট বোনের নাম ললিতা। মায়ের নাম ছিল আরতী। এলাকার নাম, বাবার নাম বলতে চাই না।
প্রথম দিন আমাদের সবাইকে কাছাকাছি একটা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ছোট একটা ঘরের ভেতরে কমপক্ষে একশ নারী গাদাগাদি করে আছে। তাদের সঙ্গে আমাদেরও রেখেছে। বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোর অবস্থাও নেই। তাই একজনের ওপর আরেকজন, এমন করে পড়ে আছি সবাই। যেখানে দশ-বারোজন থাকার মতো ঘর, সেখানে একশর ওপরে মানুষ। এটা একটা বিরাট কষ্টের বিষয়। সবাই ভয়ে কাঁপছে। কারও শ্বাসের শব্দ হচ্ছে না।
সন্ধ্যা হতে না হতেই আর্মিদের গাড়ি একটার পর একটা এসে থামছে। আর তারা নেমে আসছে। মনে হয় কয়েকশ আর্মি এসে নেমেছে। তখন রাত নয়টা কি দশটা বাজে। আর্মিরা এসে টানাটানি করে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেল, একেক জনকে একেক জায়গায় এবং রাতভর আমাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন করে। ভোর হয় হয়, এমন সময় আবার ওই ঘরের ভেতরে এনে ফেলে রেখে যায়। মনে হচ্ছে ময়লা ফেলছে।
দশটার দিকে এসে আবার আমাদের ঘর থেকে বের করে। প্রথমে মাকে বের করে। তখন আমি মায়ের হাতটা ধরি আর আমার হাতটা ধরে আমার ছোট বোন। এই তিনজনকেই ধরে টেনে টেনে গাড়িতে তোলে। তখন আমরা ভেবেছিলাম আমাদের বুঝি মেরে ফেলবে, তাই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না আমাদের অন্য একটা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের আবার আটকে রাখে। ওই ক্যাম্পটা মোটামুটি একটু বড় ছিল। ওই ক্যাম্পে ঘর ছিল একটা এবং মাঝখানটা ছিল উঠানের মতো। অনেক উঁচু করে দেয়াল দেওয়া, বাইরের কিছুই দেখা যেত না, বড় বড় গাছের ডাল আর পাতা ছাড়া। একটা গেট ছিল, সেই গেটে দিন-রাত সব সময় দুই-তিনজন করে আর্মি পাহারা দিত। এ জন্য সব সময় আমাদের একটা ঘরের ভেতর আটকে রাখেনি। বারান্দায় হাঁটা, চলাফেরা করতে পারতাম। খাবার দিত দুই বেলা। কী খাবার দিত তা তেমন একটা মনে নেই। রুটির সঙ্গে হাবিজাবি দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই ক্যাম্পেই রেখেছিল। সারা রাতই খুব বিশ্রী ও নির্মমভাবে নির্যাতন করত। এসব কথা তো আর মুখে বলে বুঝাতে পারব না। আর না দেখলে কেউ বিশ্বাসও করতে পারবে না যে, এত বিশ্রীভাবে নির্যাতন করতে পারে। ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়ে দিয়ে নির্যাতন করেছে।
প্রায়ই দেখতাম যখন আর্মিরা সন্ধ্যা বা রাতে ফিরে আসত, তখন সঙ্গে করে কয়েকজন লোককে ধরে নিয়ে আসত। নারীদেরই আনতো বেশি। পুরুষদেরও ধরে আনতো। একদিন সন্ধ্যার দিকে দেখি পাঁচ বা সাতজন ছেলে, ছেলে বলছি এই কারণে যে, বয়সটা তাদের ছিল খুবই কম। ১৫ কি ১৬ বছর হবে। তাদের প্রত্যেকের হাত-চোখ বাঁধা ছিল। তাদের এনে আবর্জনার মতো ফেলে দিল। ফেলে তাদের পা বেঁধে বারান্দায় রেখে দিয়েছে। আর তিনজন মেয়ে ছিল সঙ্গে। তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মেয়েদের বয়স ছিল খুবই কম। রাতভর তারা আমাদের নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছে বেশ ফুরফুরে মেজাজে। সূর্যের আলোর তেজ যেমন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, ঠিক তেমনি আর্মিদের মেজাজও বাড়তে থাকে। তারা যে কতটা খারাপ হতে পারে একটু বলি-
সেই ছেলেদের মাঝ থেকে দু'জন ছেলেকে ধরে একটা ঘরের ভেতর নিয়ে যায় এবং আমাদের মাঝ থেকে কয়েকজনকে নিয়ে যায় ওই ঘরের ভেতরে। তারপর আর্মিরা তাদের নিজের হাতেই ছেলে দু'জনের শরীর থেকে সব কাপড় খুলে ফেলে এবং ছেলেদের বলে, আমাদের নির্যাতন করতে। আমাদেরও তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলে দু'জন কিছুতেই রাজি হয় না। রাজি না হওয়ায় আর্মিরা ছেলেদের সহযোগিতা করে। কিন্তু কিছুতেই ছেলেরা পারছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে যখন দেখছে পারছে না, তখন আর্মিরা তাদের নিজেদের কাপড় খুলে ছেলেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এক এক করে বেশ কয়েকজন আর্মি ছেলেদের নির্যাতন করে অনেকক্ষণ ধরে। তাদের অবস্থা যখন আধমরার মতো, তখন আর্মিরা তাদের ছেড়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন আর্মি আবার তাদের ঘরের ভেতরে ঢোকে এবং আমাদের বের করে দেয়।
মনে হয় কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল তাদের। তারা শুধু উত্তর দিয়েছিল, আমরা জানি না। তখনই তাদের মারতো। আর তাদের চিৎকারে মনে হতো আসমান জমিন এক হয়ে যাচ্ছে। তাদের চিৎকার শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠত, এমন কষ্ট দিয়েছিল তাদের।
অনেকক্ষণ পর একজনকে পা ধরে টেনে বের করে অন্যদের কাছে ফেলে দেয়। তারপর একসঙ্গে তাদের চার-পাঁচদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে আর ধাপে ধাপে মারে। মারার ধরন ছিল খুবই নির্মম ও নিষ্ঠুর। তাদের চিৎকারে মনে হয় আসমান-জমিন এক হয়ে গিয়েছিল। এই চার-পাঁচ দিন তাদের কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি। জল জল করে চিৎকার করলে মাঝে মাঝে কেউ দিত, কেউ দিত না। একসময় তারা আর কোনো চিৎকার করতে পারত না। এমনকি নড়াচড়াও করত না। তাদের মধ্য থেকে দু'জনকে গুলি করে মেরে ফেলে। গুলিটা করেছিল তাদের পায়খানার রাস্তার ভেতরে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে। এমন কত রকম ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা। এমন সব ঘটনা এত কাছ থেকে দেখে স্থির থাকা যায় না। তারপর নিজেদের ওপর তো আছেই নিষ্ঠুর ও নির্মম নির্যাতন। আহা! কী কঠিন জীবন।
কত লজ্জার, দুঃখের, কষ্টের, বলতে ও শুনতে। মা ও মেয়েদের একসঙ্গে একই পুরুষে কীভাবে নির্যাতন করত। না পারি বলতে, না পারি সইতে। সবই দেখেছি, সবই শুনেছি। কিন্তু কিছুই বলার ছিল না। শেষের দিকে মনকে বলতাম মন শান্তিতে থাক। চোখ, এসব দেখিস না। কান, কিছুই শুনিস না। কতক্ষণ সহ্য করা যায়। একদিন নয় দু'দিন নয়, প্রায় সাত আট মাস টানা বন্দি জীবন। দিন-রাত কত আর্মি যে এই শরীরের ওপর কত রকম অত্যাচার করেছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। আর সব সময় সব কিছু বলাও যায় না।
বন্দি থাকতে থাকতে এক সময় ধরেই নিয়েছিলাম, জীবদ্দশায় আর কোনো দিন এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখতে পারব না, পারব না বাঁচতে। এখানেই মরতে হবে। কথা হলো- কীভাবে মৃত্যু হবে, এই নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কারণ, নিত্যদিন চোখের সামনে দেখছি, কত রকম কষ্ট দিয়ে মারছে। আমাদেরও তো এভাবেই মৃত্যু হবে।
একসময় দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন মুক্তিবাহিনী এসে আমাদের বলে, তোমাদের ছুটি। তোমরা এখন থেকে মুক্ত। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তখন আমরা পাগলের মতো ছুটতে থাকি। মা-মেয়েরা আবার বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি ফিরে এসে দেখি, আমাদের বাড়ির আর কোনো অস্তিত্বই নেই। ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই, খাঁ খাঁ করছে ভিটা। আমরা পোড়া ভিটায় বসে কাঁদছি। কিছুক্ষণ পর দেখি দলে দলে লোক আসছে আমাদের গ্রাম থেকে, আমাদের দেখতে। সবার এমন একটা ভাব যে, আমরা অন্য কোনো জগৎ থেকে এসেছি। চারদিক থেকে মানুষ আমাদের যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছে। সব ফেলে কত জায়গায় গিয়ে আশ্রয় চেয়েছিলাম; কিন্তু কোথাও কোনো আশ্রয় মেলেনি। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা জায়গা ছিল, সেখানে একটা ঘর ছিল, সেই ঘরের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তখন রাত হয়ে যায়। মা বলে- রাতটা কোনো রকমে এখানে পার করব। সকাল হলে একটা কিছু করব।
আমাদের আর আশ্রয় খুঁজে বের করতে হয়নি। গ্রামবাসীই আমাদের শেষ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। সেই আশ্রয়ের জায়গাটা হলো পতিতালয়। আমরা মা-মেয়েরা পতিতালয়েই জীবন পার করে দিলাম।
ভিন দেশি সৈন্যরা এসে জোর করে ধরে নিয়ে আটকে রেখে আমাদের ব্যবহার করেছে তাদের ইচ্ছা মতো। আর আমার স্বাধীন দেশের মানুষরা সারা জীবনের জন্য এমন একটা জায়গায় ঠেলে দিল, যেখান থেকে আর কোনো দিন ফিরে স্বাধীন দেশের মুক্ত হাওয়া, বাতাস খেতে পারিনি। এই সুন্দর পৃথিবীর মাঝে প্রাণ খুলে মুখে হাসি নিয়ে সমাজের মাঝে যেতে পারিনি। হয়ে গেলাম অন্ধকার জগতের মানুষ। এই অন্ধকার জগতে থেকে পচে মরেছে মা। এখন আমাদেরও মরার সময় হয়েছে। কিন্তু আলোতে যেতে পারিনি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন