স্বাধীনতার পাঁচ দশক পূর্তির এই সুবর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে তারুণ্যের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। কেননা বিভিন্ন মাধ্যমে তরুণদের আনাগোনা চিরকাল ছিল, থাকবে। গণঅভ্যুত্থান, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উন্নয়নের নানামুখী কার্যক্রমে তরুণদের নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সব ক্ষেত্রেই তারুণের শক্তি আশাব্যঞ্জক ছিল- এমনও নয়। আমি সব বিষয় নিয়ে আলাদা করে কথা বলব না। যেহেতু আমি গানের ভুবনের বাসিন্দা, তাই এই অঙ্গনের কথাই বলতে চাই। আমরা যারা সংগীত সৃষ্টির নেশায় দিনরাত ডুবে থাকি, তাদের চিন্তাধারা থাকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করার। যে সৃষ্টি একটি সময়কে আলাদা করে চিহ্নিত করবে। আমরা যদি আশি-নব্বই থেকে শুরু করে একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব সংগীতাঙ্গনে তরুণদেরই ছিল জয়জয়কার। অভিনব সব সৃষ্টিতে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখা গেছে এ সময়। হয়তো সে কারণেই সেই সময়ের এখনও অনেকে খুঁজে ফেরেন। আমার কথার মানে এই নয় যে, এখন গানের ভুবনে ভালো কিছু হচ্ছে না। ভালো গান এখনও তৈরি হচ্ছে, নতুন শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীতায়োজকদেরও আনাগোনা থেমে নেই। তবুও এখনকার তরুণদের সৃষ্টি নিয়ে অনেকে আফসোস করছেন এই বলে যে, সৃষ্টিতে অনেক কিছুই আছে, তবু কী যেন নেই। কী নেই? সেটা যদি খুঁজতে যাই, তাহলে প্রথমেই চোখে পড়ে গানের সাহিত্যমান। নব্বই দশকের পর থেকে যে সাহিত্য মানে ক্রমাগত ভাটা পড়েছে।

চলচ্চিত্রের গান নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। কারণ অনেকেই জানেন, সিনেমার গান তৈরি প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন ধরনের। কাহিনির বাঁকবদল, চরিত্রগুলোর আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ এবং তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার ওপর ভিত্তি করে সিনেমার একেকটি গান তৈরি করা হয়। তবে সেখানেও সুর-সংগীত এবং শিল্পীদের গায়কীতে মুনশিয়ানার ছাপ তুলে ধরতে না পারলে, আয়োজন অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। তাই সংগীত পরিচালক এবং প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে যে কেউ সহজেই প্রতিষ্ঠা পায় না। আর তরুণদের জন্য সেটা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। এরপরও চ্যালেঞ্জ নিয়েই অনেকে কাজ করছেন, সফলও হয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু অ্যালবাম বা অডিও মাধ্যমে তারুণ্যের শক্তিকে কতটা কাজে লাগতে পেরেছি- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আমি আগেও বলেছি, এই সময়েও সংগীতাঙ্গনে ভালো কাজ হচ্ছে, কিন্তু অনেক গানই মানসম্পন্ন বলা যাবে না। নব্বই দশকের গানে যে সাহিত্য মান, সংগীতে যে নিরীক্ষা দেখা গেছে, সেটাও এখন কমই খুঁজে পাওয়া যায়। সংগীতের সঙ্গে সাহিত্য ও কবিতার একটা যোগ আছে। তাই সংগীতের জন্য হলেও সাহিত্যের চর্চা অনেকটাই জরুরি। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, তারকা খ্যাতির মোহ অনেকের মধ্যে ভর করেছে। অনলাইন দুনিয়ায় নিজের কাজ তুলে ধরার পথও তৈরি হয়েছে অনেক। এত উপকরণ চারপাশে যে, তা নিয়ে যে যার মতো কাজ করতে চাইছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে ক'জন সেটাই দেখার বিষয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখন ভালো কন্টেন্টের চেয়ে মানহীন কন্টেন্ট বেশি শেয়ার হচ্ছে। অনেকে মজার ছলে এই কাজটি বেশি করছে। অথচ যেখানে এত সুযোগ সেখানে সঠিক চিন্তাধারার প্রকাশ তরুণদের মধ্যে কম দেখা যাচ্ছে। ক্যাসেট, সিডির যুগে অ্যালবাম ছিল গান প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। সে সময় অ্যালবাম প্রকাশের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম খুঁজে বের করাও ছিল কঠিন। নিজের কাজ তুলে ধরার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মের খুঁজে নিতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আবার যে সৃষ্টি শ্রোতার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা মনোযোগ কাড়ছে- তা নিয়েও ভাবতে হয়েছে। প্রতিটি আয়োজনে নতুন কিছু করার প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হতে পারে, নিজস্ব সৃষ্টি তুলে ধরা এবং শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণে নিবেদিত থাকতে পারার কারণেই ভালো কাজের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। আর এখন যখন এই পথ খুলে গেছে, তখন কেন ভালো কাজের সংখ্যা বাড়ছে না? এই প্রশ্ন আমার মতো আরও অনেকেই করেন বিভিন্ন সময়। তাই আমি বলব, গত কয়েক দশকের চেয়ে এখনই বেশি সুযোগ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার। অনিন্দ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের দ্বীপ জ্বালাতে যেতে হবে। নইলে যে সংকটের কথা আমরা বলি, তা কোনোভাবেই কাটবে না।
সংকটের কথা তো হলো, এবার সম্ভাবনার কথা বলি। অনেকে যখন খ্যাতির মোহে স্রোহের জোয়ারে গা ভাসাচ্ছেন, তখন একদল তরুণ নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক কাজ বিশ্বের চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিভাবানদের অনেকে সময়ের পাল্লা দিয়ে, নিজেদের এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। শুধু গান বা সংগীতায়োজনে সবকিছু থেমে আছে তা নয়, বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেও চমকে দিয়েছেন কেউ কেউ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিউজিয়ানদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেও অবাক করে দিয়েছেন অনেকে। গানের মতো চলচ্চিত্র অঙ্গনেও চলছে বাঁকবদলের চেষ্টা। সেই সুবাদে সিনেমার গানেও এসেছে নতুনত্ব। এখন শুধু আমাদের একটাই চেষ্টা করতে হবে, ভালো কন্টেন্ট যত বেশি সম্ভব সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া; যা থেকে নতুনরা অনুপ্রাণিত হবে, সস্তা জনপ্রিয়তার পথ ছেড়ে শিল্পীসত্তার প্রকৃত নির্যাস তুলে ধরার চেষ্টা করবে। আর এটা করা মোটেও কঠিন বা অসম্ভব নয়।
লেখক
কণ্ঠশিল্পী