- বিশেষ আয়োজন
- স্বাস্থ্য খাতে শূন্য কার্বন নির্গমন সম্ভব
স্বাস্থ্যখাত
স্বাস্থ্য খাতে শূন্য কার্বন নির্গমন সম্ভব

পৃথিবীর জনসংখ্যা যেমন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্ধিত জনসংখ্যার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত এই স্বাস্থ্য খাত থেকে নির্গত হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস বিশেষ করে কার্বন, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে যে নির্গমন হচ্ছে, তা হ্রাস বা অপসারণে তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সাম্প্রতিক বিশ্নেষণে স্বাস্থ্যসেবার বৈশ্বিক কার্বন ফুটপ্রিন্টকে ২-২.৪ গিগা টন কার্বন-ডাই অক্সাইডের সমতুল্য হিসেবে গণনা করা হয়েছে, যা মোট বৈশ্বিক নির্গমনের ৪-৫ শতাংশ।
প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য খাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। স্বাস্থ্যসেবা এনার্জির ব্যবহার, পরিবহন, পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তির মাধ্যমে কার্বন নির্গমনে অবদান রাখে।
হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য যে জীবাশ্ম জ্বালানিযুক্ত জেনারেটর ব্যবহার করা হয়, তা থেকেও প্রচুর পরিমাণে কার্বন নির্গত হয়। এ ছাড়া হাসপাতালে উৎপাদিত বর্জ্যগুলোকে পোড়ানোর মাধ্যমেই ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং এ থেকেও কার্বন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়। তবে নিম্ন আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোর স্বাস্থ্যক্ষেত্র থেকে কার্বন নির্গমন ভিন্ন রকমের। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর উদ্দেশ্য নির্গমন হ্রাস এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো খাপ খাইয়ে নেওয়ার দিকে লক্ষ্য করছে।
স্বাস্থ্যসেবার জলবায়ু ফুটপ্রিন্টের উৎস
১. প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য খাত পণ্য, পরিষেবা এবং প্রযুক্তি সুবিধা প্রদান এবং সংগ্রহ করার সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে।
২. স্বাস্থ্যসেবা এনার্জির খরচ, পরিবহন ও পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তির মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে অবদান রাখে।
৩. স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এবং স্বাস্থ্যসেবার মালিকানাধীন যানবাহন থেকে নির্গত নির্গমন এই ক্ষেত্রের বিশ্বব্যাপী ফুটপ্রিন্টের ১৭ শতাংশ তৈরি করে।
৪. বিদ্যুৎ, বাষ্প, শীতল ও উষ্ণকরণ করার মতো ক্রয়কৃত এনার্জির উৎস থেকে পরোক্ষভাবে ১২ শতাংশ নির্গমন হয়।
৫. নির্গমনের সিংহভাগ (৭১ শতাংশ) প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ চেইন থেকে প্রাপ্ত পণ্য ও পরিষেবাগুলোর উৎপাদন, পরিবহন এবং নিষ্পত্তির মাধ্যমে যেমন ওষুধ এবং অন্যান্য রাসায়নিক, খাদ্য ও কৃষিপণ্য, চিকিৎসা ডিভাইস, হাসপাতাল সরঞ্জাম ইত্যাদি থেকে।
৬. জীবাশ্ম জ্বালানির দহন স্বাস্থ্য পরিষেবা নির্গমনের কেন্দ্রবিন্দুতে যা জলবায়ু ফুটপ্রিন্টের অর্ধেকেরও বেশি তৈরি করে।
স্বাস্থ্যসেবাকে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে হবে। শুধু জলবায়ু সংকট এবং এর কারণ থেকে অসুস্থ, আহত বা মারা যাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসা করেই নয়, পাশাপাশি প্রাথমিক প্রতিরোধ অনুশীলন করে এবং আমূলভাবে নিজস্ব নির্গমন হ্রাস করার মাধ্যমেও। স্বাস্থ্য খাতের সুবিধা, সিস্টেম এবং মন্ত্রকগুলোকে ২০৫০ সাল বা তার আগে নিট শূন্য নির্গমন অর্জনে স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী এবং পরিষেবাগুলোর প্রস্তুতকারক ও সরবরাহকারীদের কাজ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ইতোমধ্যে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবার নির্গমন হ্রাস করার উপায়
১. স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলোকে ডিকার্বনাইজ করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উচিত এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো তাদের জলবায়ু ফুটপ্রিন্ট কমাতে এবং আরও স্থিতিস্থাপক হয়ে উঠতে পারে- এমন পদক্ষেপের রূপরেখা দেয়।
২. স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো, সরকারি-বেসরকারি, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে এনার্জির ব্যবস্থার ডিকার্বনাইজেশন ও স্থানীয়, আধা জাতীয় এবং জাতীয় স্তরে পরিচ্ছন্ন নবায়নযোগ্য এনার্জি বাস্তবায়নে বিনিয়োগ ও সমর্থন করা উচিত।
৩. স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ চেইনকে ডিকার্বনাইজ করুন। স্বাস্থ্য মন্ত্রক, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উচিত কম কার্বন বা শূন্য নির্গমন সংগ্রহের জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সরবরাহকারী ও নির্মাতাদের তাদের ক্রিয়াকলাপ এবং পণ্যগুকে ডিকার্বনাইজ করা উচিত।
৪. সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্বন অফসেট পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। যেখানে তারা তাদের নিজস্ব নির্গমনকে অপসারণ করার জন্য অন্য একটি গ্রুপকে অর্থায়ন করবে; যারা কৃষিকাজ বা বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণ করবে। কার্বন অফসেট বাস্তবায়ন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানি বিল ইত্যাদির মতো কার্বন বিল তৈরি করতে হবে। এতে যে পরিমাণ কার্বন তারা নির্গমন করবে, তার একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী অর্থায়ন করবে।
৫. নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যেমন সোলার প্যানেলের সংযোগ বৃদ্ধি।
ক্লাইমেট স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা স্থাপন
২০১৭ বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট একটি নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা স্বাস্থ্য খাতে অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। যদিও প্রশমন এবং স্থিতিস্থাপকতা প্রায়ই জলবায়ু বিশ্বে পৃথক সাইলোতে স্থাপন করা হয়, জলবায়ু-স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি একটি অত্যধিক কাঠামোর মধ্যে কম-কার্বন এবং স্থিতিস্থাপকতা উভয় কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করে।
ক্লাইমেট-স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা হলো স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার ডিজাইন, নির্মাণ, পরিচালনা এবং বিনিয়োগের জন্য একটি পদ্ধতি, যা নূ্যনতম পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করে। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটি জলবায়ু-স্মার্ট বিকাশের পথে রাখে, স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং সরবরাহকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সারিবদ্ধ করে। এ পদ্ধতি এনার্জি এবং সম্পদ খরচ কমিয়ে অর্থ সাশ্রয় করে। এটি সেবার মান উন্নত করতে পারে। ক্লাইমেট-স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা চরম আবহাওয়ার ঘটনা এবং অন্যান্য দুর্যোগের জন্য সুবিধার স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালীর পাশাপাশি অভিযোজন পদ্ধতির প্রচার করে।
অনেক স্থিতিস্থাপকতা কৌশলও জলবায়ু প্রশমনে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, জনসাধারণের পরিবহন ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্য খাতের সুবিধাগুলো স্থাপন করা, সৌর এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎসসহ সাইটটিতে এনার্জি উৎপাদন স্থাপন, তাপ এবং এনার্জির মিলিতকরণ, প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলসহ নির্মাণ, শক্তি ক্রয়-দক্ষ চিকিৎসা ডিভাইস এবং টেলিমেডিসিনের মতো স্বাস্থ্য সরবরাহের পরিবর্তনগুলোর স্থিতিস্থাপকতা এবং জলবায়ু ফুটপ্রিন্ট হ্রাস উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখে। হাসপাতালগুলোকে বৃহৎ পাওয়ার গ্রিড ও অবকাঠামোর ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করে।
শূন্য কার্বন নির্গমন বাস্তবায়ন
১. ক্লিন এনার্জির স্থানান্তর : নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার বৃদ্ধি ও কম কার্বন
গ্রিড তৈরি।
২. সতর্কতা অবলম্বন : তাপ এবং বায়ু মানের সূচক সতর্কতা মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে বিতরণ করা।
৩. দৃশ্যমান কার্বন রিপোর্টিং এবং নেট জিরো টার্গেটসহ নিম্ন কার্বন সরবরাহকারীদের থেকে কম কার্বন পণ্য, প্যাকেজিং এবং লজিস্টিক ক্রয় করতে হবে।
৪. ব্যাটারিচালিত এনার্জির ব্যবহার : নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রসারিত করতে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি জেনারেটরের প্রয়োজনীয়তা কমাতে ব্যাটারিচালিত এনার্জির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৫. বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যসেবা বিতরণ :রোগীর ভ্রমণ কমাতে বহু-বিষয়ক পরামর্শ সুবিধা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি।
৬. যন্ত্রপাতির পুনরায় প্রক্রিয়াকরণ :মেডিকেল যন্ত্রপাতির পুনরায় প্রক্রিয়াকরণ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হবে এবং যন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৭. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন : হাসপাতালকেন্দ্রিক সেবা থেকে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ও রোগ প্রতিরোধ পরামর্শ দিতে হবে।
৮. সক্রিয় পরিবহনে উৎসাহিতকরণ :সাইকেল চালানো ও ফুটপাতের ব্যবস্থা সরবরাহ করতে হবে এবং কর্মী ও রোগীদের তা ব্যবহার করার উৎসাহ দিতে হবে।
৯. টেলি স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ :ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগীকে সেবা প্রদান করার সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
১০. দক্ষ এনার্জির ব্যবহার :এলইডি আলোর ব্যবহার এবং আলোর কন্ট্রোল ব্যবস্থা প্রদান।
১১. স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে উৎসাহ প্রদান : স্বাস্থ্যকর সবজি-ফলমূলভিত্তিক খাদ্য খান, পুনঃব্যবহারযোগ্য পাত্রের ব্যবহার এবং বর্জ্য হ্রাস করুন।
১২. বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহার : বিদ্যুৎচালিত যানবাহন ব্যবহার বৃদ্ধি ও চার্জিং সুবিধা সংবলিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো।
মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যেমন দরকার, ঠিক তেমনি পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখাও সমান জরুরি। পরিবেশ সুস্থ থাকলেই পরিবেশের উপাদান মানুষও সুস্থ থাকবে। স্বাস্থ্য খাত থেকে যে দূষণ হয়, তা যেন পরিবেশের ক্ষতি না করতে পারে সেই জন্য দূষণ রোধ করার নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এই নীতিমালা মেনে প্রতিটি স্বাস্থ্য খাতকে তাদের দূষণ কমানোর দিকে জোর দিতে হবে।
ড. আবেদ চৌধুরী: জলবায়ু বিজ্ঞানী ও জাকিয়া বেগম: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল
মন্তব্য করুন