- বিশেষ আয়োজন
- অর্থনীতির পাঠদান ও গবেষণাকর্মে বাংলা ভাষার পরিস্থিতি
একটি সরেজমিন প্রতিবেদন
অর্থনীতির পাঠদান ও গবেষণাকর্মে বাংলা ভাষার পরিস্থিতি
অর্থনীতি

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার অর্থ দ্বিবিধ। একটি হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে নিশ্চিত করা। ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি শাখা এর মধ্যে পড়বে। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে হাসপাতাল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই এর আওতায় পড়বে। এর মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান চিঠি চালাচালিও বিবেচনায় নিতে হবে। সত্তরের দশকের তরুণ-তরুণীরা প্রায় অবিমিশ্র বাংলা ভাষায় সাধু অথবা চলিত বাংলায় প্রেমপত্র লিখতেন (কেউ কেউ আঞ্চলিক ভাষাতেও লিখতেন)। এই দশকে এসে সেই প্রবণতায় যদি ঘাটতি দেখা দেয়; তাহলে বুঝতে হবে, বাংলা ভাষা এখনও সর্বস্তরে চালু হয়নি। বাংলা সর্বত্র চালু করার দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে- প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু ব্যবহার করলেই চলবে না; প্রতিটি ক্ষেত্রের নানা স্তরে একে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধরা যাক, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চলু করা হলো, কিন্তু সেই ব্যবহার সীমিত হয়ে থাকল প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরেই। উচ্চতর শিক্ষার স্তরে বাংলা আর পাঠদানের অন্যতম ভাষা হিসেবে কার্যত স্বীকৃতি পেল না। সেরকম হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে চালু করার অধিকার রুদ্ধ হয়ে গেল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতি চর্চা, পাঠদান, গবেষণা ও নীতি বিশ্নেষণের ব্যাপক জ্ঞানকাণ্ডে বাংলা ভাষার হালনাগাদ অবস্থান বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। সমস্যাটা কি মূলত বাংলার 'চাহিদা' নেই বলে ('আমরা চাই না বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলায় পড়ালেখা করতে')। নাকি সমস্যা দেখা দিচ্ছে যথেষ্ট 'সরবরাহ' নেই বলে ('আমরা চাই না বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলায় বইপত্র, গবেষণাপত্র লিখতে')। নাকি দুটোই 'ফিফটি-ফিফটি'? এই সমস্যা নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।
২.
পাঠক, লক্ষ্য করবেন যে, এই ভাষার মাসে লিখতে গিয়ে আমি 'ফিফটি-ফিফটি' কথাটি ব্যবহার করে ফেলেছি। আমি ঘুরিয়ে লিখতে পারতাম, দুটো প্রবণতাই সমানভাবে দায়ী। তা না লিখে বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে যে আমি কেবল 'ফিফটি-ফিফটি' কথাটি বেছে নিলাম, সেটি কালের বিচারে টিকবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু বাজার-অর্থনীতির স্বাভাবিক কেনা-বেচার স্বাধীনতার মতো ভাষার ক্ষেত্রেও ভাবের লেন-দেনে স্বাধীনতা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারপ্রেটেশন বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সবসময় একই শব্দ ব্যবহার না করে আমি অনেক সময় 'তাফসির' শব্দটি ব্যবহার করেছি। প্রতর্ক কখনও কঠিন মনে হলে ডিসকোর্স শব্দটি সরাসরি চালিয়ে দিয়েছি। এক্ষেত্রে বিষয়টি হলো মাত্রাজ্ঞানের- কেউ সেটা আগে থাকতে ঠিক করে নিতে পারেন না। মানুষের মতো ভাষাও একটি বহতা নদীর মতো। তার চলার পথে কত কিছুকে তাকে স্বীকার করে নিতে হয়! কবিরা তো ব্যাপারটা আরও বেশি কাছে থেকে অনুভব করেন। চরণ, পা, পদ- এ সবের পাশাপাশি ঠ্যাং শব্দটিও ব্যবহার করেছেন তারা। দেহ, শরীরের পাশাপাশি গতর। এখন তো বডি-পলিটিকও ব্যবহূত হচ্ছে। কে কাকে চোখ রাঙাবে?
যেসব ধারণা আমরা ধার করে এনেছি, সে ক্ষেত্রে মূল শব্দটি অনেক ক্ষেত্রে অবিকৃত রেখে ব্যবহার করাই উত্তম। মার্কসের একটি মৌলিক উদ্ভাবন হচ্ছে 'কমোডিটি ফেটিসিজম'। কার সূত্রে বা বাসনায় বা সংগ্রহে 'কত পণ্য' তা নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা, পণ্য সংগ্রহ করাকেই জীবনের আরাধ্য মনে করা। নিত্য-নতুন পণ্যের পেছনেই ছুটে চলা বা পরমার্থ জ্ঞান করাকেই মার্কস কমোডিটি ফেটিসিজম বলেছেন। অন্য কোনো যুতসই পরিভাষা না পেলে আমি বাংলায় শব্দবন্ধটি সরাসরি ব্যবহারের পক্ষপাতী। অমর্ত্য সেন অবশ্য বহুকাল আগে প্রস্তাব করেছেন এর বদলে 'পণ্যমোহবদ্ধতা' শব্দটি ব্যবহারের। অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকরা পাঠদানের সময় শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করলে বোঝা যেত এতদিনে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কিনা। প্রতিষ্ঠা পেলেই কোনো বিদেশি বা পারিভাষিক শব্দ দাঁড়িয়ে যেতে পারে, বা ইন্টারচেঞ্জেবলি ব্যবহূত হতে পারে। কিন্তু ব্যবহারের চেষ্টা তো আগে করতে হবে। অর্থাৎ শুধু পরিভাষার অপ্রতুলতা নয়; উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সুপ্রচুর ব্যবহারের প্রতি আগ্রহীও হওয়া চাই।
অনেক সময় অনেক বিদেশি ভাষা থেকে আহরিত ভাব বা প্রকাশভঙ্গির অব্যর্থ প্রতিশব্দ বাংলা পাওয়া সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে (ধরা যাক) মূলের ইংরেজি ও বাংলা পরিভাষা পাশাপাশি চলতে পারে। আমি এখানে রবীন্দ্রনাথকে দুটো মৌলিক বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করতে চাই। 'নেশন কী' রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত একটি প্রবন্ধ- ১৯০১ সালে লেখা। সেখানে তিনি বলছেন :স্বীকার করতে হইবে। বাংলায় 'নেশন' কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায় এবং জাতি বলিতে ইংরেজিতে যাহাকে race বলে তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা 'জাতি' শব্দ ইংরেজি 'রেস' শব্দের প্রতিশব্দরূপেই ব্যবহার করিব এবং নেশনকে নেশনই বলিব। নেশন ও ন্যাশনাল শব্দ বাংলায় চলিয়া গেলে অনেক অর্থদ্বৈধ-ভাবদ্বৈধের হাত এড়ানো যায়। ... নেশন শব্দটা অবিকৃত আকারে গ্রহণ করিতে আমি কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করি না। ভাবটা আমরা ইংরেজের কান হইতে পাইয়াছি, ভাষাটাও ইংরেজি রাখিয়া ঋণ স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি। উপনিষদের ব্রহ্ম, শংকরের মায়া ও বুদ্ধের নির্বাণ শব্দ ইংরেজি রচনায় প্রায় ভাষান্তরিত হয় না এবং না হওয়াই উচিত।
শুধু এখানেই নয়, 'ভারতবর্ষীয় সমাজ' এবং এ বিষয়ে আরও অনেক প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ নেশন-কে নেশনই বলেছেন, এমনকি নেশনালিজমের বাংলা হিসেবে 'জাতীয়তাবাদ' শব্দটিও তিনি কখনও ব্যবহার করেননি। একই কথা খাটে 'ইম্পিরিয়ালিজম' শব্দের ক্ষেত্রেও। তিনিও সর্বত্র মূল ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করেছেন- সাম্র্রাজ্যবাদের অধীনস্ত হতে চাননি।
রবীন্দ্রনাথ যদি মূল ভাবধারা বোঝানোর জন্য বা মৌলিক কনসেপ্টের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে বিদেশি শব্দকে অবিকৃতভাবে বাংলায় রেখে দিতে চাইতে পারেন, তাহলে আমরা পাঠদান বা গবেষণাপত্র লেখার ক্ষেত্রে সেই দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করতে পারব না কেন? ডিমান্ড ইলাস্টিসিটিকে 'অবিকৃত'রূপে ব্যবহার করলেই চলে। একে 'চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা' বলাটা যেমন ভুল, তেমনি অপ্রয়োজনীয়। প্রতিশব্দ উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যেতে হবে- তবে কোনো গোঁড়ামিকেই প্রশ্রয় না দিয়ে খোলা মন নিয়ে। ড্রপ-আউটকে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন করেছেন 'স্কুলছুট' বলে। আমরা এদেশে করেছি 'ঝরে পড়া'। তিনটি শব্দই চলতে পারে। এভাবেই আমাদের অনুরূপ প্রতিশব্দ বা পরিভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকবে।
৩.
রাবীন্দ্রিক সিদ্ধান্ত যদি মেনে নিই, তাহলে অর্থশাস্ত্রের পাঠদানে এবং অর্থনীতির গবেষণাপত্র রচনায় পরিভাষার অভাব কোনো বাধা বলে গণ্য হতে পারে না। তাহলে বাধাটা কোথায়? কেন বাংলায় অর্থনীতির পাঠদান এখনও সীমিত এবং বাংলায় অর্থনীতির গবেষণাপত্রের সংখ্যা এত অপ্রতুল? হতে পারে, এর কারণ চাহিদার অভাব। কিন্তু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে চাহিদার অভাব তো নয়ই, বরং উচ্চশিক্ষায় বাংলার চাহিদা আগের তুলনায় আরও বেড়ে গেছে। প্রথমত, বাংলায় অর্থনীতি-সংক্রান্ত গবেষণাপত্রের চাহিদা বেড়ে গেছে। কর্মসূত্রে আমি বিআইডিএস-এর বাংলায় বার্ষিক প্রকাশনা 'বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা' সম্পাদনা করেছি আট-নয় বছর ধরে আশি-নব্বইয়ের দশকে।
এখন এর আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি প্রকাশনা 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ'-এর সম্পাদক। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে নীতিপ্রণেতাগণ এবং সরকারি কর্মকর্তাগণ প্রায়শ অনুযোগ করে থাকেন, কেন আমরা বেশি বেশি করে বাংলায় জার্নাল প্রকাশনা ও গবেষণাসূত্রের অন্ততপক্ষে সারাংশ বের করছি না?
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যারা পড়ান তারা বলেছেন, অন্তত এক-পঞ্চমাংশ ছাত্রছাত্রী এখনও পরীক্ষার খাতায় বাংলা লিখে থাকে। অন্যান্য আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষত কলেজগুলোয় এই শতাংশ আরও বেশি হবে। এর একটি প্রধান কারণ, ঢাকার বাইরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা এখনও সীমিত এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রবেশ করেছে তারা এর আগে মূলত বাংলাতেই তাদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রম শেষ করেছে। ফলে তাদের 'চাহিদা' হচ্ছে উচ্চশিক্ষার স্তরেও বাংলায় পাঠক্রম অব্যাহত রাখা। ক্লাসে পাঠদান কার্যক্রম এখনও বাংলা-ইংরেজি মিলিয়েই দেওয়া হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের অধীত বিষয় বোঝানোর ক্ষেত্রে। সেটাই স্বাভাবিক। একজন ছাত্র বুঝতে পারল কিনা, সেটাই শিক্ষকের পাঠদানের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এবং সেটাই হয়ে আসছে। আমি নিজে কোনো ক্লাস নেওয়ার আগে বা লেকচার দেওয়ার শুরুতে বলে নিই, আমি অর্থনীতি বিষয়ে বাংলায় বলব। তবে আমার টার্মগুলো থাকবে অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষায়। ক্রিয়াপদগুলো বাংলায় ব্যবহার করলে আমাদের ভাব-বিনিময়ের দ্রুততা আরও বেড়ে যাবে।
তাহলে অর্থনীতির উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার স্তরে বাংলার ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা কোথায়? 'চাহিদা'র ক্ষেত্রে যদি কণ্টকিত সমস্যা না থেকে থাকে; শিক্ষার্থীরা ও নীতিপ্রণেতাগণ যদি বেশি বেশি করে বাংলায় বই-গবেষণাপত্রের অভাব অনুভব করে থাকেন তাহলে বলতেই হবে- সমস্যাটা মূলত 'সাপ্লাই-সাইড' থেকে আসছে। যারা অর্থশাস্ত্রের উচ্চশিক্ষার পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা অর্থনীতির গবেষণার সঙ্গে জড়িত তারা যথেষ্ট মাত্রায় বাংলায় বই-পুস্তক লিখছেন না। গবেষণাপত্র তৈরি করছেন না।
'সরবরাহে' এই অনুৎসাহের কারণ কী? একটা হতে পারে যে ইনসেনটিভ স্ট্রাকচার এখনও বাংলার বিপক্ষে। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে। রাষ্ট্র বা অর্থনীতি বা প্রতিষ্ঠানগুলো (ইনস্টিটিউশন্স) বাংলাকে আসলে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। বাংলা ভাষার অর্থনীতির উচ্চশিক্ষা স্তরে এবং গবেষণায় আরও প্রসার ঘটুক; তার জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা দিচ্ছে না। একটা উদাহরণ দিই। আমি যেখানে কর্মরত সেই বিআইডিএসে যে বার্ষিক বাংলা জার্নালটি বের হয় তাতে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে থাকে কৃষি থেকে শুরু করে ম্যাক্রো অর্থনীতির তাবত বিষয়ে। কিন্তু পদোন্নতির যখন প্রশ্ন আসে, তখন এই নিয়ম করা হয়েছে যাতে কোনো একজন গবেষক বাংলায় প্রকাশনা করে প্রয়োজনীয় 'পয়েন্ট' সংগ্রহ করতে পারবেন কেবল একটি প্রবন্ধের জন্য। একাধিক প্রবন্ধ বাংলায় লিখলে সেই বাড়তি প্রবন্ধগুলোর জন্য তিনি কোনো 'পয়েন্ট' পাবেন না। এর ফলে পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট 'পয়েন্ট' সংগ্রহে গবেষকগণ ইংরেজিতেই মানসম্পন্ন জার্নাল প্রকাশ করতে উদ্যোগী হবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিকে কি আরও গুণে-মানে আন্তর্জাতিকভাবে বহুল স্বীকৃত করা যেত না এবং তা করা গেলে শুধু একটি বাংলায় প্রকাশিত প্রবন্ধকেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় 'পয়েন্ট' আহরণে; সেই কালাকানুনও উঠিয়ে নেওয়া যেত। প্রণোদনার ক্ষেত্রে অন্য ধরনের ঘাটতিও আছে। গবেষণার চাহিদার একটি বড় জোগানদার- বিশ্বব্যাংক, রাষ্ট্রসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এরা স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজিতে প্রতিবেদন আশা করবে। এর ফলে বড় একটা সময় চলে যায় ইংরেজির পেছনে। এ ক্ষেত্রে আমি বিষয়টিকে বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান থেকে বিচার করার পক্ষপাতী। আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য বিদেশি ভাষায় লিখলেও তার একটি বাংলা সারাংশ সমান্তরালভাবে বেরুতে পারে। এতে বাংলায় অর্থনীতির জ্ঞানভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হতে পারে এবং এতে শিক্ষার্থীরাও পরোক্ষভাবে উপকৃত হতে পারে। মোটকথা, সদিচ্ছা চাই, যাতে উচ্চশিক্ষার স্তরে বাংলাকে প্রকৃত অর্থে ইংরেজির সমমর্যাদায় পাঠদানের অন্যতম ভাষা হিসেবে দাঁড় করানো যায়। লড়াইটা বাংলা বনাম ইংরেজির নয়। লড়াইটা সমকক্ষতা তথা সমমর্যাদা অর্জনের। এ জন্য অর্থনীতির শিক্ষক-গবেষকদের যেমন, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও একাধিক ভাষা জানতে হবে। বাংলা তো জানতে হবেই। বাংলা ভালো করে জানা ও প্রয়োগ করার জন্য ইংরেজিটাও ভালো করে শিখতে হবে। পারলে আরও কিছু বিদেশি ভাষাও। ইংরেজি ভাষা জানলে ভাষান্তর, ভাষান্তর ও রূপান্তরের কাজটা বাংলায় ভালোভাবে করা যাবে। রামমোহন আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষা জানতেন। দেবেন্দ্রনাথ ফার্সি ও ইংরেজি ভাষা জানতেন- সেটা তার আত্মজীবনী পাঠ করলেই বোঝা যায়। মোটকথা, গ্লোবালাইজেশনের কথা মনে রেখে ও বৃহত্তর জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রয়োজনে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার গুরুত্ব বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু ইংরেজিতে সমৃদ্ধ হলে বাংলায় অর্থনীতিচর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 'স্বকীয় সত্তা' ও 'অপর সত্তা'র মতো বাংলা ও ইংরেজি দুটোকেই আমাদের আত্মস্থ করা দরকার। যারা বাংলায় অনবদ্যভাবে অর্থশাস্ত্র ও নীতিচর্চা নিয়ে লিখেছেন, তারা উভয় ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। ইদানীংকালের বই হিসেবে আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই প্রণব বর্ধনের 'দারিদ্র্য নিয়ে কনফারেন্স ও অন্যান্য প্রবন্ধ' বইটির কথা। তেমনি একটি সাবলীল বই অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খানের 'আমার সমাজতন্ত্র'। আনন্দ থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি গ্রন্থমালা সিরিজের কথা আমি অবশ্য এখানে ভুলে যাইনি। অর্থনীতির সামান্য বাইরে রয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দীপেন চক্রবর্তীর একাধিক বই। আমাদের দেশের নজরুল ইসলাম দীর্ঘকাল ধরে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় অর্থনীতির চর্চা করে আসছেন। লিখেছেন একাধিক স্মরণযোগ্য গ্রন্থ। এম এম আকাশ, আনু মুহাম্মদ, আতিউর রহমান সুপ্রচুরভাবে লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন বাংলায়। রিজওয়ানুল ইসলাম অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তক লেখার মতো শ্রমসাধ্য কাজে এগিয়ে এসেছেন। আর এ বিষয়ে বিআইডিএসের দু'জন প্রয়াত গবেষক মাহবুব হোসেন এবং আবু আবদুল্লাহর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা দু'জনেই গ্রামীণ অর্থনীতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে চমৎকার গদ্য উপহার দিয়েছেন আমাদের। মোটকথা, রাবীন্দ্রিক ফর্মুলা অনুসরণ করে আপাত-জটিল বিষয়েও বাংলায় উচ্চশিক্ষা স্তরের জন্য পাঠ্যপুস্তক, পাঠদানে সহায়ক গ্রন্থ এবং গবেষণাপত্র প্রকাশকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে উৎসাহী করতে পারি আমরা। সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের 'সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র' ও প্রথমার 'প্রতিচিন্তা'- এই দুটো সাময়িকী এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে তরুণ গবেষক ও শিক্ষার্থীদের লেখা প্রকাশ করে।
প্রণব বর্ধন একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, 'এই স্মৃতি বক্তৃতা ইংরেজিতে দেওয়ার কথা, কিন্তু আমি বাংলাতে দেওয়া ঠিক করলাম। বহুদিন ধরেই দেখছি যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করাটা সহজ, অনেক কবিতা ও গল্প লেখা হয়, কিন্তু প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুতরাং এখানে প্রবন্ধের যে মূল বিষয়, অর্থনীতি, সেটা যে বাংলাতে ভালোই আলোচনা করা সম্ভব, তার একটা উদাহরণ আমি রাখার চেষ্টা করব।' প্রণব বর্ধনের দেখাদেখি আমাদেরও এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক
অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন