নীলফামারী জেলার নারী উদ্যোক্তা নার্গিস বেগম। নিয়েছেন টাই বানানোর ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। স্বপ্ন দেখেন নিজ এলাকার দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার এবং তাদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার। অদম্য এ নারী এখন অনেকের কাছে অনুকরণীয় একজন।
নার্গিস বেগম যখন এসএসসি পাস করেন, তখন একই এলাকার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বর্তমানে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী নার্গিস বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। এরপর কয়েকজন নারী-পুরুষ নিয়ে শুরু করেন টাই বানানোর কাজ। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে মাত্র ১৫ জন নিয়ে কাজ শুরু করলেও তা ধীরে ধীরে একটি বড় কারখানায় পরিণত হয়। এখন নার্গিস ব্যবসার টাকা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদেরও করেছেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি তিনতলা বাড়ি করেছেন নিজের টাকায়, যার তৃতীয় তলায় চলছে তার স্বপ্নের কারখানা। স্বামী মোশারফ হোসেন ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঢাকায় দিয়েছেন অফিস ও শোরুম। মূলত তার স্বামী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টাইয়ের অর্ডার নিয়ে থাকেন, যা নার্গিস তার কারখানায় প্রস্তুত করে সরবরাহ দিয়ে থাকেন। নার্গিস নিজেই প্রথম দিকে নিজ হাতে কালার তৈরি করতেন এবং প্রিন্ট, স্টিম ও ওয়াশ করতেন। দিনরাত শ্রমিকদের পাশাপাশি নিজেও পরিশ্রম করে একটু একটু করে পুঁজি বাড়িয়েছেন এবং শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে এখানে কাজ করছেন নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ১০০ জন শ্রমিক। আশপাশের বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে বাইরের প্রশিক্ষিত কাউকে কখনও কাজে নেননি। স্থানীয়দেরই নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে ধীরে ধীরে দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তর করে তুলেছেন। ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত টাই কারখানায় কাজ করে অসংখ্য মানুষ নিজেদের সংসার যেমন চালিয়েছেন, অনেকে কারখানায় কাজের পাশাপাশি টাইয়ের ব্যবসায়ও নিজেদের জড়িয়েছেন।
২০১৯ সালের শেষে শুরু হওয়া করোনা মহামারিতে বিগত দেড় বছর কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে তাকে। কারখানার বেকার শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছেন অন্য কাজে। দেড় বছরের বেশি সময় পর করোনার প্রকোপ কমে আসায় আবারও কারখানা চালু করেছেন নার্গিস বেগম। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এ সময় তাকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। টাই বানানোর ফেব্রিকস ও সুতা চীন থেকে আমদানি করতে হয়, আমদানি সমস্যায় এখন আগের মতো অর্ডার নিতে পারছেন না।
নার্গিসের এ কারখানার টাই স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে সরবরাহ করা হয়। ঢাকায় বঙ্গবাজারের কাছে নাজিরাবাজারের শোরুমটি করোনার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে আশা ছাড়েননি তিনি। পরিস্থিতি ভালো হলে আবারও শোরুম চালুর ইচ্ছা আছে তার। তার কারখানায় কাজ করছেন বর্তমানে মিনি, রুপালী, সীমা, মেরী, জুলেখা, পারভীন, মঞ্জু, ফজিলা, আর্জিনা, মনি, কেয়াসহ ২৫ জন নারী-পুরুষ। তাদের প্রিয় প্রাঙ্গণ আবারও কর্মমুখর হয়ে ওঠায় তারা অনেক খুশি। কর্মহীন থেকে গত দেড় বছরে এই মানুষগুলো সংসার চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নার্গিস আক্তার নিয়মিতই তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।
নিজের কাজ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নার্গিস জানালেন, বাংলাদেশে প্রথম হ্যান্ডমেট টাই নিয়ে আমিই কাজ শুরু করি। আমরা প্রিন্ট ও বিভিন্ন লোগো এখানেই তৈরি করি থাকি। করোনায় কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস-আদালত চলছে পুরোদমে, আমাদের কাজের মাত্রাও বাড়ছে দিন দিন। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই কারখানা স্থানান্তরিত করতে চাই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে চাই আমার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত টাই। পাশাপাশি নিজ জেলার বেকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলে তাদের বেকারত্ব ঘোচাতে আরও বেশি কাজ করতে চাই।
লেখক: প্রতিনিধি, নীলফামারী