
আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় গেছে একাত্তরের ইতিহাসের সন্ধানে। কত শত মানুষের কাছে গেছি, কথা বলেছি, তার সংখ্যা মনে নেই। যত অভিজ্ঞতা পেয়েছি, যত সাক্ষাৎকার নিয়েছি; এর মধ্যে একটি সাক্ষাৎকারের কথা আমি প্রায় সময়ই বলি। সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে আলাপ। ২০০১ সালের দিকে বিবিসির জন্য আমি 'বাংলাদেশের একাত্তর' নামে একটা সাক্ষাৎকার সিরিজ করছিলাম। ভারতে আমার যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তার মধ্যে জগজিৎ সিং অরোরা একজন। রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক বিশেষ করে বাংলাদেশের বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, 'দেখ, আমরা তো সবসময় যুদ্ধে সেনাবাহিনীর কথা বলি; তাদের যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমরা যৌথ বাহিনী যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, তখন যদি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আমাদেরকে সম্মতি না দিত, তাহলে কি আমরা প্রবেশ করতে পারতাম? সেনাবাহিনীর কোনো শক্তিই ছিল না তাদের সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধে প্রবেশ করার। তারাই আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি আমাদের হাতে তখন বাংলাদেশের পর্যাপ্ত ম্যাপও ছিল না।'
এই যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যৌথ বাহিনীকে দেশের ভেতরে নিয়ে গেছে; তারা বিরোধিতা করলে যৌথ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে জেতা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এটা জেনারেল অরোরার কথা থেকে যেমন জেনেছি; তেমনি আমার অভিজ্ঞতা থেকেও মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মূল শক্তি ছিল এই সাধারণ মানুষ। কিন্তু আমাদের ইতিহাসচর্চা বা বয়ানে সাধারণ মানুষের এ অভিজ্ঞতাটা আসে না। এটা কেন আসে না- তার নিশ্চয় তাত্ত্বিক অনেক কারণ আছে। তবে আমার মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিকতা বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা রাষ্ট্র বলতে যেটা বোঝাই, অর্থাৎ সরকারি রাষ্ট্র, ওপরতলার রাষ্ট্র, ক্ষমতাবানদের রাষ্ট্র বা লিখতে-পড়তে পারে এমন মানুষদের রাষ্ট্রের বয়ানটাই আমরা জানতে পারি। তাদের ভাবনায় আমাদের যে ইতিহাস নির্মিত হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ভূমিকাটা নেই। এর একটা তাত্ত্বিক কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজটা হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক, আর রাষ্ট্র হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক। এই প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সব সময় সমাজের একটা দ্বন্দ্ব থাকে। সে কারণে কোনো বিষয়ের বয়ানের পরিসর এলে সেখানে ওপরতলার কথাই বারবার আসে। ওপরতলা বলতে ধনীরাই শুধু নয়; সেই সঙ্গে রাষ্ট্র যাদেরকে নিজের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেয়, সেই সব মানুষ। সমাজকে মূলত রাষ্ট্র স্বীকার করতে চায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে; আমরা একাত্তরের ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের কথা বলি; মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কী- সবসময় সেটা আমরা খেয়াল করে বলি না। আমার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যখন; তিনি বলছিলেন, আমরা দেখব কে কে ট্রেনিং নিয়েছে; তাদেরকেই মুক্তিযোদ্ধা গণ্য করা হবে। অর্থাৎ, বেশ একটা আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টি থেকে দেখা যে, সরকারি ট্রেনিং নিলেই কেবল মুক্তিযোদ্ধা হবে। এখন সে অবস্থান বোধ হয় নেই। অর্থাৎ এই আনুষ্ঠানিক বা ফরমাল রাষ্ট্রই নির্ধারণ করছে যে, ইতিহাসে কী ঘটেছিল। ইনফরমাল অর্থাৎ সমাজের তাতে কী কী ভূমিকা, সেটা নিয়ে আলাপ হয় না।
সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ
গোটা একাত্তরের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব; মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধের একটা পর্যায় রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রধানত প্রতিরোধ করেছে সাধারণ মানুষই। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকরা দেখা যায়, তারা পুলিশের কথা বলছেন, সেনাবাহিনীর সদস্যদের কথা বলছেন বা রাজনৈতিক কর্মীদের কথা বলছেন। সেখানে সাধারণ মানুষের উল্লেখ খুব কম। তবে 'আমাদের প্রতিরোধ' গ্রন্থে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের কথা কিছুটা হলেও বলার চেষ্টা করেছি। আরেকটি ব্যাপার হলো, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চায় একাত্তরে সাধারণ মানুষকে অনেকটা আশ্রয়সন্ধানী ও শরণার্থী হিসেবেই দেখতে পাওয়া যায়। এবং একটা বড় জনগোষ্ঠী যেহেতু ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল; আমরা সে কথাটাই বলি। কিন্তু যাওয়ার আগে তাদের কী ভূমিকা ও অবস্থা ছিল; সে কথাটা বলি না। আমরা যে জিনিসটা দাঁড় করিয়েছি- মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে আর সাধারণ মানুষ সব পালাচ্ছে; নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। এই সমীকরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় বড় রকম প্রভাব ফেলেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও আত্মত্যাগ
সাধারণ মানুষ সবকিছুই করেছে। সাধারণ মানুষ থেকেই যুদ্ধ করতে গেছে; বাকিদের হাতে অস্ত্র ছিল না। সেই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ কিন্তু পুরো সময়টাতেই যুদ্ধের জন্য কাজ করে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ঢুকে সাধারণ মানুষের কাছেই আশ্রয় নিয়েছিল। এ পর্যায়টির কথা যথোপযুক্তভাবে আমাদের চর্চায় আসে না। একে অনেকটা গৌণ বিষয় বলেই মনে করা হয়। আমি যখন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানাচ্ছিলাম, সেখানে প্রত্যেক মানুষের কথায় এ বিষয়টি উঠে আসতে দেখেছি। তারা বলছে- আমরা এসে এই এই জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। আমরা জানতাম, ওখানে আশ্রয় নিতে হবে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধারা দেশে প্রবেশ করে প্রথম যে কাজটি করেছে, সেটি হলো আশ্রয়ের সন্ধান। কিন্তু আমরা সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের এই আশ্রয়দান ও সহায়তাকে গোটা হিসাবের মধ্যে গুরুত্বের দিক দিয়ে একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে ধরেছি। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষকে আমরা অনেকটা 'হরিজন' বানিয়ে রেখেছি। এর কারণ, যুদ্ধটাকে যখন দেখি, একটা ক্ষমতার পরিসর থেকেই দেখি। কিন্তু আমরা তো জগজিৎ সিং অরোরার মতো করে দেখতে পাইনি। সেখানে সৈনিক হিসেবে গোলাগুলি করা তো তার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু যেসব মানুষ তার এই দায়িত্ব পালনকে সম্ভব করে দিচ্ছে, তাদের কথাটা ইতিহাসচর্চায় রাখি না।
একাত্তরের যুদ্ধে লাখ লাখ ঘটনা আছে সাধারণ মানুষের; বিশেষ করে তাদের আত্মত্যাগের ঘটনাগুলো অকল্পনীয়, যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধাও বলতে পারবেন না- তিনি আরেকজনের আত্মত্যাগ ছাড়া কোনো একটি কাজ করেছেন। আমি আমার নিজ পরিবারের সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা ঘটনার কথাই বলি। আমার ভাই যুদ্ধের সময় অক্টোবরে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ভবনে একটা ব্লাস্ট করেছিল। ভারত থেকে তার কাছে একটা বাক্স এসেছিল। বাক্সের মধ্যে নানা রকম ফিউজ লাগানো। সেই বাক্স কে পার করে এনে দিয়েছিলেন আমাদের মামা। তিনি তো আর সরকারি হিসাব অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা নন। আমার ভাই বাক্সটা নিয়ে টয়লেটে রেখে ফিউজটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তখনকার দিনের গোলাবারুদ; ততটা অত্যাধুনিকও নয়। ফিউজটা অনেক দ্রুতই জ্বলে যাচ্ছিল দেখে টয়লেট থেকে বের হয়ে দ্রুত চলে যাওয়ার সময় সে একজন অবাঙালির সঙ্গে ধাক্কা খায়। আমার ভাইয়ের পরনে ছিল হলুদ চেক শার্ট। এর মধ্যেই ব্লাস্ট হয়ে গেছে। এ ঘটনায় ব্লাস্টটি বড় ব্যাপার ছিল না। বড় ব্যাপার ছিল মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি ও ক্ষমতার জানান দেওয়া। পাকিস্তান আর্মি দ্রুতই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। আমার বাবা ব্যাংকার ছিলেন। ভাই সেই ব্যাংকের প্রধান ব্যক্তি সালেহীন সাহেবের কক্ষে গিয়ে উঠল। আতঙ্ক আর দৌড়াদৌড়িতে হাঁপাতে হাঁপাতে সে কিছু বলতে না পারলেও সালেহীন সাহেব সম্ভবত কিছু একটা বুঝতে পারছিলেন এবং তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের গাড়িতে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরদিনই সালেহীন সাহেব খবর দিয়েছিলেন- হলুদ চেক শার্ট পরা ছেলেটাকে খুঁজছে পাকিস্তান আর্মি। এখন এ ঘটনায় আমার সেই মামা এবং সালেহীন সাহেব; তারা না থাকলে ব্লাস্টটা হতো না এবং হলেও আমার ভাই নিশ্চিত ধরা পড়ে যেত।
তার সঙ্গে জড়িতসহ আমাদের পরিবারের সবার কথা বেরিয়ে যেত। এখন মামা এবং সালেহীন সাহেবকে তো আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না! এখানে মুক্তিযোদ্ধা আমার ভাই। কিন্তু সালেহীন সাহেব না থাকলে সেদিন আমার ভাইকে বাঁচাত কে?
একাত্তরকে ধারণ করল কে?
এই যে মুক্তিযোদ্ধা সনদের বিষয়টি আসে- পবা উপজেলার এক গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পিয়ারু, সে একাত্তরে ছিল দিনমজুর। ২০১৮ সালে যখন তার সাক্ষাৎকার নিতে গেছি, তখনও সে দিনমজুরই আছে। সে তো কখনও সনদ চায়নি, নেয়ওনি। আমরা যদি বলি, তালিকায় নাম না থাকলে স্বীকৃতি হবে না; তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ায়? তার ওপর সে যেখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা কারা ছিল? সবচেয়ে বড় কথা হলো, পুরো একাত্তরকে ধারণ করল কে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে। বলা হয়, তার সহায়ক শক্তি হিসেবে অনেকেই কাজ করেছে। কিন্তু সহায়ক কেন বলব? তারা তো যুদ্ধটা নিজে থেকেই করছে। যে মানুষটি যোদ্ধাকে সহায়তা করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; যে বুড়ি মহিলা সারাদিন না খেয়ে ঘরের সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে, যার বাড়ির ভেতরে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে রয়েছে; সে যোদ্ধা না? তো যোদ্ধা বলতে আমরা এত স্থূলভাবে কেবল গুলি ছুড়লেই যোদ্ধা- এমনভাবে ধরে নিচ্ছি? একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি এটুকু বলতে চাই- অনেক মুক্তিযোদ্ধাই গুলি ছোড়েনি। ট্রেনিং নেওয়ার পরও অনেকের সুযোগ বা প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশের ওয়ারকোর্স- যেটাকে আমরা মুক্তি ওয়ারকোর্স বলি, তার প্রথম ওয়ারকোর্সের লোকেরা যুদ্ধ করেছে; দ্বিতীয় ওয়ারকোর্সের লোকেরা যুদ্ধ করেনি। দ্বিতীয় ওয়ারকোর্সের এই মানুষদের আমরা বলব যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা না? আসলে কে মুক্তিযোদ্ধা, কে মুক্তিযোদ্ধা না- এ বিষয়টা ততটা আলোচনার বিষয় ছিল না ১৯৭২-৭৩ সালেও। রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা পাল্টে গেছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা গ্রামের একাত্তর নিয়ে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে পারিনি। একবার গ্রামে গিয়ে দেখে আসুন- মুক্তিযুদ্ধ কী ছিল। ঢাকা শহরে আর কতটুকু মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে? সারা বাংলাদেশের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। সেখানে কী ঘটেছিল?
যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শরণার্থীদের অবদান
আমরা বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে দেখি পালিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী হিসেবে। কেবল একাত্তরকেই যদি দেখি, তাদের কী অবস্থা হয়েছিল এবং কী অবস্থার মধ্যে তারা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করেছে? সেগুলো কিন্তু দেখতে চাই না; ইতিহাস থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। একে একটা আলাদা ক্যাটাগরিতে ফেলার চেষ্টা করি, যেটা মুক্তিযুদ্ধের অংশ নয়। অথচ পাকিস্তানিরা আক্রমণ ও হত্যার জন্য এই হিন্দু জনগোষ্ঠীকেই আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছিল। সেটা যে বিশ্বব্যাপী কত বড় প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং যার সবচেয়ে বড় সুবিধা আমরা বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছি, তার সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কাজ হয়নি। কেন হয়নি- সেটাই হচ্ছে বিষয়। আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্তই নিয়ে রেখেছি- এগুলো গ্রহণযোগ্য কাজ, আর এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সবাই। যতক্ষণ না এই অংশগ্রহণকারী শব্দটি আমরা ব্যবহার করব; বিষয়টি ঠিক হবে না। আমরা বলি মুক্তিযোদ্ধা আমলা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজনীতিবিদ; নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা, অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা- তার মধ্যেও আবার বিভাজন করতে করতে এটাকে অন্য এক পর্যায়ে নিয়ে গেছি। অনেকে বলেন, অমুক পানি খাইয়েছিল, তাই সে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমার কাছে এই পানি খাওয়ানোর বিষয়টি তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সনদ তো ভিন্ন জিনিস। মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রাতিষ্ঠানিক তালিকাকরণ বিষয়টি পুরোটাই আমলাতান্ত্রিক। যার হাত ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গণমানুষের যুদ্ধ, গণমানুষের ইতিহাস থেকে আমলাতান্ত্রিক ইতিহাস বা পরিসরের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
যে মহিলা দশটা গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আর টিকতে না পেরে ভারতে চলে গিয়েছিল; তার তো একটা ইতিহাস আছে। যে মানুষ ভারতে গিয়ে থেকেছে, তারও তো ইতিহাস আছে। অনেকে বলেন, ৯ মাস তো তারা আরামেই ছিল। তারা যুদ্ধে কী করেছে? কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন আসলে কেন আসবে? কারণ সশস্ত্র সংগ্রাম তো স্বল্পসংখ্যক মানুষই করেছে। কারণ আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধকে কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করাতে পারিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বেশিরভাগ সময় কী বলেছিল? তারা তো মূলত এই শরণার্থীদের নিয়েই কথা বলেছে। শরণার্থী যদি না থাকত, তাহলে পাকিস্তানিদের সহিংসতার এই ছবিটা কী করে আসত! সুতরাং শরণার্থীদের ভূমিকাকে ইতিহাসের ভিত্তিতে দেখতে হবে। সেই ইতিহাসটা থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম, সেখানে কার কী অবস্থা হয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা একটি মেয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে ওপারের দিকে যাচ্ছে- শরণার্থী হওয়ার এমন নির্মম বাস্তবতার হাজারো কথা ইতিহাসের বাইরে রয়ে গেছে। একাত্তরে আঘাত পাওয়াটাও যেমন নির্মম, তেমনি শরণার্থী হওয়াটাও নির্মম। সবকিছু ফেলে রেখে যে মানুষ অনিশ্চিত জীবনের দিকে চলে যাচ্ছে; সে আবার সারাবিশ্বকে জানাচ্ছে অত্যাচারের কথাটা। সে নিজেই জীবন্ত একটা ন্যারেটিভ- আমার ওপর অত্যাচার হয়েছে। আমি বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছি। এই ন্যারেটিভই সারাবিশ্বকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে। এখন এই চোখ দিয়ে না দেখে, কেবল সীমিত একটা দৃষ্টিতে তাকাই বলেই সাধারণ মানুষকে আমরা দেখতে পাই না। আর বাদ পড়ে যাওয়া মানুষকে যতক্ষণ না ইতিহাসে জায়গা দেওয়া হবে, ততক্ষণ ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না।
নারীর একাত্তরটা কেমন? আমরা পরিবার আর সংসারগুলোর দিকে তাকাই না। এই সংসারগুলো যদি না টিকত, একাত্তর কি টেকে? কোনো সমাজ টেকে? সেই নারীরা কীভাবে এই সমাজকে ধারণ করেছে? সোহাগপুরের সেই নারীরা, যাদের স্বামীদের পাকিস্তান আর্মি মেরে ফেলেছিল যুদ্ধের ভেতর, তারা কী কষ্টটা করেছে ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে রাখতে? একাত্তরে বাংলার নারীরা যদি তাদের ছেলেদের না দেখত, তাহলে এই ছেলেদের কে বাঁচিয়ে রাখত? তাই এসব পরিসরে না দেখে একাত্তরের নারীদের যদি আমরা অন্য কোনো পরিসরে খুঁজতে যাই, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটাই শুধু স্পষ্ট হয়। আমরা এখনও পরিপূর্ণভাবে বলতে পারি না- একাত্তরটা কী ছিল। একাত্তরটা ছিল সবার। সাধারণ মানুষের ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ গোটা রাষ্ট্র, সমাজ দুটোকেই টিকিয়ে রেখেছিল সাধারণ মানুষ। যারা যুদ্ধ করেছে, তারা প্রত্যেকেই নির্ভর করেছে তাদের ওপর। জগজিৎ সিং অরোরা বলেছেন- এই যে যৌথ বাহিনী দেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করল; এটা সম্ভব হতো না যদি সাধারণ মানুষ ভূমিকা পালন না করত। তবু আমরা মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানকে এড়িয়ে যাই। আসলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজনৈতিকভাবেই সাধারণ মানুষকে প্রান্তিক করে ফেলাটা ক্ষমাতাবান শ্রেণির একটি বড় কর্মে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় কোনোদিনই জানা যাবে না- একাত্তরে কী হয়েছিল। একাত্তরের ইতিহাস রয়েছে তাদেরই হাতে। যতক্ষণ না আমরা তাদের কথা শুনব, আমরা একাত্তর জানব না, একাত্তর বুঝবও না।
লেখক
সাংবাদিক
গবেষক
মন্তব্য করুন