ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণরাই এগিয়ে এসেছে। তারুণ্যের চোখেমুখে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এই লাল-সবুজের পতাকাকে জয় করতে তাদের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। এ প্রজন্মের তরুণরা '৭১-এর যুদ্ধে অংশ নেননি, তাই বলে দেশের প্রতি ভালোবাসা কোনো অংশে কম নয়। দেশকে জানতে-বুঝতে শিখছেন প্রতিনিয়ত। তারাই আগামী দিনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভক্ষণে পেছনে ফিরে তাকালে নানা সময়ে তারুণ্যের সৌন্দর্য দেখতে পাই। যে জন্য তরুণদের কাছে সবার প্রত্যাশা অনেক। তরুণদের মাঝে লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনা। সব স্বপ্নের সূচনা তরুণদের চোখেমুখে ধরা দিয়েছে আলোর ঝলকানি হয়ে। তাদের হতে হবে স্বপ্নবাজ। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রার যুগে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুবর্ণ দ্বার উন্মোচিত। এর পূর্ণ সুযোগ পাচ্ছেন বর্তমান প্রজন্ম। অনেক ক্ষেত্রে তারা এটা কাজেও লাগাচ্ছেন। তারা তাদের জ্ঞানকে শানিত করে মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির স্ম্ফুরণ ঘটিয়ে নতুন আবিস্কারের মাধ্যমে দেশ ও মানবতার কল্যাণসাধন করছেন। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তাদের বেশি বেশি অংশগ্রহণের সুযোগকে অবারিত করে দিতে হবে। তাহলে তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করবে। বিশ্বের অনেক দেশ এখন এগিয়ে গেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চেতনায় আমাদের এই প্রজন্ম কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তরুণদের আরও চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে তরুণদের এখনই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। তরুণরা একটি রাষ্ট্রের শক্তি। তারা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মী, ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। উন্নয়নের বহুমুখী খাতগুলো তারুণ্যের পদচারণায় মুখর। তাদের শৌর্য-বীর্য, সাহস ও উদ্দীপনায় পৃথবীতে আসছে নিত্য পরিবর্তন। এই করোনা মহামারিতে তরুণরা বেশ ভূমিকা রেখেছে। পাড়া-মহল্লায় কমিটি করে করোনা সচেতনতায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবায় বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়তার হাত। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ ছিল চরমে।

অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তরুণরা দেখিয়েছে আশার আলো; যা অনেকেরই চোখে পড়েছে। যারা বাইরে বের হতে পারেনি, তারা ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে নানা সচেতনতার বার্তা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণরাই পারেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে। দেশের প্রয়োজনে কঠিন অনেক কাজও করেন তারা। এ তরুণরাই বয়ে নিয়ে আসবে সাফল্য, প্রথাগত সনাতনী ব্যবস্থা ভেঙে গড়ে তুলছে আধুনিক সমাজ কাঠামো। তরুণদের বিরাট অংশ বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে হতাশায় ভোগেন। লেখাপড়া শেষ করেও বেকার জীবনের ঘানি টানতে হয় তাদের। যে জন্য সবসময়ই তাদের মুখে শোনা যায় আশা ভঙ্গের কথা। যার বহিঃপ্রকাশ মাঝে মধ্যে তারা তাদের কথায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখায় প্রকাশ করে। তরুণদের একটা বড় অংশ তাদের নিয়মিত লেখাপড়া শেষ করার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেছে। এর পেছনে রয়েছে দারিদ্র্য, সুযোগের অভাব, লেখাপড়ায় অকৃতকার্যতা। জীবনের চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান তারা। তাদের হতাশ হলে চলবে না। দৃঢ়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে আলো আসবেই। বেশিরভাগ তরুণ সমাজ যেমন প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ, তেমনি অনেকে আবার পিছিয়ে। তারা স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার পারছে না। তাদের মাধ্যমে সমাজে ভুলবার্তা যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে অদক্ষতা ও দিকনির্দেশনার অভাব।
তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আরও অনেক কথা বলাই যায়। চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, এ অঙ্গনের তরুণরা বেশ আশাব্যঞ্জক ভূমিকা রাখছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চর্চায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলেই মনে হয়। নতুন নতুন অনেক নির্মাতা ছোট-বড় সব পর্দায় কাজ করছেন, নতুন গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। এমনও গেছে এফডিসিতে মাসের বেশিরভাগ সময় শুটিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটত। এ সময় প্রবীণ নির্মাতাদের ছবিতেই বেশি অভিনয় করেছি। এখন আর এ চিত্র নেই। পুরোনো নির্মাতাদের পাশাপাশি নতুন নির্মাতাদের পদচারণায় মুখর থাকে বিএফডিসি। নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চলচ্চিত্রকে তারা দেখছেন। যত বেশি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে, নতুন ধারা শুরু হবে। তরুণ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ইতোমধ্যে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসব, বুসান চলচ্চিত্র উৎসবসহ চলচ্চিত্রের মর্যাদাপূর্ণ আসরে এ দেশের তরুণ নির্মাতারা রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। দেশের বাইরে কোনো উৎসবে লাল গালিচায় হাঁটা একসময় অভিনয়শিল্পীদের জন্য স্বপ্ন ছিল। এখন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। দেশের বাইরে প্রদর্শিত দেশীয় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয়শিল্পীদেরও আন্তর্জাতিক পরিচিতি মিলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আর চাহিদা বদলায় প্রত্যেকটা দেশের, মানুষের, সবার। মুক্তিযুদ্ধ সময় যেটা দরকার ছিল সেই সময়ের তরুণরা তা করেছে; এখন সময় দরকার তরুণরা সেটাই করছে, করবে। সবাই কিছু না কিছু নির্মাণ করছে, কেউ কেউ পরীক্ষামূলক কাজ হাতে নিয়েছে। কেউ কিন্তু এখন আর ঘরে বসে নেই। সবকিছু হয়তো এখনও আমরা দেখে উঠতে পারছি না। এ ইন্ডাস্ট্রিতে যত বেশি তরুণ সমাজ আসবে, তত ইন্ডাস্ট্রির চেহারা বদলাবে। সব কাজে অবশ্যই তরুণদের সিনিয়রদের পরামর্শ লাগবে। প্রবীণের বুদ্ধি ও নবীনের শক্তি- এই দুইয়ের সমন্বয়ে এগিয়ে যাবে দেশ- এ আশা করতেই পারি।
লেখক
অভিনেত্রী