
চলছে মেধা যাচাই পরীক্ষা
মুক্তিপণের জন্য মানুষ অপহরণ, সন্ধ্যা নামলেই পথিকের কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনতাই আর বাড়ি থেকে গবাদি পশু চুরি- অপরাধমূলক এসব কর্মকাণ্ডের জন্য স্বাধীনতার আগে থেকেই বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জিয়ানগর (একজন পীরের নামে নামকরণ) ইউনিয়ন হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের জনপদ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও কিছু দুর্বৃত্তের সেই তৎপরতা অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও অতীতের দুর্বৃত্তপনার ইতিহাস যেন জিয়ানগরের পিছু ছাড়েনি।
সুফী সাধক জিয়াউদ্দিন আহসানের (জিয়াউদ্দিন পীর নামে অধিক পরিচিত) নামানুসারে জিয়ানগর কখন কীভাবে দুর্বৃত্তদের আখড়ায় পরিণত হলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুর রহিম বগ্রার মতে, জিয়ানগর যে থানার অধীন সই দুপচাঁচিয়া থানা থেকে তার অবস্থান (প্রায় ১০ কিলোমিটার) এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যাতায়াত কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।
নিজেদের জন্মস্থান জিয়ানগর সম্পর্কে ভিন উপজেলা বা জেলার মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এলাকার অন্যদের মতো স্থানীয় চার তরুণকেও খুব কষ্ট দেয়। তারা কলেজে পড়ার সময়ই জিয়ানগরের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। সেই চারজনের তিনজন- লুৎফর রহমান লিটন, তারিকুল ইসলাম ও কমল চন্দ্র পাল যখন ২০০৪ সালে যথাক্রমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান তখন নিজ ইউনিয়নের গ্রামের ঘরে ঘরে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সঙ্গে নেন তোতা মিয়া নামে নিজ এলাকায় তাদের আরেক সহপাঠীকে। তাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা বিস্তারে এমন একটি চেইন বা শৃঙ্খল সৃষ্টি করা, যাতে জিয়ানগর থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেরা এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যেন তাদের নিচের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে পারে।
লুৎফর রহমান লিটন জানান, জিয়ানগর ইউনিয়ন থেকে তাদের আগে কেউ বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি। তাই ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা তাদের নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি বলেন, যেহেতু গ্রামবাসী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাই আমরা গ্রামগুলোতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা জানানোর পর তারা খুব উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। এমনকি আমরা যখন স্থানীয় স্কুল-কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছে আমাদের পরিকল্পনার কথা বলি তখন তারাও সমর্থন দেন। তারপর থেকে যখনই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি হতো তখনই নিজ এলাকায় ফিরে স্কুলগুলোতে গিয়ে ক্লাস নিতাম।
আরেক সহপাঠী তোতা মিয়া জানান, ২০০৪ সাল থেকে তিনিসহ তার অপর তিন বন্ধু মিলে জিয়ানগর ইউনিয়নের অধীন দুই মাদ্রাসা ও তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিযোগিতামূলক সব পরীক্ষায় ভালো করতে পারে সেজন্য সিলেবাসের বাইরে গিয়েও তারা পড়ত। এই কার্যক্রমে যারা আমাদের এক অথবা দুই ক্লাস নিচে পড়ত তারাও যুক্ত হয়। তাদের মধ্যে দু'জন পরবর্তী সময়ে বুয়েটে, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। এরপর আরও ছোট ভাইবোন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। তাদের সবার সহযোগিতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে জিয়ানগরে 'শিক্ষা মেলা'র আয়োজন করা হয়। ওই বছরই যখন আমাদের চার বন্ধুর পড়ালেখা শেষ হলো তখন আমরা আমাদের উদ্যোগটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য ২০১০ সালে 'এডুকেশন ফাউন্ডেশন' নামে একটি সংগঠন দাঁড় করাই।
এডুকেশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর উদ্যোক্তারা তাদের শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রম শুধু অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও বৃহৎ পরিসরে- প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারই অংশ হিসেবে তারা জিয়ানগর ইউনিয়নের আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল পর্যায়ের দুই মাদ্রাসা ও তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি কলেজ ও আরেকটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন। তারা মেধা যাচাই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত 'গণিত অলিম্পিয়াড' এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে 'কুইজ' প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
উদ্যোক্তাদের অনুপস্থিতিতেও গতিশীল
এডুকেশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চার তরুণের একজন প্রকৌশলী লুৎফর রহমান লিটন ২০১২ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী কমল চন্দ্র পাল ২০১১ সালে বাংলাদেশে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি নেওয়ার পাঁচ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনায় পিএচডি করছেন। অপর দু'জনের মধ্যে তারিকুল ইসলাম রুবেল জয়পুরহাটের একটি উপজেলায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা। আর তোতা মিয়া তার নিজ উপজেলা দুপচাঁচিয়ায় বেসরকারি একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন।
তবে তারা চারজন এলাকার বাইরে থাকলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। বরং তারা যাদের সহযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাদের এবং তার পরের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এডুকেশন ফাউন্ডেশন আরও গতিশীল হয়েছে। সংগঠনের চার প্রতিষ্ঠাতার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০১৬ সালের পর এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ধীরে ধীরে পাশের জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল উপজেলা এবং বগুড়ার শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রাম উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে এডুকেশন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্বাচিত কয়েকটি স্কুলে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় জিয়ানগর ইউনিয়নের ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু করা এডুকেশন ফাউন্ডেশন ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই জেলার পাঁচ উপজেলার ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কর্ম-এলাকার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি সংগঠনটিতে আরও নতুন নতুন কার্যক্রম যুক্ত হয়। এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কল্যাণে গত দেড় দশকে ওই পাঁচ উপজেলায় অর্ধশত শিক্ষার্থী দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। করোনা শেষে স্কুল-কলেজগুলো পুরোদমে চালু হলে ওই কার্যক্রমগুলো আবারও এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মেধাবীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাবৃত্তি
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এ অঞ্চলের অনেক মেয়েকে এসএসসি কিংবা এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই বিয়ে দেওয়া হয়। আর ছেলেদের মধ্যেও অভাবের কারণে অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হন। এমন অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেদের চাঁদা এবং দেশ-বিদেশে অবস্থানরত তাদের সহপাঠী ও বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তার অর্থ দিয়ে ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষাবৃত্তি চালু করেন। বর্তমানে আটজনকে এই বৃত্তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের একজন জিয়ানগর ইউনিয়নের বাসিন্দা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমার বাবা কৃষক। আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তখন আমি এডুকেশন ফাউন্ডেশনে বৃত্তির জন্য আবেদন করি। এরপর সংগঠন থেকে আমাকে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।'
চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা
দরিদ্রের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে এডুকেশন ফাউন্ডেশন। কয়েক বছর আগে তারা জয়নাল আবেদীন নামে জিয়ানগরের এক শিক্ষার্থীর ব্রেন টিউমারের চিকিৎসায় কয়েক ধাপে ছয় লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আরও বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয় হয়েছে। এর পাশাপাশি করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া বিপুল সংখ্যক মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এক লাখ তালবীজ রোপণ কর্মসূচি
সাম্প্রতিককালে গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে গেছে। যেহেতু তালগাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তাই জিয়ানগরসহ দুই জেলার পাঁচ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে এক লাখ তালবীজ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে এডুকেশন ফাউন্ডেশন। গত ১ অক্টোবর থেকে এ কার্যক্রম শুরু করার পর ১৫ দিনে ৯ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।
লেখক: ব্যুরো প্রধান, বগুড়া
সুফী সাধক জিয়াউদ্দিন আহসানের (জিয়াউদ্দিন পীর নামে অধিক পরিচিত) নামানুসারে জিয়ানগর কখন কীভাবে দুর্বৃত্তদের আখড়ায় পরিণত হলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুর রহিম বগ্রার মতে, জিয়ানগর যে থানার অধীন সই দুপচাঁচিয়া থানা থেকে তার অবস্থান (প্রায় ১০ কিলোমিটার) এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যাতায়াত কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।
নিজেদের জন্মস্থান জিয়ানগর সম্পর্কে ভিন উপজেলা বা জেলার মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এলাকার অন্যদের মতো স্থানীয় চার তরুণকেও খুব কষ্ট দেয়। তারা কলেজে পড়ার সময়ই জিয়ানগরের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। সেই চারজনের তিনজন- লুৎফর রহমান লিটন, তারিকুল ইসলাম ও কমল চন্দ্র পাল যখন ২০০৪ সালে যথাক্রমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান তখন নিজ ইউনিয়নের গ্রামের ঘরে ঘরে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সঙ্গে নেন তোতা মিয়া নামে নিজ এলাকায় তাদের আরেক সহপাঠীকে। তাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা বিস্তারে এমন একটি চেইন বা শৃঙ্খল সৃষ্টি করা, যাতে জিয়ানগর থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেরা এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যেন তাদের নিচের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে পারে।
লুৎফর রহমান লিটন জানান, জিয়ানগর ইউনিয়ন থেকে তাদের আগে কেউ বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি। তাই ওই ইউনিয়নের বাসিন্দারা তাদের নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি বলেন, যেহেতু গ্রামবাসী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাই আমরা গ্রামগুলোতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা জানানোর পর তারা খুব উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। এমনকি আমরা যখন স্থানীয় স্কুল-কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছে আমাদের পরিকল্পনার কথা বলি তখন তারাও সমর্থন দেন। তারপর থেকে যখনই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি হতো তখনই নিজ এলাকায় ফিরে স্কুলগুলোতে গিয়ে ক্লাস নিতাম।
আরেক সহপাঠী তোতা মিয়া জানান, ২০০৪ সাল থেকে তিনিসহ তার অপর তিন বন্ধু মিলে জিয়ানগর ইউনিয়নের অধীন দুই মাদ্রাসা ও তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিযোগিতামূলক সব পরীক্ষায় ভালো করতে পারে সেজন্য সিলেবাসের বাইরে গিয়েও তারা পড়ত। এই কার্যক্রমে যারা আমাদের এক অথবা দুই ক্লাস নিচে পড়ত তারাও যুক্ত হয়। তাদের মধ্যে দু'জন পরবর্তী সময়ে বুয়েটে, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। এরপর আরও ছোট ভাইবোন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। তাদের সবার সহযোগিতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে জিয়ানগরে 'শিক্ষা মেলা'র আয়োজন করা হয়। ওই বছরই যখন আমাদের চার বন্ধুর পড়ালেখা শেষ হলো তখন আমরা আমাদের উদ্যোগটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য ২০১০ সালে 'এডুকেশন ফাউন্ডেশন' নামে একটি সংগঠন দাঁড় করাই।
এডুকেশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর উদ্যোক্তারা তাদের শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রম শুধু অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও বৃহৎ পরিসরে- প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারই অংশ হিসেবে তারা জিয়ানগর ইউনিয়নের আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল পর্যায়ের দুই মাদ্রাসা ও তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি কলেজ ও আরেকটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন। তারা মেধা যাচাই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত 'গণিত অলিম্পিয়াড' এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে 'কুইজ' প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
উদ্যোক্তাদের অনুপস্থিতিতেও গতিশীল
এডুকেশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চার তরুণের একজন প্রকৌশলী লুৎফর রহমান লিটন ২০১২ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী কমল চন্দ্র পাল ২০১১ সালে বাংলাদেশে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি নেওয়ার পাঁচ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনায় পিএচডি করছেন। অপর দু'জনের মধ্যে তারিকুল ইসলাম রুবেল জয়পুরহাটের একটি উপজেলায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা। আর তোতা মিয়া তার নিজ উপজেলা দুপচাঁচিয়ায় বেসরকারি একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন।
তবে তারা চারজন এলাকার বাইরে থাকলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। বরং তারা যাদের সহযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাদের এবং তার পরের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এডুকেশন ফাউন্ডেশন আরও গতিশীল হয়েছে। সংগঠনের চার প্রতিষ্ঠাতার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০১৬ সালের পর এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ধীরে ধীরে পাশের জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল উপজেলা এবং বগুড়ার শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রাম উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে এডুকেশন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্বাচিত কয়েকটি স্কুলে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় জিয়ানগর ইউনিয়নের ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু করা এডুকেশন ফাউন্ডেশন ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই জেলার পাঁচ উপজেলার ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। কর্ম-এলাকার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি সংগঠনটিতে আরও নতুন নতুন কার্যক্রম যুক্ত হয়। এডুকেশন ফাউন্ডেশনের কল্যাণে গত দেড় দশকে ওই পাঁচ উপজেলায় অর্ধশত শিক্ষার্থী দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। করোনা শেষে স্কুল-কলেজগুলো পুরোদমে চালু হলে ওই কার্যক্রমগুলো আবারও এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মেধাবীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাবৃত্তি
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এ অঞ্চলের অনেক মেয়েকে এসএসসি কিংবা এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই বিয়ে দেওয়া হয়। আর ছেলেদের মধ্যেও অভাবের কারণে অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হন। এমন অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেদের চাঁদা এবং দেশ-বিদেশে অবস্থানরত তাদের সহপাঠী ও বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তার অর্থ দিয়ে ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষাবৃত্তি চালু করেন। বর্তমানে আটজনকে এই বৃত্তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের একজন জিয়ানগর ইউনিয়নের বাসিন্দা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমার বাবা কৃষক। আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তখন আমি এডুকেশন ফাউন্ডেশনে বৃত্তির জন্য আবেদন করি। এরপর সংগঠন থেকে আমাকে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।'
চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা
দরিদ্রের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে এডুকেশন ফাউন্ডেশন। কয়েক বছর আগে তারা জয়নাল আবেদীন নামে জিয়ানগরের এক শিক্ষার্থীর ব্রেন টিউমারের চিকিৎসায় কয়েক ধাপে ছয় লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আরও বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয় হয়েছে। এর পাশাপাশি করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া বিপুল সংখ্যক মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এক লাখ তালবীজ রোপণ কর্মসূচি
সাম্প্রতিককালে গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে গেছে। যেহেতু তালগাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তাই জিয়ানগরসহ দুই জেলার পাঁচ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে এক লাখ তালবীজ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে এডুকেশন ফাউন্ডেশন। গত ১ অক্টোবর থেকে এ কার্যক্রম শুরু করার পর ১৫ দিনে ৯ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।
লেখক: ব্যুরো প্রধান, বগুড়া
মন্তব্য করুন