তাসফিক হক নাফিও, একজন স্বেচ্ছাসেবক; মোটাদাগে এই হলো তার পরিচয়। মানবিক কাজের জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে রয়েছে একটি সংগঠনও। বাল্যবিয়ে ও কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ, ট্রাফিক ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং যে কোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেওয়া, স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকের ধান কাটা, পাখির জন্য নিরাপদ আবাস- এমন নানা সামাজিক উদ্যোগে সবার আগে পাওয়া যায় নাফিও ও তার 'হেলডস্‌ ওপেন স্কাউট গ্রুপ'-এর সদস্যদের।
নাফিও ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ভাইটকান্দি ইউনিয়নের ছোট শুনই গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা কামাল ও ফজিলা খাতুন দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় নিজের বিদ্যালয়ের খানাখন্দে ভরা রাস্তা বন্ধুদের নিয়ে মাটি দিয়ে মেরামত করেন। সেই কাজে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রশংসিত হয়েছিলেন নাফিও। রাস্তা মেরামত করে সকলের প্রশংসা পাওয়ায় ভালো কাজে এগিয়ে আসার আগ্রহ বাড়তে শুরু করে নাফিওর মধ্যে। উপজেলা সদরের সামাজিক সংস্থা গ্রামাউস প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় গ্রামাউস মডেল একাডেমিতে মাধ্যমিকে অধ্যয়নের সময় সমাজসেবক আবদুল খালেকের সান্নিধ্যে নাফিওকে প্রসারিত করে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ চন্দ্র ধরের অনুপ্রেরণায় ২০১৪ সালে মুক্তাগাছা উপজেলার ইমপিসা ওপেন স্কাউট গ্রুপে যোগদান করেন। একই বছর নিজ উপজেলায় নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন 'হেলডস্‌ ওপেন স্কাউট গ্রুপ' নামে একটি স্কাউট গ্রুপের। এছাড়াও যুব রেড ক্রিসেন্টসহ জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন যুব ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে মানবিক কাজ করছেন।
নাফিও তার বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করেন 'হেলডস্‌ ওপেন স্কাউট গ্রুপ'-এর স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে। ২০১৪ সালে মাত্র চারজন সদস্য নিয়ে কাজ শুরু করা গ্রুপে লিডার তাসফিক হক নাফিওর নেতৃত্বে তিনজন স্কাউট লিডার ও দু'জন কাব স্কাউট লিডারসহ রোভার স্কাউটের সংখ্যা এখন ১২৪ জন। গ্রুপের সদস্যরা যৌন হয়রানি, মাদক, বাল্যবিয়ে, কিশোর গ্যাং থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে ২০১৬ সাল থেকে উপজেলার সকল বিদ্যালয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের জন্য সচেতনতামূলক সেমিনার আয়োজনে করে আসছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কিশোর অপরাধ ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কিশোর-কিশোরী কমিটি। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রশাসনের সহায়তায় এখন পর্যন্ত তারা ৮৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছে। ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে।
২০১৪ সালে ঈদের সময় স্কুলপড়ুয়া স্কাউট শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছাসেবায় যানজট নিরসনে কাজ শুরু করেন নাফিও। যার সুফল ভোগ করে ফুলপুর দিয়ে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরে উত্তর-পূর্বের ৩ জেলার মানুষ। পরবর্তীকালে মহাসড়কে ঈদ ও বিভিন্ন আপৎকালীন সময়ে সহায়তা ও ট্রাফিক আইন মানতে জনসচেতনতা তৈরির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশের স্কাউটদের নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ স্কাউটস। পাশাপাশি ফুলপুর ও আশপাশের অঞ্চলের বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিয়ে থাকে নাফিওর তৈরি করা 'কুইক রেসপন্স টিম'। বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ড ও সড়ক দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত তার টিম। এছাড়া তার নেতৃত্বে বন্যার্ত এলাকায় ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালিত হয় বন্যা ও দুর্যোগের সময়।
বর্তমানে প্রতি মৌসুমে কৃষকের ধান কাটার সময় এলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের কৃষকের ধান কেটে দেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। ২০১৮ সালে যখন শ্রমিক সংকট ও ধানের বাজার মূল্য কম থাকার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ধানক্ষেতে আগুন দিতে থাকেন কৃষকরা, তখন কৃষকের পাশে দাঁড়ান নাফিও এবং তার টিম। অসহায় দরিদ্র কৃষকদের ধান স্বেচ্ছাশ্রমে কেটে দেন তারা। প্রাণ-প্রকৃতির জন্যও কাজ করছে তরুণদের এই গ্রুপটি। বিরল প্রজাতির হিমালয়ি শকুন, জনপদে এসে আটকে পড়া মেছোবাঘ, শিয়াল, বানরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার পর নিরাপদে তাদের আবাসে ফিরিয়ে দিতে নাফিও কাজ করেন বন বিভাগের সঙ্গে। এছাড়া ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ও ফুলপুর উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে গাছে গাছে ২ হাজারের বেশি হাঁড়ি বেঁধে পাখির বাসা তৈরি করে পাখির অভয়াশ্রম তৈরি করেছেন গ্রুপের সদস্যরা।
২০১৭ সালে যখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে তখন কক্সবাজারের উখিয়ায় গিয়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের পাশে দাঁড়ায় নাফিও ও তার টিম। ঢাকার একটি সংগঠন পারি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করেছেন তারা। পাশাপাশি বিগত বছরগুলোয় ছেলেধরা, লবণের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল দেশজুড়ে, তখন নাফিও গুজব প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত ও সচেতন করতে গুজববিরোধী লিফলেট নিয়ে সাইকেলে করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ১০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করে দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীদের গুজব প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার জন্য প্রচার চালান।
করোনাকালে নাফিও ও তার গ্রুপের সদস্যদের কাজও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। কর্মহীন অনাহারী মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে বাজার করে দেওয়া, করোনায় মৃতের গোসল ও দাফন এবং গণপরিবহন ও মার্কেটে জীবাণুনাশক স্প্রের কাজ করে গেছেন অনলস। করোনা রোগীদের জন্য চালু করেন ভ্রাম্যমাণ অক্সিজেন সার্ভিস 'শান্তিনগর অক্সিজেন সার্ভিস'।
মানবিক কাজে অংশ নেওয়ার পুরস্কারও পেয়েছেন নাফিও। স্বেচ্ছাশ্রমে দেশে ধান কাটার জন্য বাংলাদেশ স্কাউটস সদর দপ্তর ও জেলা প্রশাসন থেকে সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে দুবাই পুলিশ হেড কোয়ার্টার ও সিকিউরিটি রেগুলেটরি অথরিটির অধীনে জননিরাপত্তা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজাস্টার রেসকিউ রেসপন্স প্রশিক্ষণ নিতে ওই দেশে অবস্থান করছেন নাফিও। অনলাইনে কথা বলার এক পর্যায়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে প্রশ্ন করতে নাফিও বলেন, 'বর্তমানে গ্রুপের সদস্যরা মানবিক কাজের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রতি বছর নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইচ্ছে আছে একটি মানবিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির, যেখানে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানবিক কাজের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দক্ষতা অর্জন করবে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ও পথশিশুদের নিয়ে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনে কাজ করছে আমাদের গ্রুপ। স্বপ্ন দেখি পারস্পরিক সহমর্মিতার একটি মানবিক সমাজ গঠনের। যেখানে একে অপরের বিপদে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে, মানুষের জীবন চলার পথ সহজ ও মসৃণ হবে।'
লেখক: প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ