
প্যাসিফিক জিন্সের গল্পটা রূপকথার মতো। ১৯৮৪ সালে মাত্র ২০০ শ্রমিক দিয়ে ছোট একটি কারখানা ছিল চট্টগ্রামে। নাম ছিল এনজেডএন ফ্যাশন। এক দশক পর চট্টগ্রাম ইপিজেডে প্যাসিফিক জিন্স নামে এটি নতুন রূপে পথচলা শুরু করে ১৯৯৪ সালে। তখন শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দেড় হাজার। কিন্তু এখন প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ হাজার মানুষের। শুধু চট্টগ্রাম ইপিজেডেই এই গ্রুপের এখন ছয়টি কারখানা রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে রয়েছে নিট পোশাকের আরেকটি কারখানা। ২০০০ সালে তারা নতুন করে যুক্ত করে 'জিন্স ২০০০ নামে' নতুন কারখানা। ২০০৮ সালে যুক্ত হয় আরেক কারখানা 'ইউনিভার্সেল জিন্স'। ২০১৪ সালে উৎপাদনে যায় 'এন এইচটি ফ্যাশন'। ২০১৮ সালে যুক্ত হয় 'প্যাসেফিক ক্যাজুয়েলস'। ২০২১ সালে উৎপাদনে যায় আরেক নতুন কারখানা 'প্যাসিফিক নিট্যাক্স'। তাদের নতুন আরও দুটি কারখানা উৎপাদনে যাবে শিগগির। এতদিন ওভেনে আধিপত্য বিস্তার করলেও এখন নিট পোশাকেও সেরা হতে চান তারা। আবার গার্মেন্টের বাইরে বিশ্ববিখ্যাত ম্যারিয়ট হোটেল চেইনের সঙ্গে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় পাঁচতারকা মানের একটি হোটেল নির্মাণ করছে প্যাসিফিক জিন্স।
৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্যাসিফিকের জিন্স :ডেনিম পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের পাঁচ শতাধিক কারখানা থেকে প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন পিস পোশাক রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
এর মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ ৫০টির বেশি দেশে এককভাবে ৪৫ মিলিয়ন পিস জিন্স প্যান্ট রপ্তানি করছে প্যাসিফিক জিন্স। সব মিলিয়ে দেশের শীর্ষ তিনটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের এই প্রতিষ্ঠান। এটি এখন প্রতিবছর সাড়ে চার কোটি পিস ওভেন পোশাক উৎপাদন করছে। আর নিট পোশাক উৎপাদন করছে দেড় কোটি পিস।
নেপথ্যের নায়ক :প্যাসিফিক জিন্সকে বিন্দু থেকে সিন্ধুতে রূপান্তর করেছেন সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা মো. নাসির উদ্দিন। এখন এ ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করছেন তার সন্তানেরা। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে তিন ভাই যথাক্রমে- সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর যুক্ত আছেন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে। তবে বড় ভাই হিসেবে দায়িত্বের চাপটা সবচেয়ে বেশি নিচ্ছেন সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। পিতার ব্যবসাকে তিলে তিলে বড় করার পেছনে ১৭ বছর ধরে বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বাবা মো. নাসির উদ্দিন তাকে মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠানে আনেননি। ব্যবসার আদ্যোপান্ত বুঝতে তিনি বড় সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরকে একজন সাধারণ কর্মচারীর মতো হাতেকলমে শিখিয়েছেন। সব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করায় সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর ১৫ বছর ছিলেন প্যাসিফিক জিন্সের পরিচালক। দুই বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। সৈয়দ তানভীর যুক্ত হওয়ার পরই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয় বড় আকারে। ২০০৪ সালে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরেন, তখন প্যাসিফিক জিন্সের বাৎসরিক টার্নওভার ছিল ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন সেটি ছাড়িয়েছে চার হাজার কোটি টাকার ঘর। সৈয়দ তানভীর পরিবেশবান্ধব গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেন বেশি। প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করেন তিনি আধুনিকতার। প্যাসিফিক জিন্স এভাবে এগিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তবু 'হিরো' মনে করেন তিনি তার বাবা মো. নাসির উদ্দিনকে। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'আমার বাবা পোশাক শিল্পে যাত্রা শুরু করেন ১৯৮৪ সালে। কিন্তু তার ব্যবসায়ী জীবন শুরু ৬০-এর দশক থেকে। বাবার কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় মনোবল, একাগ্রতা এবং দূরদর্শিতা- আমাদের সফলতার মূল কারণ। বাংলাদেশে আজকে পোশাক শিল্পের যে অবস্থান, তিনি তা আশির দশকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেই অনুযায়ী তিনি কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তৈরি করেছেন প্রতিষ্ঠানকে। প্রস্তুত করেছেন আমাদেরও।'
শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন তানভীর :জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? সেই লক্ষ্য থেকে কত দূরে আছেন এখন- সমকালের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'আমরা সাধারণত জীবনের লক্ষ্য বলতে পেশাগত লক্ষ্যকে বুঝে থাকি। ব্যাপারটা আসলে তা না। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির পারিবারিক লক্ষ্য, সামাজিক লক্ষ্য, রাজনৈতিক লক্ষ্য, পেশাগত লক্ষ্য, ধর্মীয় লক্ষ্য থাকে, যা তার জীবনের লক্ষ্যের অংশ। যদি পেশাগত লক্ষ্য বলি, ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল শিক্ষক হওয়ার। তবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাবাকে দেখেই। তার কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা দেখে ব্যবসায়ী হতে অনুপ্রাণিত হই।
উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিড্স থেকে : সৈয়দ তানভীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। শিক্ষা জীবনেরও গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন তিনি বন্দরনগরীতে। সেন্ট প্লাসিড স্কুল থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম পাবলিক কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'ছাত্র হিসেবে মাঝারি মানের ছিলাম। এরপর আইইউবি চট্টগ্রাম ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করি ২০০৩ সালে এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিড্স থেকে আন্তর্জাতিক বিপণন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি ২০০৪ সালে।'
সফলতার মূলমন্ত্র 'সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন' :২০০৪ সালে সৈয়দ তানভীর পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'যোগদানের পর অনেক বছর আমি আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছি। বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সে বিভাগগুলোর প্রসেস ইম্প্রুভমেন্ট নিয়ে কাজ করা শুরু করি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব সত্তা আছে। কাজ করার ভিন্ন ধরন আছে। একটি প্রতিষ্ঠান তখনই সফল হয়, যখন প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি টিম হয়ে একই গতিশীলতায় কাজ করে। আমি ২০০৪ সাল থেকে যে কাজটি করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি, তা হলো প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে ঈড়হঃরহঁড়ঁং চৎড়পবংং ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ ধহফ ঊভভরপরবহপু ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ নিশ্চিত করা।' তিনি বিশ্বাস করেন উৎকর্ষতা সাধনের কোনো সীমা নেই এবং বিকল্প নেই। এ জন্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আনতে হয় চিন্তায়। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'আপনি খেয়াল করবেন ২০ বছর আগের অনেক সফল প্রতিষ্ঠান কিন্তু বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে আছে। এর কারণ হচ্ছে তারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি। তাই একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত তার উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যেতে হবে। গার্মেন্টের বাইরে আমরা হোটেল ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেছি। বিশ্ববিখ্যাত ম্যারিয়ট হোটেল চেইনের সঙ্গে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় পাঁচতারকা একটি হোটেল নির্মাণাধীন আছে।'
দেশসেরা হয়ে রপ্তানি ট্রফি মিলেছে ২৪ বার : জাতীয় রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২৪ বার রপ্তানি ট্রফি পেয়েছেন চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড। এর মধ্যে ১০টি স্বর্ণ পদক, ১০টি রৌপ্য পদক ও ৪টি ব্রোঞ্জ। এই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয় রপ্তানিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টানা আটবার জিতেছে স্বর্ণ পদক। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে তারা একসঙ্গে পেয়েছে তিনটি পদক। সেবার প্রথমবারের মতো ইপিজেড ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ তিনটি পদকই পেয়েছে জিন্স রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই কোম্পানিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে তুলে দেন রপ্তানি ট্রফি।
'করোনাতে পেয়েছি নতুন শিক্ষা' :প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'করোনা নতুন এক শিক্ষা দিয়েছে পুরো পৃথিবীকে। আমরা মোকাবিলা করেছি নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা। শুরুর দিকে হঠাৎ করে চায়না থেকে কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছি প্রথমে। এরপর যখন পুরো বিশ্ব আক্রান্ত হলো তখন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব। তাই নতুন করে ভেবেছি শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাজার হাজার শ্রমিকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনেছি কারখানায়। ১০ হাজার শ্রমিককে এনেছি টিকার আওতায়। পর্যায়ক্রমে টিকা দেওয়া হবে আরও ১৭ হাজার শ্রমিককে। তবে বয়সজনিত কারণে এখনও ১৫ হাজার শ্রমিককে তালিকাভুক্ত করতে পারিনি আমরা। করোনাকালে কোনো শ্রমিকের ওপর অমানবিক আচরণ করেনি আমাদের প্রতিষ্ঠান।' তিনি জানান, করোনার পরে বিশ্ববাজারে নতুন ট্র্যান্ড হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পোশাক। আর এ ধরনের পোশাক তৈরি করতে হলে দরকার অর্গানিক কটন ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়। প্যাসেফিক জিন্স তাই প্রযুক্তির সহায়তায় পানির ব্যবহার কমাচ্ছে। মনোযোগ বাড়াচ্ছে পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরিতে।
তিন বছরে হবে নতুন আরও ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান :প্যাসিফিক জিন্সের বিভিন্ন কারখানায় এখন কাজ করছে প্রায় ৩২ হাজার শ্রমিক। আগামী তিন বছরে এ সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করতে চায় তারা। এ জন্য ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্যাসিফিক নিটেক্স নামে নতুন কারখানা চালু করেছে তারা। ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে সুরক্ষা পোশাক তৈরিতেও। ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইপিজেডের মধ্যেই নতুন আরেকটি নিট ও ওভেন পোশাক তৈরির কারখানা করতে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। এটি পুরোদমে চালু হলে আগামী তিন বছরে নতুন করে আরও অন্তত ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। ২০২৩ সালের শুরুতে সাড়ে তিনশ কোটি বিনিয়োগ করা পাঁচতারকা মানের নতুন আবাসিক হোটেলও চালু করবে প্যাসিফিক জিন্স।
যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি এখনও :জীবনযাপনের জন্য যে পোশাক ব্যবহূত হয়, তার প্রতিটি ধাপেই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায় চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স। বহুমুখী পোশাক উৎপাদন করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। অধরা এ স্বপ্ন পূরণ করতে যা যা করা দরকার তার সবই করবে প্যাসিফিক জিন্স। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন পূরণ হয়নি এখনও। নিজেদেরও এখনও নিতে পারিনি শীর্ষস্থানে। চীনকে সরিয়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশ যাতে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা।'
লেখক: ব্যুরো প্রধান, চট্টগ্রাম
৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্যাসিফিকের জিন্স :ডেনিম পোশাক রপ্তানির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের পাঁচ শতাধিক কারখানা থেকে প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন পিস পোশাক রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
এর মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ ৫০টির বেশি দেশে এককভাবে ৪৫ মিলিয়ন পিস জিন্স প্যান্ট রপ্তানি করছে প্যাসিফিক জিন্স। সব মিলিয়ে দেশের শীর্ষ তিনটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের এই প্রতিষ্ঠান। এটি এখন প্রতিবছর সাড়ে চার কোটি পিস ওভেন পোশাক উৎপাদন করছে। আর নিট পোশাক উৎপাদন করছে দেড় কোটি পিস।
নেপথ্যের নায়ক :প্যাসিফিক জিন্সকে বিন্দু থেকে সিন্ধুতে রূপান্তর করেছেন সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা মো. নাসির উদ্দিন। এখন এ ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করছেন তার সন্তানেরা। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে তিন ভাই যথাক্রমে- সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর যুক্ত আছেন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে। তবে বড় ভাই হিসেবে দায়িত্বের চাপটা সবচেয়ে বেশি নিচ্ছেন সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। পিতার ব্যবসাকে তিলে তিলে বড় করার পেছনে ১৭ বছর ধরে বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বাবা মো. নাসির উদ্দিন তাকে মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠানে আনেননি। ব্যবসার আদ্যোপান্ত বুঝতে তিনি বড় সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরকে একজন সাধারণ কর্মচারীর মতো হাতেকলমে শিখিয়েছেন। সব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করায় সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর ১৫ বছর ছিলেন প্যাসিফিক জিন্সের পরিচালক। দুই বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। সৈয়দ তানভীর যুক্ত হওয়ার পরই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয় বড় আকারে। ২০০৪ সালে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরেন, তখন প্যাসিফিক জিন্সের বাৎসরিক টার্নওভার ছিল ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন সেটি ছাড়িয়েছে চার হাজার কোটি টাকার ঘর। সৈয়দ তানভীর পরিবেশবান্ধব গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেন বেশি। প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করেন তিনি আধুনিকতার। প্যাসিফিক জিন্স এভাবে এগিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তবু 'হিরো' মনে করেন তিনি তার বাবা মো. নাসির উদ্দিনকে। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'আমার বাবা পোশাক শিল্পে যাত্রা শুরু করেন ১৯৮৪ সালে। কিন্তু তার ব্যবসায়ী জীবন শুরু ৬০-এর দশক থেকে। বাবার কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় মনোবল, একাগ্রতা এবং দূরদর্শিতা- আমাদের সফলতার মূল কারণ। বাংলাদেশে আজকে পোশাক শিল্পের যে অবস্থান, তিনি তা আশির দশকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেই অনুযায়ী তিনি কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তৈরি করেছেন প্রতিষ্ঠানকে। প্রস্তুত করেছেন আমাদেরও।'
শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন তানভীর :জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? সেই লক্ষ্য থেকে কত দূরে আছেন এখন- সমকালের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'আমরা সাধারণত জীবনের লক্ষ্য বলতে পেশাগত লক্ষ্যকে বুঝে থাকি। ব্যাপারটা আসলে তা না। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির পারিবারিক লক্ষ্য, সামাজিক লক্ষ্য, রাজনৈতিক লক্ষ্য, পেশাগত লক্ষ্য, ধর্মীয় লক্ষ্য থাকে, যা তার জীবনের লক্ষ্যের অংশ। যদি পেশাগত লক্ষ্য বলি, ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল শিক্ষক হওয়ার। তবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ বাবাকে দেখেই। তার কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা দেখে ব্যবসায়ী হতে অনুপ্রাণিত হই।
উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিড্স থেকে : সৈয়দ তানভীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। শিক্ষা জীবনেরও গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন তিনি বন্দরনগরীতে। সেন্ট প্লাসিড স্কুল থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম পাবলিক কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'ছাত্র হিসেবে মাঝারি মানের ছিলাম। এরপর আইইউবি চট্টগ্রাম ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করি ২০০৩ সালে এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিড্স থেকে আন্তর্জাতিক বিপণন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি ২০০৪ সালে।'
সফলতার মূলমন্ত্র 'সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন' :২০০৪ সালে সৈয়দ তানভীর পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'যোগদানের পর অনেক বছর আমি আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছি। বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সে বিভাগগুলোর প্রসেস ইম্প্রুভমেন্ট নিয়ে কাজ করা শুরু করি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব সত্তা আছে। কাজ করার ভিন্ন ধরন আছে। একটি প্রতিষ্ঠান তখনই সফল হয়, যখন প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি টিম হয়ে একই গতিশীলতায় কাজ করে। আমি ২০০৪ সাল থেকে যে কাজটি করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি, তা হলো প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগে ঈড়হঃরহঁড়ঁং চৎড়পবংং ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ ধহফ ঊভভরপরবহপু ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ নিশ্চিত করা।' তিনি বিশ্বাস করেন উৎকর্ষতা সাধনের কোনো সীমা নেই এবং বিকল্প নেই। এ জন্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আনতে হয় চিন্তায়। সৈয়দ তানভীর বলেন, 'আপনি খেয়াল করবেন ২০ বছর আগের অনেক সফল প্রতিষ্ঠান কিন্তু বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে আছে। এর কারণ হচ্ছে তারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি। তাই একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত তার উৎকর্ষ সাধনে কাজ করে যেতে হবে। গার্মেন্টের বাইরে আমরা হোটেল ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেছি। বিশ্ববিখ্যাত ম্যারিয়ট হোটেল চেইনের সঙ্গে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় পাঁচতারকা একটি হোটেল নির্মাণাধীন আছে।'
দেশসেরা হয়ে রপ্তানি ট্রফি মিলেছে ২৪ বার : জাতীয় রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২৪ বার রপ্তানি ট্রফি পেয়েছেন চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেড। এর মধ্যে ১০টি স্বর্ণ পদক, ১০টি রৌপ্য পদক ও ৪টি ব্রোঞ্জ। এই গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয় রপ্তানিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টানা আটবার জিতেছে স্বর্ণ পদক। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে তারা একসঙ্গে পেয়েছে তিনটি পদক। সেবার প্রথমবারের মতো ইপিজেড ক্যাটাগরিতে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ তিনটি পদকই পেয়েছে জিন্স রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই কোম্পানিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে তুলে দেন রপ্তানি ট্রফি।
'করোনাতে পেয়েছি নতুন শিক্ষা' :প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'করোনা নতুন এক শিক্ষা দিয়েছে পুরো পৃথিবীকে। আমরা মোকাবিলা করেছি নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা। শুরুর দিকে হঠাৎ করে চায়না থেকে কাঁচামাল আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছি প্রথমে। এরপর যখন পুরো বিশ্ব আক্রান্ত হলো তখন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সব। তাই নতুন করে ভেবেছি শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাজার হাজার শ্রমিকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনেছি কারখানায়। ১০ হাজার শ্রমিককে এনেছি টিকার আওতায়। পর্যায়ক্রমে টিকা দেওয়া হবে আরও ১৭ হাজার শ্রমিককে। তবে বয়সজনিত কারণে এখনও ১৫ হাজার শ্রমিককে তালিকাভুক্ত করতে পারিনি আমরা। করোনাকালে কোনো শ্রমিকের ওপর অমানবিক আচরণ করেনি আমাদের প্রতিষ্ঠান।' তিনি জানান, করোনার পরে বিশ্ববাজারে নতুন ট্র্যান্ড হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পোশাক। আর এ ধরনের পোশাক তৈরি করতে হলে দরকার অর্গানিক কটন ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়। প্যাসেফিক জিন্স তাই প্রযুক্তির সহায়তায় পানির ব্যবহার কমাচ্ছে। মনোযোগ বাড়াচ্ছে পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরিতে।
তিন বছরে হবে নতুন আরও ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান :প্যাসিফিক জিন্সের বিভিন্ন কারখানায় এখন কাজ করছে প্রায় ৩২ হাজার শ্রমিক। আগামী তিন বছরে এ সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করতে চায় তারা। এ জন্য ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্যাসিফিক নিটেক্স নামে নতুন কারখানা চালু করেছে তারা। ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে সুরক্ষা পোশাক তৈরিতেও। ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইপিজেডের মধ্যেই নতুন আরেকটি নিট ও ওভেন পোশাক তৈরির কারখানা করতে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। এটি পুরোদমে চালু হলে আগামী তিন বছরে নতুন করে আরও অন্তত ১৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। ২০২৩ সালের শুরুতে সাড়ে তিনশ কোটি বিনিয়োগ করা পাঁচতারকা মানের নতুন আবাসিক হোটেলও চালু করবে প্যাসিফিক জিন্স।
যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি এখনও :জীবনযাপনের জন্য যে পোশাক ব্যবহূত হয়, তার প্রতিটি ধাপেই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায় চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স। বহুমুখী পোশাক উৎপাদন করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। অধরা এ স্বপ্ন পূরণ করতে যা যা করা দরকার তার সবই করবে প্যাসিফিক জিন্স। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, 'বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন পূরণ হয়নি এখনও। নিজেদেরও এখনও নিতে পারিনি শীর্ষস্থানে। চীনকে সরিয়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশ যাতে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা।'
লেখক: ব্যুরো প্রধান, চট্টগ্রাম
মন্তব্য করুন