আলোচনার পক্ষে সবাই, ছাড় দেবে না কেউ
একাত্তরের বিভক্তি রেখে আলোচনায় ফল হবে না

হাসানুল হক ইনু এমপি, জাসদ সভাপতি
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০০:৩৩ | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ০০:৩৩
সংকটটা কীসের? গত কয়েক বছরে এমন একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে, নির্বাচন কীভাবে হবে– এটাই দেশের মূল সমস্যা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কিছু বিষয়ের মীমাংসা হয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার একাত্তরের মীমাংসিত বিষয়কে অমীমাংসিত করেছে।
তারা শুধু সরকার বদল বা কয়েকজন মানুষকে হত্যা করেনি, সংবিধান বদলে ফেলে। এটাই বর্তমান ধারাবাহিক সংকটের কারণ। নির্বাচন একটি অজুহাত, একটি ছুতা। নির্বাচন কি একমাত্র ধন্বন্তরি মহৌষধ? একটি নির্বাচন হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
অতীতে দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক বা সামরিক যে ধরনের সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়ে থাকুক, তা বাংলাদেশে রাজনৈতিক শান্তি দিতে পারেনি। সরকার উৎখাতের খেলা বন্ধ হয়নি। চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। পরাজিত দল নির্বাচনের ফল মানেনি। সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে। নির্বাচনের পরদিন থেকে সরকার উৎখাতে রাজপথের লড়াই শুরু হয়েছে। সংসদ কখনও রাজনীতির কেন্দ্র হয়নি। ১৯৯০ থেকে পরবর্তী ২০ বছর সরকার উৎখাতের খেলা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন শান্তি, স্থিতিশীলতা দেয়নি। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে কোনো সহায়তা করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনই ত্রুটিপূর্ণ, প্রশ্নবিদ্ধ।
শুধু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে পারেনি। মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার ছিল আধাসামরিক। ১/১১-এর সরকার সংবিধানের বিধান অনুযায়ী হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়নি। হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা সংসদে। তড়িঘড়ি করে আলোচনা ছাড়াই জাতির ওপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাপিয়ে দেয়। যেই তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। আইনে বলা হয়েছিল, শেষ ধাপ হিসেবে রাষ্ট্রপতিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। অর্থাৎ দলীয় রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই দলীয় রাষ্ট্রপতির সরকার নিরপেক্ষ হতে পারে না। আইনে তাঁর ক্ষমতার পরিধি ও মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে বলা ছিল না। বিকল্প অনুসরণ করে যখন সমাধান হয়নি, তখন আসে এক-এগারো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে– এর কোনো ফর্মুলা কেউ হাজির করতে পারেনি। আর একাত্তর ও পঁচাত্তরের পর যে মহাবিভক্তি হয়ে গেছে, এর পর আর জাতীয় ঐকমত্য সম্ভব নয়। ১ হাজার বছর ধরে সভা করলেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১০ জন সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। যারা আন্দোলন করছেন, তারা সফল হলেন– শেখ হাসিনার পতন হলো। এর পর যে অনির্বাচিত সরকার আসবে, তা হবে বিএনপি-জামায়াতের পরোক্ষ সরকার। যাদের কাজ হবে খুনিদের রাজনীতিতে ফেরত আনা।
গত ১৫ বছরে যত বিচারপতি এসেছেন, বিএনপির ভাষায় তারা সবাই আওয়ামী লীগপন্থি। তাহলে কার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে? বিএনপি-জামায়াতের আমলে যারা বিচারপতি ছিলেন, তাদের বয়স এখন ৯০। তারা তো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তাহলে কী করবেন? নাকি বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বিচারপতি এস কে সিনহাকে দায়িত্ব দেবেন?
হাইকোর্টের বিচারে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে ঠান্ডা মাথার খুন বলা হয়েছে। যারা আজ চিৎকার করছেন, তারা কেউ গণতন্ত্রের ফেরেশতা নন। তারা রাজনৈতিক শয়তান। রাজনৈতিক সহমত হতে পারে। কিন্তু দুটি উল্টো মতের সহাবস্থান হতে পারে না। জামায়াত ও জঙ্গিদের আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। তথাকথিত মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে। খুনি, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার রাজনীতি করছে। মহাবিভক্তি ও মীমাংসিত বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারে না।
- বিষয় :
- হাসানুল হক ইনু
- সংলাপ