নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রম আর চেষ্টা থাকলে কী না সম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ি ইউনিয়নের কাশিমালা উত্তরপাড়া গ্রামের অর্ধশিক্ষিত এক যুবক- চঞ্চল হোসেন, বয়স ৩০। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি না পেরোলেও অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদনে এলাকায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার মৎস্যখামার থেকে সারাদেশে এখন সরবরাহ হচ্ছে দেশি মাছের রেণু ও পোনা। শুধু তাই নয়, তার দেখাদেখি গ্রামের অর্ধশতাধিক যুবক মাছ চাষে হয়েছেন স্বাবলম্বী। পাশের জয়পুরহাট জেলা সদরসহ নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজিহাট এলাকায় গড়ে উঠেছে অনুরূপ আরও দুটি মৎস্যখামার। এ ছাড়া চঞ্চলের দেশি প্রজাতির মৎস্যখামার প্রতিষ্ঠার পর গ্রামের চিত্রও পাল্টে গেছে। ওই এলাকার মানুষ হয়েছেন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। আর এই মাছের রেণু ও পোনা বিক্রি করে এক সময়ের খামারের শ্রমিক চঞ্চল হোসেন এখন কোটিপতি, হয়েছেন জিরো থেকে হিরো। বর্তমানে গ্রামে ২০ কাঠা জমির ওপর তিনতলা ভবন। ওই ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলাসহ রয়েছে তিনটি খামার। নিজের নামে দুটি চঞ্চল মৎস্য হ্যাচারি এবং মেয়ের নামে সুবর্ণা মৎস্য হ্যাচারি একটি। এ ছাড়া দুটি মিনি ট্রাকসহ পাঁচ থেকে ছয় বিঘা আয়তনের ১৩টি পুকুর।
কাশিমালা উত্তরপাড়া গ্রামের সাইদুর রহমান ও সুফিয়া বেগমের একমাত্র সন্তান চঞ্চল হোসেন। মাত্র দুই বছর বয়সে মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা বিয়ে করে পৃথকভাবে সংসার শুরু করেন, মাও চলে যান অন্যের ঘরে। শিশু চঞ্চলের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে দাদা-দাদির ওপর। সেখানেও অভাবের সংসার। চার বছর বয়সে চঞ্চলের ঠাঁই হয় শিক্ষক মোফাজ্জল হোসেনের বাড়িতে। ওই বাড়িতে ৯ বছর বয়স পর্যন্ত জীবন কাটে তার। এ সময় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ হয়। এরপর পাশের বগুড়ার সান্তাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম হিরার মৎস্যখামারে পেটেভাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন আরও ৯ বছর। এ সময় মাছ চাষের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন চঞ্চল। পরে আরও দুই বছর ময়মনসিংহের কয়েকটি মৎম্য হ্যাচারিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ২২ বছর বয়সে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে নিজের বলতে কিছুই ছিল না। ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি। স্বপ্ন দেখেন নিজের মৎস্যখামারের। দীর্ঘ ১১ বছর মাছের খামারে কাজ করে সঞ্চয় ছিল মাত্র ৯ হাজার টাকা। এই টাকায় গ্রামের পাঁচ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর লিজ নিয়ে হিরা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বাকিতে তিন কেজি দেশি মাগুর মাছের রেণু ক্রয় করে চাষ শুরু করেন। ওই রেণু থেকেই পোনা উৎপাদন করে বিক্রি করে লাভ করেন প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা। এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমেই তার মাছের খামারের পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতি বছরে তার আয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত চঞ্চল জানান, চলতি বছর তার তিন হ্যাচারি থেকে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার রেণু ও প্রায় দেড় কোটি টাকার পোনা বিক্রি করেছেন। সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে তার আয় হয়েছে ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা। তিনি বলেন, সফলতার মুখ দেখি ২০১৫ সাল থেকে। মাছ চাষ শুরুর প্রায় এক যুগ পর এখন আমার নিজ ও মেয়ের নামে তিনটি হ্যাচারি। ২০ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি করেছি। নিজের ছয়টি পুকুরসহ মোট ১৩টি পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছ। নিজের দুটি মিনি ট্রাক দিয়ে মাছ হোম ডেলিভারি দিচ্ছি। বাড়িতে গরু পালন করছি। পুরো বাড়িটা এখন খামার। খামারে কাজ করছেন ২০ থেকে ২২ জন শ্রমিক।
তার হ্যাচারিতে রেণু বা পোনা নিতে আসা কুমিল্লার ছালাম হোসেন, দিনাজপুরের নাজমুল ইসলাম ও লালমনিরহাটের মাহাবুব আলী বলেন, অনেকদিন ধরেই চঞ্চলের খামার থেকে দেশি প্রজাতির মাছের রেণু বা পোনা ক্রয় করে নিজস্ব পুকুরে চাষ করে আসছি। তার কথামতো মাছ চাষ করে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পোনা পাওয়া যায়। এদিকে চঞ্চলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে জয়পুরহাট জেলার বটতলী বাজারের মিঠু হোসেন মাছের খামার স্থাপন করে সফল হয়েছেন। একইভাবে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজিহাট এলাকার জুয়েল হোসেন ক্ষুদ্র আকারে রেণু পোনা উৎপাদন শুরু করেছেন। ওই চাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান চঞ্চলের খামারে হাতে-কলমে শিখেই তারা রেণু পোনা উৎপাদনে সফল হয়েছেন।
বর্তমানে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে তার সংসার। ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেয়ে সুবর্ণা বড় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। চঞ্চল বলেন, আমি পড়ালেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছি। তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই। স্বপ্ন দেখি দেশের প্রতিটি জেলায় বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় একটি করে হ্যাচারি স্থাপনের। সেই লক্ষ্যেই আশপাশের জেলার মৎস্যচাষিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছি।
লেখক: প্রতিনিধি, নওগাঁ