পেশায় তিনি একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক। সে হিসেবে প্রতিদিন নিয়ম করে কলেজে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শেষে বাসায় ফিরে পরিবারকে সময় দেওয়ার কথা। অন্যসব চাকরিজীবী যেভাবে জীবনযাপন করেন, তিনিও সেভাবে কাটাতে পারতেন আরাম-আয়েশে। কিন্তু পারেননি। অতীত তাকে টেনে নিয়ে যায় সমাজের বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে। তিনি জানেন অভাবের যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ। বিপদে পড়লে মানুষ কতটা অসহায়ত্ব বোধ করে। তাই তো চাকরির ফাঁকে ছুটে যান সেইসব অসহায় মানুষের পাশে। বাড়িয়ে দেন বন্ধুর হাত। সে হাত ধরে বিপদসংকুল মানুষ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
তিনি হলেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলী, চোখের সামনে কোনো মানবিক বিপর্যয় দেখলেই ছুটে যান সেখানে। এলাকার মানুষদের কাছে তিনি শুধু একজন শিক্ষকই নন, বিপদের বন্ধু হিসেবেই অধিক পরিচিত।
তার সহযোগিতায় খুলনার কয়রা উপজেলার পঙ্গু রফিকুল করাতি, বিধবা হাজেরা খাতুন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হাবিবুল্লাহসহ এ পর্যন্ত ৫০টি অবলম্বনহীন পরিবারের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। বিশেষ করে স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীদের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এসব পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, একসময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করেছেন প্রভাষক ইদ্রিস আলী। তার সহযোগিতায় একটু একটু করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন তারা।
ইদ্রিস আলীর জন্ম সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রকাটী গ্রামে হলেও তার লেখাপড়া ও বেশিরভাগ সময় কেটেছে কয়রা উপজেলায়। দিনমজুর বাবার নয় সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটনে বেড়ে উঠতে হয়েছে তাকে। ২০১০ সালে কয়রা উপজেলার কালনা আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের পর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান ইদ্রিস। কিন্তু ভর্তির টাকা জোগাড় করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির গরু বিক্রির টাকা দিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর শুরু হয় জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। দিনমজুর বাবার পক্ষে পড়ালেখার খরচ বহন করা সম্ভব না হওয়ায় টিউশনি শুরু করেন তিনি। কণ্টকাকীর্ণ বাধার পাহাড় পেরিয়ে নিজের টাকায় শেষ করেছেন লেখাপড়া। স্নাতকোত্তরের পর প্রথমবারেই ৩৫তম বিসিএসে হয়ে যান শিক্ষা ক্যাডার। যোগ দেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। চাকরিতে যোগদান করে সবাই যখন আরাম-আয়েশে দিন কাটাতে ব্যস্ত, তখন মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। সময় পেলেই ছুটে চলেছেন অসহায় মানুষের কাছে।
ইদ্রিস আলী বলেন, 'ছোট থেকে দেখেছি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার দৃশ্য। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা, বুলবুল, আম্পান, ইয়াসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে এ অঞ্চলের মানুষ নিরুপায়। এখানে প্রায় সারাবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। ছোটবেলায় কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি দুর্যোগে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। তখন সংকল্প ছিল প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার।'
সে লক্ষ্যে চাকরির বেতনের অর্ধেক ও নিজ গ্রামের দুই শিক্ষার্থীর সংগ্রহ করা অর্থে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'হিউম্যানিটি ফার্স্ট'। 'আগে মানবতা, পরে অন্য কথা' এ স্লোগানে সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে কয়রা উপজেলার কালনা গ্রামের উবায়দা নামের এক অসহায় শিশুর হার্টের ছিদ্র অপারেশনে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ১৫৭ জন অসচ্ছল রোগীকে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে দেশ ও দেশের বাইরে চিকিৎসা শেষে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে এ সংগঠন।
কেবল তাই নয়, সংগঠনের ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবকের উদ্যোগে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০টি প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫টি অসহায় ও ভূমিহীন পরিবারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। দু'জন ভিক্ষুককে ঘর নির্মাণসহ তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বহন ও বিভিন্ন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে ফি দিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে সাহায্য, সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে একটি স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে দরিদ্রদের মাঝে পোশাক বিতরণ, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য রক্তের ব্যবস্থা এবং অসহায় ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটির সদস্যরা।
সম্প্রতি কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন কাটকাটা গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে 'লঞ্চঘাট পাঠাগার'। লঞ্চঘাটে অপেক্ষারত যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন ইদ্রিস আলী। এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে এলাকায় এবং এলাকার বাইরে।
সংগঠনের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন ইদ্রিস আলী। দুর্যোগকালীন সরকারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেকসই উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এর মধ্যে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, স্যানিটারি টয়লেট ও নিরাপদ পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে নৌকা, ভ্যান ও সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। মসজিদ সংস্কার এবং শিশুদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলার সামগ্রীও বিতরণ করেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া করোনাকালীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাসহ কয়েকজনের নিয়মিত চাঁদা প্রদান এবং সমাজের হৃদয়বান মানুষদের সহযোগিতায় এগিয়ে চলেছে সংগঠনটি। 'হিউম্যানিটি ফার্স্ট নামে ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ আছে তাদের। এখানে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। কাউকে সহযোগিতার আগে প্রথমে তার সম্পর্কে সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে সবাই মিলে পরামর্শ করে অর্থ জোগাড়ে ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দেন সদস্যরা। এভাবে দেশ ও বিদেশের অনেকে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে বলে জানান সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা।
ইদ্রিস আলী বলেন, 'আমরা আমাদের কাজের স্বীকৃতি আশা করি না। মানবিক কাজের মধ্যে অন্যরকম শান্তি আছে। যখন কোনো অসহায়, দুস্থ মানুষকে সাহায্যের মাধ্যমে তার মুখে হাসি ফোটাতে পারি, তখন হৃদয়টা প্রশান্তিতে ভরে যায়। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে বিধবা, প্রতিবন্ধীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের স্থায়ী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তহবিল গঠন করা উল্লেখযোগ্য।'

লেখক: ব্যুরো প্রধান, খুলনা