'তরুণ বয়সে অনেকেই স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। সাহস করে কেউ স্বপ্ন দেখলেও সেটার পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, না হয় কম। স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা চাই। তবেই একদিন স্বপ্ন পূরণ হবে'- বলছিলেন গাজীপুরের সফলতম তরুণ উদ্যোক্তা তোফাজ্জল হোসেন। এক সময়ের চাল-চুলোহীন বেকার তোফাজ্জল এখন নিজেই এক অনুপ্রেরণার গল্প। অদ্যম ইচ্ছা, সাহস, সততা আর সাধনার সমন্বয়ে তোফাজ্জল আজ তিল থেকে তিলোত্তমা গড়েছেন। এরই মধ্যে চলে গেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পাথারপাড়া গ্রামের প্রয়াত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন একটি অঞ্চলকে আলোকিত করেছেন। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে তার হাত ধরেই শ্রীপুরের পশ্চিমাঞ্চলে পোলট্রি শিল্পের যাত্রা।
তখন তোফাজ্জল ১৪-১৫ বছরের কিশোর। অভাব-অনটন আর দুর্বিপাকে খেয়ে না খেয়ে পিতার সঙ্গে দিনান্ত পরিশ্রমে চেষ্টা করেছেন পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। স্বজনরা আয় রোজগারের একটা পথ বেছে নেওয়ার তাগিদ দিতে থাকেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা বা পুঁজি কিছুই ছিল না তার। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসার ধারণা পেলেও স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। এরই মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলার সালনা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে উঠানে ব্রয়লার মুরগি পালনের একটি খামার নজরে আসে তার। এই খামার তাকে উৎসাহিত করে। বাড়ি ফিরে নেমে পড়েন পুঁজি জোগাড় করতে। ছয় মাসের চেষ্টায় সামান্য পুঁজির ব্যবস্থাও করেন তিনি। এরপর নিজ বাড়ির আঙিনায় অল্প খরচে একটি ছাপরা ঘর তুলে ছোট পরিসরে ৩০০ ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করেন। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে তিন হাজার টাকা লাভ হয়। সামান্য এ লাভ থেকেই সাহস পান মনে। পরের ধাপে ঋণ করে ৫০০ লেয়ার মুরগি কিনে আনেন। কিন্তু এর ২৫ দিনের মাথায়ই স্বপ্নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় 'গাম্বা রোগ'। ২০০ মুরগি মারা যায়, পুঁজিও হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু দমে যাননি তোফাজ্জল। সফল যে তাকে হতেই হবে। আবারও কিছু টাকা সংগ্রহ করেন, এবার কিনেন ৫০০ ব্রয়লার মুরগি। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে লাভ হয় আট হাজার টাকা। শুরুর দিকে কাঠের বাক্স তৈরি করে এর ভেতরে মেঝেতে মুরগি পালন করতেন। পরে বিআরডিবি থেকে ১৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খাঁচা কেনেন। এক পর্যায়ে পুরোদমে ডিম উৎপাদন শুরু হয়ে যায় খামারে। একই সঙ্গে চলতে থাকে খামার সম্প্রসারণে কাজ। পাশাপাশি পোলট্রিবিষয়ক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা খামার ঘুরে দেখতে থাকেন, খামারিদের কাছ থেকে নেন বাস্তবিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান। পোলট্রি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বই-পুস্তকও সংগ্রহ করে পড়তে থাকেন।
তিনশ মুরগি দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেন তোফাজ্জল, কয়েক বছরের ব্যবধানে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিজ চেষ্টা, আগ্রহ আর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে প্রসার ঘটতে থাকে খামারের। সাফল্যের পালকে ইতোমধ্যে আরও যুক্ত হয়েছে রাইস মিল, ফিড মিল, ফিশারিজ, দুগ্ধ খামার, মেডিসিন সেন্টার ইত্যাদি। বর্তমানে তোফাজ্জলের খামারে রয়েছে ৫০ হাজার মুরগি। সব মিলিয়ে তার শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ জন। মায়ের নামে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান 'আজিরন ফিড অ্যান্ড মেডিসিন সেন্টারে' রয়েছে ডিমের বড় আড়ত। তোফাজ্জলের খামারের ডিম ছাড়াও আশপাশের খামারগুলোর লক্ষাধিক ডিম প্রতিদিন এই আড়ত থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। লাভের একটা অংশ পান তোফাজ্জল হোসেন।
পোলট্রি নগরীখ্যাত শ্রীপুরে যে ক'জন উদ্যেক্তা সর্বপ্রথম এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন তোফাজ্জল তাদের মধ্যে একজন। শুরুর দিকে বন্ধু-বান্ধব ও এলাকার লোকজন তিরস্কার করত। পোলট্রি খামার গড়া দেখে পাগলও বলত কেউ কেউ। কিন্তু অন্যের কথায় কর্ণপাত করার সময় তার কখনোই ছিল না। বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে আশপাশের হাজার হাজার মুরগি মারা গেলেও তোফাজ্জলের খামারের কোনো ক্ষতি হয়নি। পোলট্রি খামারের লাভের টাকায় তোফাজ্জল জমি, বাড়ি, গাড়ি সবই করেছেন। খামার করে শুধু তিনিই নিজেই প্রতিষ্ঠা পাননি, প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী ছয়-সাত গ্রামের শতাধিক বেকার যুবককে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে পোলট্রি গড়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, এর সুফল সম্পর্কে বুঝিয়েছেন মানুষকে। আগ্রহীদের মূলধন দিয়েছেন- ঘর তৈরি, বাচ্চা প্রদানসহ ওষুধ ও খাবারও সরবরাহ করতেন। অতঃপর মুরগি ডিম দেওয়ার পর অল্প অল্প করে সেই বেকারদের করেছেন ঋণমুক্তও। এভাবে অসংখ্য পরিবারে তিনি ফুটিয়েছেন সচ্ছলতার হাসি। মোমবাতি আর লালবাতির পরিবর্তে ওই এলাকার ঘরে ঘরে এখন জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি, মাথার ওপর ফ্যান। অর্থনৈতিকভাবে এলাকায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সমাজের অসহায় দরিদ্র মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান সর্বদা, বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। সফল খামারি হওয়ার সুবাদে পোলট্রিতে উচ্চ প্রশিক্ষণ গ্রহণে সরকারি খরচে ভিয়েতনামও গিয়েছেন একবার। ছেলের সার্বিক সাফল্য দেখে প্রয়াত হয়েছেন বাবা-মা দু'জনই। তার তিন ভাইয়ের সংসার এখনও যৌথ। একই চুলায় রান্না হয় সবার। এ ক্ষেত্রেও তিনি অনুকরণীয়।
নিজের সাফল্য নিয়ে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, 'নিজে কিছু করব, একদিন প্রতিষ্ঠিত হবো জীবনে, পরিবারের দায়িত্ব নিবো- এমন হাজারো ভাবনায় কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। ভাঙা ঘরে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। করোনা মহামারির সময় দেশের বেশিরভাগ খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা আর ভালোবাসা দিয়ে রাতদিন খামারে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছি। ফলে উল্লেখজনকভাবে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। লোকসানের মুখ দেখিনি।' তোফাজ্জল আরও যোগ করে বলেন, 'আমি একটা স্বপ্ন দেখতাম আর নিজের কাজকে ভালোবাসতাম। সেই সঙ্গে ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম। যার ফলাফল আজকের আমি।'
তোফাজ্জল হোসেন বর্তমান সময়ের তরুণদের হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে নানামুখী ক্ষুদ্রশিল্পে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান। তার মতে, বর্তমানে এসব কাজের অনেক পরিবেশ ও সুবিধা তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। যোগ্যতা অনুযায়ী স্বপ্ন দেখে সাহসিকতার সঙ্গে শুরু করতে হবে আর প্রয়োজন আন্তরিকভাবে পরিশ্রমের, সাফল্য আপনা-আপনি ধরা দেবে।
লেখক: প্রতিনিধি, গাজীপুর