বাংলাদেশের ‘পুস্তকবিহীন’ ধর্ম

পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১২:৫১ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৩:১৭
মান্দিকুসুকে (মান্দিদের আচিক ভাষা) অরণ্যকে বলে ‘ব্রিং’। অরণ্যের বললে ‘ব্রিং’-এর সঙ্গে ‘নি’ যুক্ত হবে। ব্রিংনি মানে অরণ্যের। যেমন, ব্রিংনি বিবাল। মানে অরণ্যের ফুল। যেমন, গাজিনি সঙ মানে গাজির গ্রাম। গাজি মারাক নামে এক সাহসী মান্দি পুরুষের নামে বাংলাদেশের এক পাহাড়ি শালবনে এককালে গড়ে উঠেছিল এই মান্দি গ্রাম। নিদারুণভাবে গ্রামটি আর নেই। বাংলাদেশ বনবিভাগ এই জায়গা দখল গড়ে তুলেছে গজনী অবকাশ কেন্দ্র।
একবার ২০০০ সালের ডিসেম্বরে ক্ষয়িষ্ণু সেই শালবনে পরিচয় হয় এক প্রবীণ কোচ নারীর সঙ্গে। ঝরা শালপাতা কুড়িয়ে গ্রামে ফিরছিলেন তিনি। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের ভেতর এক উঁচু ভিটা দেখিয়ে জানান, এককালে এখানে কোচদের খাঙখাঙি পূজাস্থল ছিল। জানান, কেবল মান্দি নয়; এখানে কোচ ও হাজং বসতও ছিল এককালে। অরণ্যজুড়ে ছিল সকলেরই নানা পূজাস্থল। সকল পূজাস্থল হারিয়ে কোচ সমাজে এখন আর নিয়মিত খাঙখাঙি পূজা আয়োজন হয় না। খাঙখাঙি কোচ আদিবাসীদের এক নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের এক আরাধ্য দেবতা। খাঙখাঙির হারানো যন্ত্রণা নিয়ে দেশের, নানা প্রান্তে, নানা জাতির নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ও দর্শন বোঝার চেষ্টা করি। বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করি, বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছেন যাদের কোনো ধর্মপুস্তক নেই, অথচ হাজার বছর ধরে তারা নিজ নিজ নানা ধর্মবিশ্বাস জীবন্ত করে রেখেছেন। দেশে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, কিয়াং, গুরুদুয়ারা, আখড়া, ধামসহ নানা ধরনের স্থাপনা আছে। রাষ্ট্র এসকল ধর্মীয় স্থাপনার জন্য নানা সময়ে নানা বরাদ্দ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। কিন্তু পুস্তকবিহীন ধর্মের স্বীকৃতি দূরে থাক, রাষ্ট্র এসব ধর্মপালনকারীদের পূজাস্থলের জন্য কোনো সহযোগিতা বা বরাদ্দ দিতে উৎসাহী হয়নি কখনও। পুস্তকবিহীন ধর্মবিশ্বাসকারীদের পূজাস্থলগুলো সমসময় সর্বজনীন হয় এবং তা কোনো না কোনো প্রাকৃতিক বন, জলধারা বা বিশেষ বাস্তুসংস্থানে গড়ে ওঠে। কেবল ব্যক্তিপর্যায়ের সংঘাত বা দখল নয়, উন্নয়নের নামে রাষ্ট্র নিজেও নিদারুণভাবে পুস্তকবিহীন ধর্মবিশ্বাসীদের পবিত্র ধর্মস্থলগুলো নানা সময়ে চুরমার করে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
দেশজুড়ে নিরন্তর দখল ও ভাঙচুর হওয়া ধর্মস্থলের কোনো খবর দায়িত্বশীল ও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত আমাদের গণমাধ্যমগুলো এসব খবর প্রকাশ বা প্রচার থেকে বিরত থাকে। উত্তরবঙ্গজুড়ে প্রায়ই রাতবিরেতে সৗরি সারনা ধর্মপালনকারী সাঁওতালদের পবিত্র ধর্মস্থলগুলো ভেঙেচুরে দেয় কেউ, পার্বত্য চট্টগ্রামে দখল হয়ে যায় ম্রোদের ধর্মস্থল। আশ্চর্য রকমভাবে এসব অপরাধ বিচারহীনই থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু ২০১৮ সালে এক ‘অতি বিস্ময়কর’ ঘটনা ঘটে। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ৪নং ভানগাছি ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহযোগিতায় সাঁওতালদের একটি মৗঞ্জহিথান তৈরি হয়েছে। গ্রামবাসী একটি মৗঞ্জহিথানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করেন।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করে সরকার। গ্রামের রবি মার্ডী মৗঞ্জহি থানের জন্য প্রায় ২ শতক ভূমি দান করেন। ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই মৗঞ্জহিথান উদ্বোধন করেন। আশা জাগে মনে হয়তো রাষ্ট্র সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে জাহেরথান, দিশম জাহের, মৗঞ্জহিথানের জন্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। স্বপ্ন দেখি, টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের সাংসারেকদের জীবনধর্ম স্বীকৃতি পাবে। স্বপ্ন দেখি, দেশের সকল প্রান্তের আদিবাসীসহ পুস্তকবিহীন ঐতিহ্যগত ধর্মপালনকারীদের দর্শন ও কৃত্য পালনে রাষ্ট্র সকলের জন্য সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। পুস্তককেন্দ্রিক ধর্মদর্শনের বাইরেও দেশে পুস্তকবিহীন বহু ধর্মমত ও দর্শনধারা আছে। আশা করি, রাষ্ট্র দেশের সকল পুস্তকবিহীন ধর্মের স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও বিকাশে সাহসী হবে।
পুস্তকবিহীন ধর্মের কি ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ নেই!
দেশের এক অনন্য জলপ্রপাত মৌলভীবাজারের বড়লেখার মাধবকুণ্ড। জলপ্রপাত ও জংগল ঘিরে আদিবাসী খাসিদের জীবন। খাসি আদিবাসীদের মোট জনসংখ্যার প্রধান অংশটাই আজ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী হলেও আদি খাসি ধর্মধারা জেন্টিল কি ছোনং বিশ্বাস নিয়ে অনেকেই জীপনযাপন করছেন। জেন্টিল বিশ্বাস মতে, উব্লাউ নংবউ নংথাউ বা উপ্রাই নংথিয়া নংথাউ দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। জেন্টিলদের ভেতর বে-ডেইংখ্লাম, লককী রিইম, উপ্রাই সিয়েম সিনসার, উপ্রাই নংগুপ পথেই, উপ্রাই সিয়েম উম, উপ্রাই সিয়েম খ্লাউ, রিইম রাখাল, কিন্ন্যা খ্লাউ, থাউ রিইম, কিন্ন্যা থাউকি থাউকান নামের নানা ধর্মীয় কৃত্য পালিত হয়। মাধবকুণ্ড জলধারার চারপাশজুড়ে একসময় জেন্টিল খাসিদের কিছু ‘থাউ কিন্ন্যা বা থাউ রিইম (ধর্মীয় পবিত্র স্থান)’ ছিল। এমনকি সনাতুনপুর মণিপুরিপাড়ার মৈতৈ মণিপুরিদের ‘চিঙ্গিলাই’ নামেও একটি ধর্মীয়স্থল ছিল মাধবকুণ্ড ঝরনর পাশে জংগলের ভেতর। মাধবকুণ্ড এলাকাটি বনবিভাগের অধীনে আসার পর এসব পবিত্র ধর্মীয় স্থানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পরে লাইফ নামের একটি কারখানা বাণিজ্যিকভাবে জলপ্রপাতের পানি বিক্রি করেছে, বনবিভাগ মাধবকুণ্ড ঝরনা বেসরকারিভাবে ইজারা দিয়েছে। নির্দেশনাহীন বাণিজ্য ও পর্যটনের চাপে এসব ধর্মীয় স্থানের ‘পবিত্রতা’ সুরক্ষায় রাষ্ট্র এগিয়ে আসেনি।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রঝরা বনভূমি টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন। মধুপুর শালবনের আদিবাসী মান্দিদের প্রধান অংশটাই এখন খ্রিষ্টান, কিছু গুরুসত্য ও মুসলিম হলেও অনেকেই আদি সাংসারেক ধর্ম নিয়মেও জীবনযাপন করছেন। সাংসারেকদের মতে, ব্রারা দুগনি দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন আর বাগবা বরম্বির চিপাং ফাকসা (তলপেট) থেকে দুনিয়ার সকল প্রাণ জন্ম নিয়েছে। ওয়ান্না, গালমাকদুআ, গুয়েরা আমুয়া, নকনিমিদ্দি আমুয়া, ব্রিংনিমিদ্দি আমুয়া, দেলাংসুআ, চুরাবুদি আমুয়া, গ্রিকা, রাক্কাসী আমুয়া, দুরাংসুআ, হাবামুয়া, গুদানীসুআর মতো নানা অবস্মিরণীয় ধর্মীয় রীতি ও কৃত্য নিয়েই সাংসারেক ধর্মবিধান। টাঙ্গাইল বনবিভাগের রসুলপুর রেঞ্জের এখন যেখানে লহরিয়া বিটের চিড়িয়াখানা, সেখানেই ছিল ‘আমনসর মিদ্দি আসং’ নামের সাংসারেক মান্দিদের এক পবিত্র ধর্মস্থল। বিশাল বট, অশ্বত্থ, আজুগি, গিলা, হস্তীকর্ণ পলাশ, কুচ– এ রকম গাছে ভরপুর ছিল তা। নানা পাখপাখালি আর ময়ূরের নিরাপদ আবাসও ছিল সেটি। মধুপুর শালবনে সাংসারেক মান্দিদের এ রকম শতাধিক ধর্মস্থল ছিল।
১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে মধুপুরে জুমচাষ বন্ধ করা হয়; পরে ১৯৬২ সালে মধুপুর বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয় এবং ২০০৩ সাল থেকে শুরু হয় ‘মধুপুর জাতীয় উদ্যোন প্রকল্প, যা ইকোপার্ক’ নামে বহুল পরিচিতি পায়। মধুপুর বনকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় উন্মাদনায় সাংসারেক মান্দিদের এসব পবিত্র ধর্মস্থল ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি সম্পত্তিতে’ পরিণত হয় এবং এসবের আর কোনো চিহ্ন আজ আর নেই। সিলেটের লালেং বা পাত্র জনগোষ্ঠীর বেশকিছু পবিত্র ধর্মস্থল হারাতে হয়েছে সেনানিবাস ও সিলেট বিমানবন্দর সম্প্রসারণের ফলে। রাষ্ট্র যখন এশিয়া এনার্জিকে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্মুক্ত করে দিল, সেখানে ৬৭টি আদিবাসী গ্রাম আছে। প্রতিটি আদিবাসী সাঁওতাল ও ওঁরাও গ্রামে জাহেরথান কি মৗঞ্জহিথান নামে নিজস্ব পবিত্র ধর্মস্থল আছে। এশিয়া এনার্জি যখন কয়লাখনির জন্য পুরো অঞ্চল বিপন্ন করে তুলল, রাষ্ট্র কিন্তু একটিবারের জন্যও জাহেরথান কি মৗঞ্জহিথানের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ আমলে নেয়নি। দেশজুড়ে পুস্তকবিহীন ধর্মাবলম্বীদের নিজস্ব ধর্মস্থলগুলো হারিয়েছে মূলত নানা অধিপতি উন্নয়ন আগ্রাসনের ফলেই।
আমরা কখনোই পুস্তকবিহীন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ‘ধর্মীয় অনুভূতির’ কথা বিবেচনা করিনি। যেন সকল ধর্মীয় অনুভূতির একমাত্র এখতিয়ার কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পুস্তকী ধর্মের। অথচ রাষ্ট্র প্রশ্নহীনভাবে সংবিধানে দেশের সকল জনগণ এবং সকল জনগণের ধর্মের সুরক্ষার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী কোলেরা নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতিটি গ্রাম ও বাড়িতে একজন মারাংবোঙ্গার থান রক্ষা করেন। মারাংবোঙ্গাই গ্রাম ও ঘরের সুরক্ষা দেন। ‘কোল ধর্মবিশ্বাস’ অনুযায়ী এই মারাংবোঙ্গার নির্দিষ্ট কোনো রূপ তৈরিতেও নিষেধ আছে। আদিবাসী ওঁরাও এবং সাঁওতাল সমাজে কারাম বৃক্ষ পবিত্রভাবে সুরক্ষিত হয় বংশ থেকে বংশে।
একটি গ্রাম কি পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়ার আগে পূর্বনিবাসের এক টুকরো কারাম বৃক্ষের ডাল কি চারা সঙ্গে নিয়ে নয়াবসতিতে স্থাপন করে। প্রতিটি হাজং গ্রাম ও বাড়িতে একটি কামাক্ষ্যা স্থান থাকে। কামাক্ষ্যা স্থানই হাজংদের অপরাপর জাতি থেকে স্থানীয়ভাবে ‘হাজং পরিবার’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এখনও গাজীপুর ভাওয়াল শালবন এলাকার বর্মণ গ্রামগুলোয় দেবনাগরীতে লেখা কিছু প্রাচীন ধর্মদলিল পাওয়া যায়। এ রকম হাজারো শত সহস্র অপুস্তকীয় ধর্মদর্শন ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এখনও টিকে আছে দেশের বিশাল এক জনভূগোল। আমরা কোন জবরদস্তি আর ক্ষমতার মনস্তত্ত্বে একে অস্বীকার আর আড়াল করব?
পাশাপাশি আমরা আরও কিছু নমুনা টানছি, যাকে কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরাজমানতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে এখনও কিছু মুসলিম ও হিন্দু পরিবার ভাদ্র মাসে পানির পীর খোয়াজখিজির ও জলের দেবতা গঙ্গাদেবীর নামে ‘বেড়াভাসান উৎসব’ আয়োজন করে। দুনিয়ার একক আয়তনের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম বনজীবীরা বিশ্বাস করে বাদাবনের রক্ষাকবচ মা বনবিবি। তারা সকলেই জংগল ও জানের সুরক্ষায় বনবিবির মানত করে, মান্য করে এক বাদাজীবনের ধর্মধারা। নিম্নবর্গের মুসলিম কি হিন্দু জনগণের বিশ্বাসের ভেতর দিয়েই এখনও চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারে নরম খোলের কালো কাছিম, সিলেটের শাহজালাল মাজারে গজার মাছ আর বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজারে টিকে আছে কুমির। কিন্তু যখন সুন্দরবনে করপোরেট শেল কোম্পানিকে খননের অনুমোদন দেয় রাষ্ট্র বা সম্প্রতি যখন রামপালে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে চাচ্ছে সুন্দরবনের কোলে, তখন কিন্তু নিম্নবর্গের ধর্মধারায় তার আঘাত লাগে।
যখন শাহজালাল মাজারে বিষ দিয়ে প্রবীণ গজার মাছ হত্যা করা হয়, তখন কিন্তু নিম্নবর্গের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যখন অরণ্য ও আদিবাসী বসতি এলোপাতাড়ি উচ্ছেদ আর দখল করা হয় তখন কিন্তু একইসঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় পবিত্র বৃক্ষ ও পবিত্র ধর্মস্থলসমূহও। কারণ পুস্তকবিহীন ধর্মধারাগুলো টিকে থাকে বিকশিত হয় তার চারপাশকে বুকে আগলে, চারপাশের সঙ্গে নিজেকে সঙ্গী করে। এখানে ধর্মবিশ্বাস মানে চলমান জীবনের গতিপ্রকৃতি। টিকে থাকবার সকল শর্ত ও কারিগরি পুস্তকবিহীন ধর্মধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে কোনোভাবেই ধর্ম যাপিতজীবনের রাজনীতি, অর্থনীতি, উৎপাদন সম্পর্ক, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আইন, নীতি, সমাজ, পরিবার কি ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রবলতার ভেতর এক অধিপতি করপোরেট রাষ্ট্রে এখনও টিকে আছে যেসব অপুস্তকীয় ধর্মধারা, এটিই তার টিকে থাকবার রাজনীতি ও দুর্বিনীত লড়াই। প্রাতিষ্ঠানিক পুস্তকী ধর্মের চশমা আর ঔপনিবেশিক পশ্চিমী জ্ঞানকাণ্ড দিয়ে অপুস্তকীয় ধর্মের নিপীড়িত স্বর ও জাগরিত ভঙ্গি কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রবল মনস্তত্ত্বকেও পাল্টাতে হবে। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের আচরণ ও ধারাকে দখল, বিনাশ কিংবা সেটাতে একতরফাভাবে অভ্যস্তও হতে পারে না। রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বহুধর্মমত ও দর্শনের সপক্ষে সমান কায়দায় দাঁড়ানো জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপুস্তকীয় সকল ধর্মের সুরক্ষা ও আপন বিকাশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।
সব কিছুরই কারণ আছে
মান্দি সমাজের সাংসারেক ধর্মীয় দর্শন মতে, ‘দুনিয়ার সব কিছুরই কারণ থাকে; কারণ ছাড়া দুনিয়ায় কোনো কিছুরই সৃষ্টি কি উদ্ভব হয়নি’। সমাজের যাত্রা ও রূপান্তর সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখাই রাষ্ট্রের কাজ। বাংলাদেশে বিরাজমান অপুস্তকীয় ধর্মধারাগুলো সম্পর্কে যতটুকু জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছি সেখানে কিন্তু কোনো একক মাপকাঠি কি প্রত্যয়ে এদের বহুপাক্ষিক পরিসরকে উপস্থাপন সম্ভব নয়। একে কোনোভাবেই ‘একেশ্বরবাদী’, ‘নিরীশ্বর’, ‘বহুশ্বরবাদী’, ‘আস্তিক’, ‘নাস্তিক’, ‘ধর্মহীন’ কি ‘প্রকৃতিবাদী’ এ রকম প্রবল দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না। করাটা একপেশে, অন্যায় এবং জবরদস্তিমূলক। বাংলাদেশ এ রকম কতগুলো অপুস্তকীয় ধর্ম আছে এবং এসব ধর্মের অনুসারী বা ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কত তাও বলা সহজ নয়। যেহেতু আমরা বরাবরই আমাদের ‘ধর্মীয় ডিসকোর্সের ময়দানে’ অপুস্তকীয় ধর্মধারাগুলোকে আড়াল ও ‘ধর্মহীন’ করে রেখেছি। তাই আজ পরিসংখ্যান, উপাত্ত, দলিলায়ন, স্বীকৃতি কি সুরক্ষা সবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব ধর্মধারা যুগ থেকে যুগে, কাল থেকে কালে চলমান থেকে প্রমাণ করে চলেছে এর টিকে থাকবার কারণ ও আখ্যান। মূলত আদিবাসী সমাজগুলোয় এবং কিছু বাঙালি নিম্নবর্গের জীবনে এসব ধর্ম জীবনের সত্য ও বিশ্বাস হিসেবেই রূপান্তরিত ও বিকশিত হয়ে চলেছে। এ সত্য ও বিশ্বাসকে কেবলমাত্র সংখ্যা ও পরিসংখ্যান দিয়ে বিবেচনা করা অন্যায়। প্রায়োগিক দিক থেকেও এসব ধর্মধারা বাংলাদেশের টিকে থাকবার শর্ত ও কারিগরিকে অনেকখানি রসদ জুগিয়ে চলেছে। অগণিত পবিত্র বৃক্ষ, প্রাণী, জলধারা, অরণ্য, পাহাড়, মাটি, জমি, বীজ, প্রাণসম্পদ, লোকায়ত জ্ঞান, শিল্পকৃত্য, প্রতিবেশ দর্শন, জীবনবোধের সুরক্ষা ও বিকাশের ভেতর দিয়ে। দীর্ঘদিনের দেনদরবারের ভেতর দিয়ে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’ প্রথম দেশের পবিত্র বৃক্ষ, কুঞ্জবন, পবিত্র বন ও বনভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত আদিবাসী জনগণের প্রথাগত ঐতিহ্য সুরক্ষার আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্র এ আইনি ধারার যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে এখান থেকেও অপুস্তকীয় ধর্মধারার সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের যাত্রা শুরু করতে পারে।
পবিত্র ধর্মপুস্তক পুড়ে গেলে, মন্দির কি মসজিদ ভাঙচুর হলে একজন ধর্মপ্রাণের জানপ্রাণ যেমন ডুকরে ফুঁসে ওঠে, ঠিক তেমনি কিন্তু কারও কারও আহাজারি হয় একটি জাহেরথান কি মিদ্দিআসং ধ্বংস হলে। একটি কারাম গাছ, পবিত্র বন কি প্রবীণ গজার মাছ খুন হলে। সকলের ধর্মবিশ্বাসই তার কাছে তার সমাজবাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ দলিল। রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ কায়দায় সকলের মুদ্রিত কি অমুদ্রিত সকল দলিলই সুরক্ষা করতে হবে। প্রবল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নানা নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের জনগণ ঐতিহাসিকভাবেই সংগঠিত হয়েছেন বারবার। গড়ে তুলেছেন প্রান্তিক স্পর্ধার সম্মিলিত সুর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিম্নবর্গের জনগণ মতুয়া নামে এক প্রতিরোধী ধর্মদ্রোহ গড়ে তুলেছেন।
বান্দরবনের আদিবাসী ম্রোদের নিজস্ব ধর্মআখ্যানমতে, ধর্মপুস্তক বহন করার সময় ক্ষুধার্ত গয়াল সেই ধর্মপুস্তকের পাতা খেয়ে ফেলে, যেখান থেকে তারা পুস্তকহীন। আর এ ঘটনা থেকেই মেনলে ম্রো ‘ক্রামা’ নামে এক নয়া ধর্মমতের প্রচলন করেন ম্রো সমাজে এবং তিনি ক্রামা ধর্মের পুস্তক ও বর্ণমালাও তৈরি করেন। ‘ধর্মই জীবন এবং জীবনেরই ধর্ম থাকে’ এটিও একটি সাংসারেক ধর্মদর্শন। কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, সকল অপ্রাতিষ্ঠানিক অপুস্তকীয় ধর্মধারার জীবনপ্রবাহের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জরুরি এক সম্মিলিত জাগরণ। আশা করি, রাষ্ট্র এই জাগরণে শামিল হবে তার অবিস্মরণীয় দরদ ও সাহস বুকে নিয়েই।
লেখক: গবেষক