বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে বাতাসের তাণ্ডব। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। থেকে থেকে বজ্রপাতের কানফাটা আওয়াজ। বাংলোর সামনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর লিমুজিন গাড়িটা দাঁড়ানো। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সত্ত্বেও অফিসার প্রহরীরা যার যার পজিশনে সতর্কাবস্থায়।

বৃষ্টি-বাদল মাথায় করে গাড়িটা ভুট্টো ও মুজিবকে নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিল। সামনে-পিছে বিরাট গাড়ির বহর। রাস্তায় লোকজনের চলাচল বলতে গেলে নেই। এমন বর্ষণমুখর আবহাওয়ায় বাইরে আসার উপায় নেই। শহরে বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। চারদিকে ঘন অন্ধকার। লিমুজিনটা মুজিবকে নিয়ে যখন বিমানবন্দরে এলো তখন পাকিস্তানের ঘড়িতে রাত দুটো। তিন ঘণ্টা ধরে পিআইএর একটা বিমান রানওয়েতে রেডি। নিষ্প্রদীপ এয়ারপোর্ট। পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহর সরাসরি একেবারে বিমানবন্দরের টারমাকে গিয়ে থামল। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা আশপাশে নিরাপত্তাবূ্যহ রচনা করে ফেলে। নির্বাক নিস্তব্ধ অথচ ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। ভুট্টোর চেহারা পাংশুবর্ণ। মুখে কোনো কথা নেই। মুজিবের মনে অজানা আশঙ্কা।

কয়েক গজ দূরেই পিআইএর বিমানটি আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত। পাইলট-স্টুয়ার্ড সবাই রেডি। প্রবেশপথে স্বাগত ভঙ্গিতে এয়ার হোস্টেজ দাঁড়িয়ে।

মুজিব বিমানের গ্যাংওয়ে থেকে টারমাকে দাঁড়ানো ভুট্টোর দিকে তাকালেন। নীরব বিনয়সূচক হাত নাড়লেন। ভুট্টোও হাত তোলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিদায় মুহূর্তে সৌজন্যমূলক বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। ভুট্টোর স্বগত উচ্চারণ :পাখি উড়ে গেল। আনুষ্ঠানিক অন্য কোনো আয়োজন ছিল না। গার্ড অব অনারের মতো বিদায় সংবর্ধনা অনুপস্থিত। কাবু শরীর নিয়ে মুজিব ধীর পদক্ষেপে বিমানের ভেতরে গিয়ে নির্ধারিত আসনে বসলেন। এত বড় বিমানে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র যাত্রী। বিমানটি রানওয়ে ছেড়ে আকাশে। ক্লান্ত শরীরটা ঘুমে ভেঙে পড়ছিল। মুজিব বিমানের পেছনের দিকে লাগোয়া তিনটি আসনজুড়ে শুয়ে পড়লেন। পাশে দাঁড়ানো স্টুয়ার্ডদের বললেন, আমার এখন শুধু ঘুমই প্রয়োজন। কাজেই আপনাদের অন্য কোনো অনুরোধ করতে হবে না।

ঘড়িতে ৫টা ১৫ মিনিট। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারে অনুমতি চেয়ে রেডিও বার্তা পাঠানো হলো। বিমানটি তখন জার্মানির দক্ষিণ প্রান্তে ঝড়ের কবলে পতিত। শেখ মুজিবুর রহমান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

পাঁচ মিনিট পর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুরোধ সংবলিত আর একটা রেডিও বার্তা হিথ্রো বিমানবন্দরে ভেসে এলো। বার্তাটি ছিল এ রকম : দয়া করে পররাষ্ট্র দপ্তরে জরুরি মেসেজ দেবেন যে, পাকিস্তান থেকে লন্ডন অভিমুখী বিমানটি কোনো টাইম সিডিউল ছাড়াই এখন আকাশে। বিমানের একমাত্র যাত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধেই ওটা লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছে। ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তব্যরত অফিসার এত রাতে এমন একটা মেসেজ পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। মেসেজের গুরুত্ব অনুধাবন করে আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠলেন। সজাগ সাবধানী মন নিয়ে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডনে আগমনের প্রাথমিক করণীয় কর্তব্যের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন লন্ডনের বাইরে অবসর বিনোদনে। ডিউটি অফিসার প্রধানমন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে ফোন করে শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনের খবরটি পৌঁছালেন। প্রধানমন্ত্রী ঘুম থেকে জাগলেই যেন তাকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি অবহিত করা হয়।

ডিউটি অফিসার এর পর লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রটোকল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। লন্ডনের বিলাসবহুল অভিজাত হোটেল ক্ল্যারিজে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য একটি স্যুট রেডি করে রাখার তাগিদ দেওয়া হয় টেলিফোনে।

লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে খবরটি পৌঁছানো হয়েছে। মিলিটারি গোয়েন্দাপ্রধান ১০ মিনিটের মধ্যে মেসেজ পেয়ে গেছেন। বিমানবন্দরে পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ বিভাগকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করে দেওয়া হয়েছে।

সময় সকাল ৬টা ৩৬ মিনিট। ৯ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে বহনকারী পাকিস্তানের বিমানটি কুয়াশাসিক্ত শীতার্ত ভোরে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করল। পুলিশ পাহারায় একটা রোলস রয়েস গাড়ি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গেল ক্ল্যারিজ হোটেলে। লবিতে মিনিট তিনেক বসার পরেই তাকে নির্ধারিত স্যুটে নিয়ে যাওয়া হলো। নরম সাদা কার্পেট শোভিত রুম। স্বাচ্ছন্দ্যময় ডবল বেড। রুপালি বাটিতে সুন্দর ফুল সাজানো। মার্জিত রুচি, আভিজাত্য ও বিলাসের ছাপ রুমজুড়ে। সাদা সোনালি রক্তের দরজার সামনে দু'জন লোক দাঁড়িয়ে। এরা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য।

রবার্ট পেইন রচিত এবং ওবায়দুল কাদের অনূদিত 'পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু' গ্রন্থ থেকে সংকলিত