
বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক দীর্ঘ সময়জুড়ে এর ক্ষমতায় ছিল বহিরাগতরা - তাদের কেউ কেউ নিষ্ঠুর হাতে শাসন কাজ চালিয়েছে, কেউ কেউ মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। কোনো রাজশক্তি স্থানীয়দের ধর্মেকর্মে বাধা দেয়নি, অন্য সময়ের কোনো রাজশক্তি হয়তো ধর্মান্তরে উৎসাহিত করেছে। প্রজা হিসেবে বাঙালিরা শোষিত হয়েছে, প্রতিবাদও করেছে, প্রতিরোধও গড়ে তুলেছে, কিন্তু অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে না থাকায় জীবনমানের উন্নয়নের বিষয়টি অধরাই থেকে গেছে। কিছু ভূস্বামী এবং বণিক-সওদাগর বাদে বৃহত্তর বাঙালি সমাজকে দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যহীনতা এবং ক্ষুধার সঙ্গে নিরন্তর এক যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হলে বাংলাদেশের গলায় যে জোয়াল চেপে বসে, তাতে এদেশের মানুষের অবস্থাটা ক্রমশ শোচনীয় হয়েছে।
কিন্তু মানুষ রুখেও দাঁড়িয়েছে। এদেশে কৃষক বিদ্রোহ থেকে নাঙ্গা ফকির বিদ্রোহ সবই হয়েছে। অন্ত্যজ ও প্রান্তিক মানুষ সেসব বিদ্রোহে শক্তি জুগিয়েছে। ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশে হয়, তার তুলনা ভারতের অন্য কোথাও তেমন নেই। পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশ আমাদের ওপর চেপে বসলে এর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়, তাতেও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল শ্রমিক-কৃষকের। অর্থাৎ নিবর্তনমূলক শাসনকে এদেশের মানুষ কখনও মেনে নেয়নি।
এর একটি বড় কারণ, আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত কিছু মূল্যবোধ, শিক্ষা, চর্চা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সংস্কৃতির মূলভূমির, অর্থাৎ লোকসংস্কৃতির, প্রধান শক্তি এর জীবনঘনিষ্ঠতা, এর স্থানীয়ত্ব; লোকবিশ্বাস ও চর্চা, নান্দনিকতা এবং ঐতিহ্যের প্রবল উপস্থিতি। কেন্দ্রের শাসন যত অপরিচিত, শোষণমূলক অথবা আধিপত্যবাদী হোক, লোকসংস্কৃতির প্রবাহ তাতে কখনও বাধাগ্রস্ত হয়নি। এটি এগিয়েছে তার নিজস্ব গতিতে, জীবনকে ধারণ ও প্রতিফলিত করে। এবং এই সংস্কৃতির মূল্যবোধগুলো উৎসাহ জুগিয়েছে সকলকে নিয়ে পথ চলতে, একে অপরের বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়াতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। সত্য ও সুন্দরের বিচার প্রতিটি সংস্কৃতি নিজস্বভাবেই করে, কিন্তু ঘুরেফিরে এদের খুব রকমফের হয় না। ফলে কোনটি অসত্য, কোনটি অসুন্দর চিনে নিতে কষ্ট হয় না।
লোকসংস্কৃতির প্রধান পরিচয় এর মৌখিক, কথ্য চর্চা, লিপির ওপর এর সামান্যই নির্ভরশীলতা। এর চর্চা ও প্রকাশগুলো চলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে এক চমৎকার ধারাবাহিকতায়। মুখে মুখেই চলে এর প্রধান প্রবাহ। এজন্য পালাগান, যাত্রা, আখরাই, গম্ভীরা, কবিগান- যে ধরনই হোক লোকসংস্কৃতির প্রকাশ সেগুলো মানুষ শুনে শুনে স্মৃতিতে গেথে নিয়েছে। সেজন্য সেসব নিয়ে গবেষণা কাজ দুরূহ। কিন্তু যেটুকু গবেষণা হয়েছে, দেখা গেছে, সংস্কৃতির প্রধান বাহন যে ভাষা, তা সব সময়ই জীবনের উত্তাপ ধারণ করেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে নানাভাবে প্রকাশ করেছে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর যখন আমাদের জুড়ে দেওয়া হলো পাকিস্তানের সঙ্গে, মানুষের একটা স্বপ্ন ছিল উপনিবেশমুক্তির। সেই স্বপ্ন দ্রুতই ফিকে হলো, হারিয়ে গেল, যখন পাকিস্তানিদের আসল চেহারাটা বেরুতে থাকল। যখন বাংলা ভাষার ওপর আঘাতটা পড়ল, দেশ ভাগের কয়েক মাসের মাথায়, তখন তাদের নতুন ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য এবং কৌশলগুলো পরিস্কার হয়ে গেল।
একটা বড় ভুল পাকিস্তানের জমিদার ও পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করা শাসকেরা করেছিলেন, যেহেতু সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ তাদের ছিল প্রায় শূন্য, এবং তা ছিল বাংলা ভাষার ওপর ওই আক্রমণ। তারা নিশ্চয় জানতেন না, সংস্কৃতির প্রবাহটা নিশ্চিত করে যে ভাষা, তাতে আঘাত আসা আর সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসাটা একই, এবং যে সংস্কৃতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দীর্ঘদিনের বিদেশি শাসনে একটি গঠন উপকরণেই রূপ নিয়েছে, তাতে প্রতিরোধও হয়ে গেছে স্বয়ংক্রিয় একটি বিষয়। ১৯৫২ সালের এই দিনে যখন ছাত্রদের রক্তে ঢাকার সড়কগুলো লাল হলো, সেদিন এই প্রতিরোধ প্রচণ্ড শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। আমরা জানি, যদি নতুন উপনিবেশের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম-আন্দোলন শুধু রাজনীতির বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে তার সফলতা আসতে অনেক সময় লাগত। জনগণকে নিয়ে যে রাজনীতি হয়, যাতে প্রতিটি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে, তার চর্চার ইতিহাস আমাদের দেশে নেই। ফলে পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে এই রাজনীতি সুফল বয়ে আনতে দীর্ঘ চর্চার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু রাজনীতিতে যখন শক্তি জোগালো রাজনৈতিক প্রতিরোধ, তখন বোঝা গেল এই রাজনীতি মানুষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
২.
সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার সংযোগটা দেখিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, এটি স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু তা কীভাবে হয়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, ভাষার বৈজ্ঞানিক পঠন-পাঠন- অর্থাৎ ভাষাতত্ত্ব- এই বিষয়টি অনেকদিন খুঁটিয়ে দেখেছে। গত পাঁচ-ছয় দশক থেকে শুরু হওয়া নানা থিওরি বা তত্ত্ব, মনোস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বভিত্তিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব বাড়লে নৃতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ব চর্চা পিছিয়ে পড়ল, যাতে মনে করা হয় ভাষা অধ্যয়নের মাধ্যমে ওই ভাষাভাষির সংস্কৃতির অনেক পরিচয় জানা সম্ভব। নৃতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ববিদরা সমাজ গঠন, আত্মীয়তার সম্পর্ক, মানুষের নামের উদ্ভব ও নামকরণ প্রথা, রং ব্যবহার; উৎপ্রেক্ষা, উপমাসহ ভাষায় ব্যবহূত নানা প্রতীক, ভাষায় স্থান ও সময়ের ব্যবহার, স্ত্রী-পুরুষ পার্থক্য, ভাষার সঙ্গে কিংবদন্তির সম্পর্ক, সামাজিক বয়ান- এরকম অনেক বিষয়ে তদন্ত করে ওই ভাষার সংস্কৃতির নানা দিক সম্পর্কে পরিস্কার একটি ধারণা করতে পারেন। পাশাপাশি ভাষা কীভাবে সংস্কৃতির ভেতরের শক্তিকে জাগাতে পারে, এ বিষয়টিও তারা ধরতে পারেন।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পরের ইতিহাসের দিকে তাকালে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। ভাষা যে সংস্কৃতির ভেতরের শক্তিটি জাগাতে পারে, সে বিষয়টির পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই ভাষার অধিকারটি রাজনৈতিক একটি অধিকারের রূপ নিয়েছে, এবং একসময় রাজনৈতিক অধিকারটি ব্যাপক অর্থে স্বাধিকারের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষা যে একটি চলমানতার নাম, এবং এর সক্রিয়তাটি যে শুধু যোগাযোগের কার্যকারিতাকে নিশ্চিত করে, তা নয়, বরং এই সক্রিয়তা চিন্তা ও কাজের সক্রিয়তাকেও নিশ্চিত করে। ভাষা যে শুধু যোগাযোগ, সৃজন ও মননশীলতার চর্চা এবং প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে লাগে তা নয়, ভাষা মানুষের নানান কল্পনার বিস্তার ঘটাতেও সাহায্য করে, যেমন আমরা ভাষা আন্দোলন থেকে শক্তি নিয়ে একসময় একটি রাষ্ট্র গঠনের কল্পনা করতেও শুরু করেছি এবং এর পক্ষে যুক্তিতর্কগুলো শানিত করেছি। এই কাজটি শহরের শিক্ষিত মানুষ এক রকম করেছেন, এবং কেন্দ্রের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা গ্রামের মানুষরা তাদের মতো করে করেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে- নয়া উপনিবেশ শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে, এবং এই কাজটি ত্বরান্বিত করেছে ভাষা আন্দোলন।
১৯৫২ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি যে বদলে যেতে থাকল, তা বোঝা গেল মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা কমতে থাকায়, যে মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালে এর প্রতিষ্ঠার পর থেকে উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ দেখে এসেছে এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভূমিধস ঘটে। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নেয়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনের বড় অংশজুড়ে ছিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বলা যায়, রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগের এটি ছিল ব্যাপক এক আয়োজন ও স্বীকৃতি। এরপর সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে বাঙালির সব আন্দোলনে সাংস্কৃতিক একটি মাত্রা দৃশ্যমান ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন একটি প্রতিরোধ কর্মসূচি হিসেবে দেখা দেয়। আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সূচিত হয়, তা একাধারে ছিল সাংস্কৃতিক (শিক্ষা যেহেতু সংস্কৃতির বৃহত্তর সংজ্ঞায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান) এবং রাজনৈতিক একটি আন্দোলন। একাত্তরে যখন অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে, মুক্তির গান গেয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে বেরিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন শুরু হলে পাকিস্তানি শাসকেরা বুঝতে পেরেছিল, এর প্রভাব সর্বত্র পড়বে। যেখানে যেখানে পড়বে, শিক্ষা-সংস্কৃতির সকল অঞ্চলেই বস্তুত, তারা সচেষ্ট হলো তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে সীমিত রাখতে। পত্রপত্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ল, বাক-স্বাধীনতা খর্ব করা, এবং যেখানে সম্ভব, হরণ করা হলো; বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো, সরকারি চাকরিতে উর্দু ভাষার গুরুত্ব বাড়ল। কিন্তু এসব করে শেষ রক্ষা যে হবে না তারা ঠিকই বুঝতে পারল। আইয়ুব খানের সরকার যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো, এবং এই মামলাকে ঘিরে সংঘটিত হওয়া গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে একসময় আইয়ুব খানও পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তখন আগরতলা মামলার সরকারি পক্ষের একজন কৌঁসুলি মনজুর কাদের, যিনি একসময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, ডন পত্রিকার এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, আইয়ুব খানের পতন ছিল 'ডোমিনো এফেক্ট'-এর এক দুঃখজনক উদাহরণ, যার শুরুটা বাংলা ভাষার দাবিটা অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে, শেষটা হয় ওই পতনে। ডোমিনো এফেক্টের সরল অর্থ হচ্ছে কোনো ঘটনার অভিঘাতে ক্রমাগতভাবে ঘটে যেতে থাকা প্রতিক্রিয়া। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে একটার পর একটা ঘটনা যে শুধু আইয়ুব খানের নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে দিল, সেগুলো এত জোর পেত না যদি না ভাষার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মানুষ একটা বিশাল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলত।
বায়ান্নর পর থেকে শহীদ দিবস উপলক্ষে রাস্তায় আল্পনা আঁকা হতো- এখনও হয়। অথচ আল্পনা একটি নিতান্ত গার্হস্থ্য নান্দনিক নকশা, যার সাদা রং তৈরি হয় নতুন চালের গুঁড়া ভিজিয়ে। আল্পনা ছিল উদযাপনের ও উৎসবের প্রতীক, মঙ্গলের প্রতীক- তা নবান্ন হোক, বিয়ের আয়োজন হোক। সেই আল্পনা যখন রাজপথে আঁকা হতো, লোকসংস্কৃতির এক উদযাপনের স্মারক রূপান্তরিত হতো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রতীকে। আমাদের সংস্কৃতির এই অনেকার্থবিশিষ্টতা, বহুস্তরে বিন্যস্ত প্রতীকময়তা এবং একাধিক তলে বিস্তৃত অভিঘাত সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ রাজনীতি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকেও প্রভাবিত করেছে।
একুশের সংযোগ তাই শুধু ভাষার সঙ্গে নয়, আমাদের প্রতিদিনের সকল কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনচর্চার সঙ্গেও- যার যোগফল হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির একটি সংজ্ঞা।
লেখক
কথাশিল্পী
প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন