বাংলাদেশের উত্তর জনপদের বৃহৎ চলনবিল বহুকাল আগে সমুদ্রসম, দিগন্তছোঁয়া বিশালত্ব ও ভয়ংকরীরূপ মানুষের মনে যেমন ভীতির সঞ্চার করত, তেমনি এর প্রশান্ত বুকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক নৈসর্গিকতা মনে এক অফুরন্ত প্রশান্তি এনে দিত। বর্ষা মৌসুমে সমুদ্রের মতো বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ত তীরে। শীত মৌসুমে ভিনদেশি নানা প্রজাতির পাখি আসে এখানে। বিলের নৈস্বর্গিক পরিবেশে আকৃষ্ট হয়ে সুদূর অতীতে মোগল, পাঠান, ইংরেজ শাসকরা এখানে এসেছে মৎস্য শিকার, নৌবিহার ও পাখি শিকার করতে। কিন্তু কালের বিবর্তন এবং মানুষের প্রয়োজনে রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট এবং নদীতীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কারণে উত্তর জনপদের বিশাল এই চলনবিল কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লে ঐতিহ্য হারায় বিলটি। এ ছাড়া মৎস্য শিকারে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করায় দেশি মাছসহ জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হতে থাকে। বিলের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শামুক নিধন এবং ফাঁদ পেতে অবাধে পাখি শিকার। ফলে হুমকির মুখে পড়ে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য।
এই সময়ের ১১ উদ্যমী যুবক চলনবিলের পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী হন। চলনবিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও পাখি রক্ষায় ২০১২ সালে নিজেদের প্রচেষ্টায় 'চলনবিলের ঐতিহ্য ধরে রাখব, সবাই মিলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করব'- এই স্লোগান নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি'। চলনবিল অধ্যুষিত তিন জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির কর্মএলাকা নির্ধারণ করা হয়। জেলাগুলো হলো নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা। উপজেলাগুলো হলো নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলা এবং পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা। চলনবিলের বিলহালতি ত্রিমোহনী কলেজের ভূগোলের শিক্ষক আখতারুজ্জামানকে সভাপতি এবং সাংবাদিক সাইফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট 'চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি'র কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। এই কমিটির অপর নয় সদস্য হলেন- ডা. নূর আহমেদ শেখ, মো. সাকিবুল হাসান, প্রভাষক হারুন-অর-রশিদ, মো. সাইফুল ইসলাম বাবু, মহসিন আলম, প্রভাষক জাকিয়া পারভীন ও মোছা. ফজিলাতুন্নেছা (শাপলা)। এই কমিটির সদস্যরা চলনবিলাঞ্চলে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধনে বানার বাঁধ, সোঁতি ও বাদাই জালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং বিলের বক, বন্যপ্রাণীসহ অন্যান্য অতিথি পাখি শিকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিতকরণসহ বৃক্ষরোপণ ও গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ঢাকা, রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বিলের পাখি-শামুক-ঝিনুক-বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনগণ ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে সচেতনতামূলক সভা, সেমিনার আয়োজন ও চলনবিলে পাখি শিকারিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান ও ইয়ারগান জব্দে প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতা করতে থাকে। পাশাপাশি চলনবিলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন সময় দুস্থ এবং শীতার্তদের মাঝে নগদ অর্থ, শীতবস্ত্র বিতরণ এবং সমাজের নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষকে সহযোগিতা করে আসছে।
২০১৪ সালে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্যা রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগসহ তাকে নিয়ে সেমিনার ও মানব প্রাচীর রচনা করার মাধ্যমে কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। চলনবিলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় কমিটির বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১০১ জন। কমিটিতে রয়েছেন- শিক্ষক, সমাজসেবক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষার্থী, যুবক ও তরুণ। সদস্যদের সকলেই পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে চলেছেন। এসব সদস্যের অনেকেই চলনবিলের দুর্গম গ্রামে বাস করেন। কমিটির সদস্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ও সহযোগিতায় পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে চালানো হয় অভিযান। গত কয়েক বছরে এই কমিটির সদস্যদের অভিযানে বক, বালিহাঁস, গাং শালিক, চাকলা, ঘুঘু, তিতির, শামুককল ও টিয়া পাখিসহ প্রায় ছয় সহস্রাধিক অতিথি পাখি শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়। এর মধ্যে কেবল চলতি বছরের এই ক'মাসে এক হাজারেরও বেশি পাখি শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিপন্ন প্রজাতির হিমালয়ী একটি শকুন, একটি বাগডাশ বন্যপ্রাণী ও তিনটি মেছো বাঘের ছানা ও একটি গন্ধগোকুল উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়। অভিযানে পাখি শিকারে ব্যবহূত তিনটি ইয়ারগান জব্দসহ কয়েকশ ফাঁদ ধ্বংস করা হয়। আটক করা হয় অন্তত ৫০ জনকে।
চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষার কাজে শুরুতে তারা সচেতনতামূলক প্রচারণার অংশ হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠকসহ লিফলেট বিতরণ করেছেন। প্রথমদিকে পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযানে গেলে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু তারা ভীত না হয়ে প্রায় প্রতিদিনই দুর্গম গ্রামে গিয়ে অভিযান চালিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ তাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের প্রতিটি সদস্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্গম গ্রামে ছুটে গিয়ে পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। সকালের সূর্য ওঠার আগেই আমরা ক'জন চলনবিলের দুর্গম পথ পেরিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে শিকারিদের বন্দিদশা থেকে পাখিদের মুক্ত করছি।
পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তারা চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি টানিয়ে পাখিদের আবাস বানিয়ে দিয়েছেন। ২০১৭ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল আহসানের সহায়তায় গাছে গাছে শতাধিক মাটির হাঁড়ি টানিয়ে পাখিদের আবাসস্থল বিনির্মাণ করা হয়। গত বছর বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য ও পাখি রক্ষায় ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ হিসেবে শীতকালে চলনবিলের পাখি শিকারিকে ধরিয়ে দেওয়ায় পুরস্কার হিসেবে কুড়িটি শীতবস্ত্র (কম্বল) বিতরণ করা হয়।
১১ সদস্যের চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সদস্যরা জানালেন, তারা স্বইচ্ছায় ও আন্তরিকভাবে চলনবিলকে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কাজও করে যাচ্ছি। আমাদের কমিটি শুধু পাখি শিকারিদের ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে না, চলনবিলের সর্বত্র পরিবেশবাদী মানুষ তৈরি বা তাদের খুঁজে বের করা এবং চলনবিলের জলজ উদ্ভিদের নাম, ১৩০ প্রজাতির মাছের নাম, চলনবিলের হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির ধানের নাম, চলনবিলের ব্যবহূত বিভিন্ন দ্রব্যাদি, চলনবিলের আগত পাখি ও বসবাসকারী পাখির নাম সংগ্রহে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের নাম (বিশেষত শতবর্ষী বৃক্ষের নাম), চলনবিলে উৎপাদিত বিভিন্ন শস্য এবং চলনবিলের জেলেদের বর্তমান অবস্থা ও চলনবিলে যাতায়াতের জন্য ব্যবহূত বিভিন্ন নৌযান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার কাজও করা হচ্ছে।
লেখক: প্রতিনিধি, নাটোর