
মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়সে ছিলাম বেশ তরুণ। ২৫ মার্চ ঢাকায় আক্রমণের মাধ্যমে যে যুদ্ধের সূচনা হয়, ধীরে ধীরে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যশোরও বাদ যায় না সেই তালিকা থেকে। নিজ গ্রাম যশোর সদর উপজেলার নারাঙ্গালি থেকে ১৯ মে ভারতের বনগাঁর শিমুলতলা স্কুলমাঠে গিয়ে ভর্তি হই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও ইপিআর জওয়ানরা ভারতের বিশাল আমবাগানে একটি বড় ক্যাম্পে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণে ব্যবহূত অস্ত্র যশোর সেনানিবাস ও ইপিআর ক্যাম্প থেকে নিয়ে সৈনিকরা ভারতে গিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণের মাত্র ১০ দিনের মাথায় ২৯ মে সাতক্ষীরার ভোমরায় আমরা ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন ও এসপি মাহবুবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। এ যুদ্ধে জীবিত অবস্থায় একজন পাকিস্তানি সেনাসহ ১৫০টি অস্ত্র উদ্ধার করি আমরা। ২৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে সাড়ে তিনশ পাকিস্তানি সেনা খতম হয়। এই যুদ্ধে শহীদ হন তিনজন সহযোদ্ধা। এটাই ছিল আমার অংশ নেওয়া প্রথম যুদ্ধ।
এরপর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে হাকিমপুর ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে প্রতিরাতে অপারেশনে অংশ নিয়েছি কাকডাঙ্গা, তলইগাছি ও হিজলদিহির পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও ছাউনিতে। দেড় মাস সেখানে অবস্থানের পর কল্যাণী হয়ে বিহারের চাকুলিয়ায় যাই। সেখানে ২৯ দিন ট্রেনিং শেষে ফিরে আসি পেট্রাপোল ক্যাম্পে কমান্ডার গোলাম মোস্তফার অধীনে। এখানে শিকড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। এ অপারেশনে সহযোদ্ধা রুস্তম আলী শহীদ হন।
এগুলো বড় অপারেশন হলেও আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা গরীবপুরের সম্মুখযুদ্ধ। জুলাইয়ের শেষদিক। মাঠজুড়ে পাট আর আধাপাকা ধান। মিত্র বাহিনীর রেজিমেন্ট প্রধান মেজর খাজুরিয়া সিংয়ের নেতৃত্বে ১৫টি ট্যাঙ্ক নিয়ে ভারতের বয়রা ক্যাম্প থেকে আমাদের একটি দল সোজা ঢুকে পড়ি যশোরের চৌগাছায়। আমাদের টার্গেট ছিল গরীবপুর ও ফুলসারায় (চৌগাছার দুটি গ্রাম) হানাদারদের আস্তানা। আমাদের বিশাল বহর কাবিলপুর, ধুলিয়ানি ও গরীবপুর মাঠ দিয়ে বাড়ীয়ালী কাঁঠালবাগানে এসে পৌঁছায় সকাল ১১টার দিকে। দুরবিনের সাহায্যে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান নিশ্চিত হতেই শুরু হলো আক্রমণ। ১৭টি ট্যাঙ্কসহ আরও সাঁজোয়া যান নিয়ে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করল হানাদাররাও। এভাবে তুমুল যুদ্ধ চলল তিন ঘণ্টারও বেশি। ওই যুদ্ধে শত্রুসেনার সেলের আঘাতে আহত হলেও পিছিয়ে যাইনি; বরং যুদ্ধজয়ের জিদ এতটাই প্রবল ছিল যে, সামনে এগোনো ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কথা মাথায় ছিল না। কেননা আমাদের সবার মধ্যেও একই জিদ কাজ করছিল। একপর্যায়ে শত্রুপক্ষের পাঁচটি ট্যাঙ্ক অকেজো ও সাতটি ট্যাঙ্ক আমাদের দখলে চলে এলে বাকি পাঁচটি ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পরে আহত অবস্থাতেই আরও কয়েকটি বড় অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। ভারতের পেট্রাপোল থেকে মেজর এমএ মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন নাজমূল হুদা আমাকে বয়রা নিয়ে আসেন। সেখান থেকে যশোরের চৌগাছা গরীবপুরে ঢুকে দু'জন পাকিস্তানি সেনাকে মেরে তাদের মরদেহ ক্যাম্পে নিয়ে যাই। সেদিন আমার অগ্রণী ভূমিকার কারণে পরের বৃহৎ অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গরীবপুর মাঠের ওই সফল সম্মুখযুদ্ধের পর সুযোগ আসে ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ) গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করার। গরীবপুর যুদ্ধে আহত হওয়ায় আমাকে বনগাঁ ক্যাম্পে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পুরো সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই আবার রণাঙ্গনে ফিরে আসি। এফএফ গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে বুড়িন্দিয়া, চৌগাছা, কায়েমকোলা, কাশিপুর ও বর্ণি পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্পে অপারেশনে যাই ২১ সহযোদ্ধাকে নিয়ে। চৌগাছার পাতিবিলায় একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে পাইলট ইস্কেখার আহমদ প্যারাসুটে নেমে আসে। মেজর মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন হুদা তাকে আত্মসমর্পণ করান। ওই সময় তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম।
পাকিস্তানি বাহিনী চৌগাছা যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে পেছাতে থাকে। মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন হুদা, লে. গুপ্ত ও ক্যাপ্টেন আসাদসহ অন্যদের নেতৃত্বে আমরা যশোর সেনানিবাসের দিকে এগোতে থাকি। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যেদিন যশোর মুক্ত হয় সেদিনও বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে ছিলাম। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ছেড়ে খুলনার শিরোমনিতে আশ্রয় নেয়। সেখানে সোনালি জুট মিলের সামনে তাদের আত্মসমর্পণ করিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা
অনুলিখন :: তৌহিদুর রহমান, যশোর প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন