- বিশেষ আয়োজন
- দিল্লি ও ঢাকা বিমানবন্দরের জীবন্ত স্মৃতি
দিল্লি ও ঢাকা বিমানবন্দরের জীবন্ত স্মৃতি

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা সূচিত হয়েছিল বটে- বাঙালির জাতিসত্তা প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপূর্ণতা এলো, যেদিন জাতির জীবনে ফিরে এলেন মহানায়ক। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার পরম সৌভাগ্য '৭২-এর ১০ জানুয়ারি দিল্লি এবং ঢাকা; উভয় স্থানে উপস্থিত থেকে জাতির পিতার সেই মহা আগমন প্রত্যক্ষ করার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। সেদিনের প্রতিটি ক্ষণের স্মৃতি আমার মনে এখনও জীবন্ত- থাকবে আজীবন।
স্বাধীনতার পর জানুয়ারির ৪ তারিখ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত নিলেন- বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি, রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি ত্বরান্বিত করা, কতিপয় জরুরি সরবরাহ ও অবকাঠামো নিশ্চিতকরণে একটি প্রতিনিধি দল দিল্লিতে পাঠাবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে এ দলের অন্য সদস্যরা হলেন- পরিকল্পনা কমিশন সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন, রাষ্ট্রাচার-প্রধান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ফারুক চৌধুরী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ইনাম চৌধুরী অর্থাৎ আমি। কলকাতা হয়ে আমরা দিল্লিতে পৌঁছলাম ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২।
৮ জানুয়ারি যখন আমাদের আলোচনা চলছে- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনি দীক্ষিত অত্যন্ত উদ্দীপিত ও উত্তেজিতভাবে এসে নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করলেন- 'বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেছেন এবং এই মুহূর্তে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের (পিআইএ) একটি বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডনের পথে উড্ডীয়মান।' তুমুল হর্ষধ্বনি এবং করতালি। আমাদের আনন্দানুভূতি বর্ণনার অতীত।
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান দিল্লির পালাম এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। সেটি একটি অবর্ণনীয় অনুভূতির মুহূর্ত। প্লেনের দ্বার খুলে গেল। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ধূসর স্যুট এবং কালো ওভারকোট পরিহিত সুদর্শন, ঋজু, দীর্ঘকায়, সহাস্য শেখ মুজিব- রক্তস্নাত সংগ্রাম এবং সীমাহীন ত্যাগে প্রতিষ্ঠিত এক নতুন রাষ্ট্রের জন্মদাতা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালির জাতিসত্তা; বদলে দিয়েছেন এশিয়ার মানচিত্র। হাত তুলে স্বাগতিক জনগোষ্ঠীকে অভিবাদন জানিয়ে উচ্চকণ্ঠে মহানায়ক বলে উঠলেন- 'জয় বাংলা'। চারদিকে স্বতঃস্ম্ফূর্ত হাততালি। ধ্বনিত হলো ২১ বার তোপধ্বনি।
স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, সেনাবাহিনী প্রধানসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা; সাংবাদিক, টেলিভিশন কর্মীসহ বহু গণ্যমান্য লোক। ব্রাশব্যান্ডে গীত হলো বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত- একই বাঙালি কবি রচিত। গার্ড অব অনার পরিদর্শন শেষে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে তার সংক্ষিপ্ত আবেগময়ী আনুষ্ঠানিক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, 'ভারত ও ভারতবাসীকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। ... আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন; করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।' তিনি আরও বললেন- 'অবশেষে জয় হয়েছে অসত্যের ওপর সত্যের; উন্মাদনার ওপর সুস্থ মানসিকতার; কাপুরুষতার ওপর বীরোচিত আচরণের; অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের এবং অনিষ্টের ওপর মঙ্গলের।' আনুষ্ঠানিক এই ইংরেজি ভাষণের খসড়া লিখেছিলেন ফারুক চৌধুরী।
বিমানবন্দর থেকে মোটর মিছিল করে যাওয়া হলো একটি অদূরবর্তী বিরাট জনসভায়। হিন্দিতে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শুরু করলেন বাংলায়। পকেটেই রয়ে গেল তার ইংরেজি ভাষণ। স্বতঃস্ম্ফূর্ত আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধুর কিন্তু সুচিন্তিত ভাষণ। প্রায়শ করতালি। খণ্ডে খণ্ডে হিন্দিতে তরজমা।
বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- সবার সঙ্গেই মিত্রতা, কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই এই নতুন দেশের। কারও বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ-বিদ্বেষ নেই। তিনি একটি শান্তিপূণর্, সংঘাত-বিবর্জিত দক্ষিণ-এশিয়ার স্বপ্নের কথা বললেন- পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে যারা জাতির ও আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে সারাবিশ্বকে শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে হবে সহায়ক।
বিরাট এই জনসভা শেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমভিব্যহারে বঙ্গবন্ধু মোটর মিছিলেই গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। তোরণ-শোভিত পথপার্শ্বে হর্ষোৎফুল্ল জনতার জয়ধ্বনি। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর একান্ত বৈঠক হলো। সম্ভবত আলোচনা চলাকালীনই ভারতীয় রাষ্ট্রাচার-প্রধান মাহবুব খান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বললেন, 'হিজ এক্সেলেন্সি প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্রমণ-সূচির বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি ভারতীয় প্লেনে নয়; যে ব্রিটিশ প্লেনে তিনি এসেছেন, সে প্লেনেই তিনি ঢাকা যাবেন। ভারতীয় প্লেন রাজ-হংসে স্থানান্তরিত তার ও তার সফরসঙ্গীদের ব্যাগেজ ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ওই প্লেনে। আর তিনি সরাসরিই ঢাকা যাবেন। পথমধ্যে কলকাতা নেমে যে এক গণভাষণ দেওয়ার প্রোগ্রাম ছিল, তা বাতিল হয়েছে।' পরে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের অত্যন্ত সঙ্গত কারণগুলো। তার কথা- যে প্লেনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাকে ঢাকা যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করেছেন, তা মাঝপথে পরিবর্তন শিষ্টাচারসম্মত হবে না।
সঠিকভাবেই বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন- কলকাতায় জনসভার জন্য যাত্রাবিরতি হলে তিনি সূর্যালোকে ঢাকা হয়তো পৌঁছাতে পারবেন না। আলোকস্নাত ঢাকাতেই তিনি তার প্রিয় দেশবাসীকে দেখতে চান; কথা বলতে চান। যথার্থ। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাবাসী বাংলাদেশের গৃহত্যাগী জনগণকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতা ও সম্প্রীতির মনোভাব দেখিয়েছে, তার জন্য তিনি বিশেষ করে কলকাতা গিয়েই তার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চান। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, কূটনীতির শিষ্টাচার জ্ঞান, দেশপ্রেম, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মসম্মানবোধ এবং তাৎক্ষণিক যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অসাধারণ ক্ষমতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল।
পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ, রাষ্ট্রাচার-প্রধান ফারুক চৌধুরী এবং লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগত ড. কামাল এবং বেগম কামাল হোসেন, বন্ধু জনাব মাওলা এবং সাংবাদিক আতাউস সামাদ একই প্লেনে বঙ্গবন্ধুর সহগামী হলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কিছু জরুরি কাগজ আগেই পৌঁছানোর জন্য অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন এবং আমি একটি ভারতীয় এয়ারফোর্সের প্লেনে বঙ্গবন্ধুর প্লেন অবতরণের ঘণ্টাখানেক আগে এসেই ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা পৌঁছে দিলাম এবং তারই জন্য সম্ভব হলো ঢাকার বিরাট জনসমুদ্রে মহানায়কের প্রত্যাগমনের সেই ঐতিহাসিক শুভক্ষণটি প্রত্যক্ষ করার।
ওই মুহূর্তেই পরিপূর্ণতা পেল স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পরম বিজয়। প্রথমবারের মতো উদ্বেগাকুল প্রতীক্ষারত ঢাকা স্বাগত জানাল জাতির পিতাকে, বাঙালি জাতিসত্তার স্রষ্টাকে, যিনি চার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক রাজধানীকে রূপান্তরিত করলেন এক নবীন, স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে। আর তারই সৃষ্ট রাজধানীতে বিজয়রথে এলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: সাবেক সচিব; সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ
মন্তব্য করুন