শৈশবে আনন্দের ছলে হাওরের জল-জোছনায় বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে হয়ে গেলেন শখের সাঁতারু। সেই থেকে সাঁতারের প্রতি এক অদ্ভুত ঘোর নিয়ে প্রতিদিন সকাল-বিকেল দু'বেলা ঝাঁপিয়ে পড়তেন জলে। একা-একাই সাঁতার কেটে পাড়ি দিতেন হাওরের জলসীমা। এভাবেই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ সাঁতারু। নিকলী উপজেলা সদরের মীরহাটি মহল্লার শৌখিন সাঁতারু মো. আবুল হাশেম এভাবেই আজ জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন দেশসেরা সাঁতার প্রশিক্ষক। প্রায় সত্তর বছরের প্রৌঢ় হলেও এখনও শরীরে ধারণ করেন তারুণ্যের অমিত শক্তি। বয়সের কাছে এতটুকু হার মানেননি তিনি। বরং নিজের জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতাকে সাঁতারের মতো কঠিন ক্রীড়াশৈলীতে নিয়োগ করে নিজের এলাকায় প্রতিনিয়ত তৈরি করছেন নতুন নতুন দক্ষ সাঁতারু। তার কাছে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিয়ে ইতোমধ্যে শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, সাফ গেমসের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার শিক্ষার্থীরা একাধিকবার রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ পদক জয় করেছে। জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ সাঁতারু কারার মিজান এবং কারার ছামেদুল এই আবুল হাশেমেরই হাতে গড়া সাঁতারশিল্পী।
নিকলী উপজেলার এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান আবুল হাশেম। এসএসসি পাস করেই ক্ষান্ত দেন লেখাপড়ার পাঠ। প্রথমে নিজের তিন পুত্রকে সাঁতারের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। তার জ্যেষ্ঠপুত্র এনামুল হক বাবার কাছে থেকে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেও হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ সাঁতারু। সেই যোগ্যতার বলেই এনামুল হক আজ চট্টগ্রাম সুইমিং ফেডারেশনের শীর্ষস্থানীয় সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দ্বিতীয় ছেলে নিয়ামুল হক সাঁতারে ভালো করার স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন সেনাবাহিনীর নন-কমিশন্ড চাকরি। সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট হিসেবে চাকরি করার পাশাপাশি নিয়ামুল হক এই বাহিনীর জাতীয় সাঁতার টিমের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আবুল হাশেমের তৃতীয় পুত্র নাজমুল হক হিমেলও একজন দক্ষ সাঁতারু হিসেবে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পড়ালেখার সুযোগ পান। নিজ যোগ্যতায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর হিমেল চীনের বেউজিং ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ লাভ করেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে তিনি সুইমিং ও খেলাধুলা বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। শুধু তাই নয়, হাশেম-তনয় হিমেল বর্তমানে চীনের ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭৩ থেকে ২০২১, এই দীর্ঘ সময়কালে সাঁতারু আবুল হাশেমের হাতে তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার দক্ষ সাঁতারু। যাদের অনেকেই শুধু সাঁতারে ভালো পারফরম্যান্স দেখানোর সুবাদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভ করেছেন। এখন পর্যন্ত তার কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া অন্তত চারশ তরুণ-তরুণী ওইসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আছে। তাদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে অন্তত ৩০ জন।
সাঁতার প্রশিক্ষক আবুল হাশেম ও তার শিক্ষার্থীরা আন্তঃস্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতাসহ জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগতায় অংশ নিয়ে অসংখ্যবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েও তার শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বা রানারআপ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তার অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একাধিকবার রেকর্ডসহ স্বর্ণ পদক লাভ করে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক একাধিক টুর্নামেন্টেও অংশ নিয়ে সফলতার পরিচয় দেন। বিশেষ করে কারার মিজান ও কারার ছামেদুল সাফ গেমসের বুকসাঁতার প্রতিযোগিতায় দু'বার স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ ছাড়া এ বছর আরিফুল ইসলাম অলিম্পিক গেমসের সাঁতার ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন।
সাঁতারের ক্ষেত্রে নিকলীর সাঁতারুরা সমগ্র বাংলাদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অন্তত ২৫টি জেলা ও ১৫টি ক্লাবের হয়ে আবুল হাশেমের শিক্ষার্থী সাঁতারুরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) আবুল হাশেমের দুই শতাধিক সাঁতারু বিভিন্ন ক্লাসে অধ্যয়নরত আছে। বাংলাদেশের সাঁতারশিল্পকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত হাওর উপজেলা নিকলীর একজন আবুল হাশেম প্রকৃত অর্থেই মূল কারিগর ও নিয়ামক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিকলী উপজেলা চত্বরের বিশাল পুকুরে তার অন্তত ৭০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে তিনি সাঁতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আশ্বিনের তপ্ত গরম শেষে কার্তিকের প্রারম্ভে লাগাতার বৃষ্টির পর নেমে আসে হালকা শীতের আমেজ। এমন শীতার্ত বিকেলে একঝাঁক শিশু-কিশোর আবুল হাশেমের নির্দেশনা মোতাবেক পুকুরের ঠান্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
গুনিয়াহাটি গ্রামের শিক্ষার্থী মারুফ ইসলাম শাওন, পূর্ব গ্রামের আতিক হাসান, মীরহাটি গ্রামের মো. বাবুল, পুকুরপাড় মহল্লার স্বর্ণালী, নগর মহল্লার ইশামনি ও করইহাটি মহল্লার পূর্ণিমা সূত্রধর এরা সবাই আবুল হাশেমের সাঁতারের ক্লাসের শিক্ষার্থী। তারা জানায়, হাশেম স্যারের মতো পিতৃসুলভ প্রশিক্ষকের কাছ থেকে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিতে পেরে তারা গর্বিত। স্যারের কাছ থেকে অর্জিত জ্ঞান তারা আগামীতে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য সাফল্য এনে দিতে চান।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল হাশেম জানান, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি প্রদত্ত সাঁতারে সেরা প্রশিক্ষক পুরস্কার ২০০৩, বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন প্রদত্ত সাঁতারের সেরা সংগঠক হিসেবে বিশেষ সম্মাননা ২০১৯। তিনি সাঁতারের সেরা সংগঠক হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশেনের সুইমিং কোচ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই ফেডারেশনের সদস্য হিসেবেও আছেন। জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে জানতে চাইলে আবেগঘন কণ্ঠে আবুল হাশেম বলেন, সারাটা জীবন সাঁতারের পেছনে ব্যয় করেছি। আমার স্ত্রী ও পরিবার এ ক্ষেত্রে বেশ সহযোগিতা করে। সাঁতারের মাধ্যমে জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি। সাফ গেমস ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আমার হাতে গড়া সাঁতারুরা যেদিন আরও বেশি স্বর্ণ পদক ছিনিয়ে আনতে পারবে, সেটাই হবে আমার পরম তৃপ্তি।'
লেখক :প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ