
সাথীর কারখানা ঘুরে দেখছেন বিদেশি পর্যটক
সুঁই-সুতায় নিজের ভাগ্য বদলে ফেললেন পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাটুলিপাড়া গ্রামের সুমনা সুলতানা সাথী। সততা, নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা ও শৃঙ্খলা, সময়জ্ঞান একজন মানুষকে যে সফল করে তুলতে পারে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত সাথী।
সে ২০০৪ সালের কথা। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে অনার্স পড়া অবস্থায় পরিবারের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেন সাথী। স্বামী মনোয়ার হোসেনও বেকার। এ অবস্থায় তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। একদিকে পড়াশোনার খরচ চালানো ও সংসারের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সমস্যা ও হতাশা যেন পিছু ছাড়ছিল না সাথীর। এমন সময় মাথায় এলো মায়ের কাছে শেখা সেলাইয়ের কথা। সাথী সিদ্ধান্ত নিলেন সুঁই-সুতার সঠিক ব্যবহারে ভাগ্য বদলের।
শূন্য থেকে শুরু করে আজ তিনি দেশসেরা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা। নিজের জীবন যেমন বদলে ফেলেছেন, তেমনি স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তার মতো আরও হাজারো নারীকে। তিনি এখন পাবনার সবার কাছে 'সাথী আপা' হিসেবে পরিচিত। চলতি বছরই পেয়েছেন 'বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা'র পুরস্কার।
২০০৪ সালে ঘরে থাকা কাপড় দিয়ে সোফার চারটি কুশন কাভার তৈরি করে জমা দিলেন আড়ংয়ে। দুটি কাভার মনোনীত হওয়ায় পরে ৮০টি কুশন কাভার তৈরির অর্ডার পান। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সেগুলো তৈরি করে জমা দেওয়ার পরের মাসেই ৮০ হাজার টাকার কাজ পান সাথী।
এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সাথীকে। শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। গ্রামের নারীদের দিয়ে তৈরি হয় কুশন কাভার, বিছানার চাদর, সোফার কাভার, নকশিকাঁথা, পর্দা, টেবিল ক্লথ, কিডস ক্যারিয়ার, মেয়েদের কুর্তি, ছেলেদের ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও শিশুদের নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছেন তিনি। বর্তমানে খ্যাতনামা ফ্যাশন হাউস আড়ং, অঞ্জন'স, স্মার্টেক্স, লারিব-এ তার তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
সাথী জানালেন, পাটুলিপাড়া গ্রাম ছাড়াও পাবনা শহরে, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও চাটমোহর উপজেলার ১৫/১৬টি গ্রামে তার বুননের কাজ চলছে। প্রথম মাসে ৮০ হাজার টাকা, এরপর থেকে এক লাখ, দুই লাখ করে এখন কোনো কোনো মাসে ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার কাজও করেন তিনি। কাজের পাশাপাশি নিজের পড়াটাও চালিয়ে গেছেন। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে প্রাণিবিদ্যা থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যারা তার ক্রেতা ছিলেন তারা কুশন কাভার, বিছানার চাদর, সোফার কাভার, নকশিকাঁথা, পর্দা, টেবিল ক্লথ, কিডস ক্যারিয়ার, মেয়েদের কুর্তি, ছেলেদের ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও শিশুদের নানা পোশাক কেনার পর তারা তার কাজের খুব প্রশংসা করতেন। ক্রেতাদের প্রশংসা তার মনোবল ও সাহস আরও বাড়িয়ে দেয়। সময়ের সঙ্গে অর্ডার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কিন্তু পুঁজি না থাকায় আটকে যান। কিন্তু থেমে থাকেননি। বন্ধুদের সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে থাকেন। অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে পরিচিতি। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে বাটিক ও নকশার কাজ করা সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কাভার, শাল-চাদরের ব্যাপক চাহিদা বাড়তে লাগল। পরিস্থিতি বলে দিল এখন একটি নিজস্ব শোরুম দরকার। পুজি সংকটে ঘাবড়ে যান। সর্বশেষ দ্বারস্থ হন ব্যাংকের। সেখান থেকে প্রথমে মাত্র আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পাবনা শহরের রাধানগর কলেজ রোডে একটি দোকান দেন। নাম দিলেন 'এসআর হ্যান্ডিক্রাফটস'। আলাদীনের চেরাগের জাদুর মতো দ্রুত বদলে গেল সব। তার ডিজাইন করা কাপড়ের চাহিদা এমন বেড়ে গেল যে ডেলিভারি দিতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। সাথী বলেন, অল্প দিনেই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এসআর হ্যান্ডিক্রাফটসের পরিচিতি। তখন পাবনায় তিনিই ছিলেন প্রথম নারী উদ্যোক্তা। সাথী বলেন, 'আমি একাই ব্যবসাতে বসতাম, কাঁচামাল কিনতাম, হিসাব চালাতাম, পাইকারি অর্ডার নিতাম। নারী হয়ে দোকানে বসে ক্রেতা সামলানোর বিষয়টি তখন অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু আমার স্বামী সব সময় উৎসাহ দিতেন। এরপর প্রায় শূন্য থেকে আজকের এই অবস্থান। ব্যবসার পাশাপাশি সংসারের দেখভাল করতে হয়েছে। ফলে অবসর বলে কিছু ছিল না। তবে ব্যবসা মেয়েদের জন্য খুব কঠিন, এমনটি কখনও মনে হয়নি। চেষ্টা থাকলে যেকোনো নারীই ব্যবসা বা কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারবেন। পরিচিত কোনো মেয়ে যখন চাকরি করার কথা বলেন, আমি তাদের উৎসাহ দিই ব্যবসা করো। কারণ, আমাদের একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, চাকরি করব না, চাকরি দেব।'
এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যবসা দেখভাল করেন। স্বামীর বসতভিটায় দোতলা বাড়ি করেছেন। নিচতলায় দিয়েছেন কারখানা। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় করেছেন আরেকটি কারখানা। গ্রাম থেকে নকশার কাজ শেষে কারখানায় চলে যায় কাপড়। সেখানে সেলাই, ধোয়া ও ইস্ত্রির কাজ চলে। শুধু নিজের জীবনের গল্পই নয়, সুঁই-সুতার কাজে বদলে দিয়েছেন বিভিন্ন গ্রামের আরও সহস্রাধিক নারীর জীবন। সংসারের পাশাপাশি বুননের কাজ করে বাড়তি আয় করছেন তারা। সাথীর কারখানায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ৪৫ জন বেকার যুবকের।
সাথীর স্বামী মনোয়ার হোসেন জানান, যেসব এলাকায় আমাদের সেলাইয়ের কাজ হয় সেখানে একজন দলনেত্রী আছেন। তিনি তার দলের ৫০ জন কর্মীকে পরিচালনা করেন। এভাবে প্রত্যেক দলনেত্রীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য সরকার যদি আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তাহলে আরও উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসবে।
লেখক: প্রতিনিধি, পাবনা
সে ২০০৪ সালের কথা। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে অনার্স পড়া অবস্থায় পরিবারের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেন সাথী। স্বামী মনোয়ার হোসেনও বেকার। এ অবস্থায় তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। একদিকে পড়াশোনার খরচ চালানো ও সংসারের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সমস্যা ও হতাশা যেন পিছু ছাড়ছিল না সাথীর। এমন সময় মাথায় এলো মায়ের কাছে শেখা সেলাইয়ের কথা। সাথী সিদ্ধান্ত নিলেন সুঁই-সুতার সঠিক ব্যবহারে ভাগ্য বদলের।
শূন্য থেকে শুরু করে আজ তিনি দেশসেরা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা। নিজের জীবন যেমন বদলে ফেলেছেন, তেমনি স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তার মতো আরও হাজারো নারীকে। তিনি এখন পাবনার সবার কাছে 'সাথী আপা' হিসেবে পরিচিত। চলতি বছরই পেয়েছেন 'বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা'র পুরস্কার।
২০০৪ সালে ঘরে থাকা কাপড় দিয়ে সোফার চারটি কুশন কাভার তৈরি করে জমা দিলেন আড়ংয়ে। দুটি কাভার মনোনীত হওয়ায় পরে ৮০টি কুশন কাভার তৈরির অর্ডার পান। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সেগুলো তৈরি করে জমা দেওয়ার পরের মাসেই ৮০ হাজার টাকার কাজ পান সাথী।
এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সাথীকে। শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। গ্রামের নারীদের দিয়ে তৈরি হয় কুশন কাভার, বিছানার চাদর, সোফার কাভার, নকশিকাঁথা, পর্দা, টেবিল ক্লথ, কিডস ক্যারিয়ার, মেয়েদের কুর্তি, ছেলেদের ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও শিশুদের নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছেন তিনি। বর্তমানে খ্যাতনামা ফ্যাশন হাউস আড়ং, অঞ্জন'স, স্মার্টেক্স, লারিব-এ তার তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
সাথী জানালেন, পাটুলিপাড়া গ্রাম ছাড়াও পাবনা শহরে, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও চাটমোহর উপজেলার ১৫/১৬টি গ্রামে তার বুননের কাজ চলছে। প্রথম মাসে ৮০ হাজার টাকা, এরপর থেকে এক লাখ, দুই লাখ করে এখন কোনো কোনো মাসে ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার কাজও করেন তিনি। কাজের পাশাপাশি নিজের পড়াটাও চালিয়ে গেছেন। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে প্রাণিবিদ্যা থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যারা তার ক্রেতা ছিলেন তারা কুশন কাভার, বিছানার চাদর, সোফার কাভার, নকশিকাঁথা, পর্দা, টেবিল ক্লথ, কিডস ক্যারিয়ার, মেয়েদের কুর্তি, ছেলেদের ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও শিশুদের নানা পোশাক কেনার পর তারা তার কাজের খুব প্রশংসা করতেন। ক্রেতাদের প্রশংসা তার মনোবল ও সাহস আরও বাড়িয়ে দেয়। সময়ের সঙ্গে অর্ডার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কিন্তু পুঁজি না থাকায় আটকে যান। কিন্তু থেমে থাকেননি। বন্ধুদের সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে থাকেন। অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে পরিচিতি। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে বাটিক ও নকশার কাজ করা সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কাভার, শাল-চাদরের ব্যাপক চাহিদা বাড়তে লাগল। পরিস্থিতি বলে দিল এখন একটি নিজস্ব শোরুম দরকার। পুজি সংকটে ঘাবড়ে যান। সর্বশেষ দ্বারস্থ হন ব্যাংকের। সেখান থেকে প্রথমে মাত্র আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পাবনা শহরের রাধানগর কলেজ রোডে একটি দোকান দেন। নাম দিলেন 'এসআর হ্যান্ডিক্রাফটস'। আলাদীনের চেরাগের জাদুর মতো দ্রুত বদলে গেল সব। তার ডিজাইন করা কাপড়ের চাহিদা এমন বেড়ে গেল যে ডেলিভারি দিতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। সাথী বলেন, অল্প দিনেই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এসআর হ্যান্ডিক্রাফটসের পরিচিতি। তখন পাবনায় তিনিই ছিলেন প্রথম নারী উদ্যোক্তা। সাথী বলেন, 'আমি একাই ব্যবসাতে বসতাম, কাঁচামাল কিনতাম, হিসাব চালাতাম, পাইকারি অর্ডার নিতাম। নারী হয়ে দোকানে বসে ক্রেতা সামলানোর বিষয়টি তখন অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু আমার স্বামী সব সময় উৎসাহ দিতেন। এরপর প্রায় শূন্য থেকে আজকের এই অবস্থান। ব্যবসার পাশাপাশি সংসারের দেখভাল করতে হয়েছে। ফলে অবসর বলে কিছু ছিল না। তবে ব্যবসা মেয়েদের জন্য খুব কঠিন, এমনটি কখনও মনে হয়নি। চেষ্টা থাকলে যেকোনো নারীই ব্যবসা বা কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারবেন। পরিচিত কোনো মেয়ে যখন চাকরি করার কথা বলেন, আমি তাদের উৎসাহ দিই ব্যবসা করো। কারণ, আমাদের একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, চাকরি করব না, চাকরি দেব।'
এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যবসা দেখভাল করেন। স্বামীর বসতভিটায় দোতলা বাড়ি করেছেন। নিচতলায় দিয়েছেন কারখানা। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় করেছেন আরেকটি কারখানা। গ্রাম থেকে নকশার কাজ শেষে কারখানায় চলে যায় কাপড়। সেখানে সেলাই, ধোয়া ও ইস্ত্রির কাজ চলে। শুধু নিজের জীবনের গল্পই নয়, সুঁই-সুতার কাজে বদলে দিয়েছেন বিভিন্ন গ্রামের আরও সহস্রাধিক নারীর জীবন। সংসারের পাশাপাশি বুননের কাজ করে বাড়তি আয় করছেন তারা। সাথীর কারখানায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ৪৫ জন বেকার যুবকের।
সাথীর স্বামী মনোয়ার হোসেন জানান, যেসব এলাকায় আমাদের সেলাইয়ের কাজ হয় সেখানে একজন দলনেত্রী আছেন। তিনি তার দলের ৫০ জন কর্মীকে পরিচালনা করেন। এভাবে প্রত্যেক দলনেত্রীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য সরকার যদি আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তাহলে আরও উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসবে।
লেখক: প্রতিনিধি, পাবনা
মন্তব্য করুন