দেখতে দেখতে অর্ধশতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেল। কালের স্বাভাবিক নিয়মে আবার ফিরে এসেছে আমাদের ইতিহাসের সেই অগ্নিগর্ভ দিন, ২৬ মার্চ। যে দিনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। অগণন প্রাণ, মান ও ধনের বিনিময়ে সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। স্বভাবতই ২৬ মার্চ আমাদের কাছে বিশেষ গৌরবের দিন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি এই দিনে, দিনটি গৌরবের বটে। কিন্তু এরপরও কথা থাকে। স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যে উদ্দেশ্যাবলি বিদ্যমান ছিল, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কিনা, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে বলে মনে করি। ২৬ মার্চকে কেন্দ্র করে এ বিষয়গুলো নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি ভাবতে হবে আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে।

প্রাপ্তি আমাদের অনেক। স্বাধীনতা নিজেই একটা বড় প্রাপ্তি। পাকিস্তান নামক একটি অমানবিক রাষ্ট্রের অধীনে দীর্ঘ ২৪ বছর নির্যাতিত হয়েছি, শোষিত হয়েছি। কাজেই সেই পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত হওয়াটাই বড় পাওয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা প্রণয়ন করেছি বিশেষ দলিল। দলিলটি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। সেই সংবিধানে আমরা স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছিলাম, রাষ্ট্রের মালিক হবে জনগণ। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম সেই সংবিধানে।
প্রথমে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি। ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থ সম্পূর্ণ হয় না। ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদী একটা রাষ্ট্রের অধীন থেকে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি প্রকৃত প্রস্তাবে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্ম হবে যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার। সেই ধর্মনিরপেক্ষতা কি আমরা বজায় রাখতে পেরেছি? দেখা যায়, যে সংবিধান আমরা রচনা করেছিলাম, একটা বিশেষ সময়ে এসে, আমাদের রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে, কাটাছেঁড়া করে সেই সংবিধানের মূল মর্ম হরণ করে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যখন দেখি, একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করেও বলা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় আছে; তখন এটাকে গোঁজামিল ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ২৬ মার্চের প্রারম্ভে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। শুধু ভাবলে চলবে না, এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল স্বাধীনতার মূল মর্ম অনুধাবন করা যাবে। এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে পারব।

সমাজতন্ত্রকে যদিও আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম একটি মূলনীতি করা হয়েছিল, কিন্তু এই রাষ্ট্রকে আমরা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করিনি। আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম? আমরা চেয়েছিলাম আমাদের রাষ্ট্রে একটা শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যার মাধ্যমে আমরা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি, এখানে সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু ব্যক্তি মালিকানা কোনো মতে নিরঙ্কুশ নয় বা একান্ত মৌলিক অধিকারও নয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা- এই তিন ধরনের মালিকানা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। অপরিমেয় বা অসীম সম্পত্তির মালিক হওয়ার পথ এখানে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানা লাভের সুযোগকে সীমিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে ব্যক্তিগত মালিকানা খর্ব করে যে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের হাতে দেওয়া আছে। সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, সুযোগের সমতা, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। এই রাষ্ট্রের অনেক উন্নয়ন যে হয়েছে, সে কথা স্বীকার করে নেওয়ার পরও প্রশ্ন করতে হয়, রাষ্ট্রে দারিদ্র্যের এত বিস্তার কেন, বিত্তবানদের ক্ষমতার দাপটের সামনে দরিদ্রদের অক্ষমতা এত বিশ্রীরূপে প্রকট হয়ে ওঠে কেমন করে? চলমান যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে আমাদের সমাজে, তা কি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ধারক? এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হবে। যদিও উত্তরগুলোও আমাদের অজানা নয়। স্বাধীনতার অল্প সময়ের মধ্যেই যে অসাধারণ সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, দীর্ঘ দিনেও তা কার্যকর তো করা যায়নি বরং কেটেকুটে তার মূলমর্মকে বিকৃত করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসন, জনগণকে গলা টিপে ধরে স্বাধীনতা ও সুশাসনকে অকার্যকর করে রাখে। যার ফলে ঘটতে থাকে দারিদ্র্যের ক্রমবিস্তার। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়ে ব্যক্তিমালিকানার অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। জনগণের অর্থ ঋণগ্রহণের নামে লুণ্ঠনই এ দেশে বড়লোক হওয়ার প্রধান উপায়। তারই যোগ্য অনুসারী হয়ে আছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস। এ অবস্থার অবসান না ঘটিয়ে দারিদ্র্যের বিলুপ্তি কী আশা করা যায়, আশা করা যায় কি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা? আমরা আশা করেছিলাম এ দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না, সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। তার কিছুই তো হয়নি বরং সামরিক শাসনের পর থেকে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে জনগণের সম্পদ চলে যাচ্ছে। যারা মাঝারি কৃষক বা উদ্যোক্তা, তারা দুই থেকে দশ লাখ টাকাও ঋণ পাচ্ছেন না কিন্তু শতকোটি টাকা ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। এই কাণ্ডগুলো ঘটার কারণে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। যারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাই সুবিধাভোগী। আর সাধারণ মানুষ কিছুই পাচ্ছে না। এই কথাগুলো আমি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার থেকে গ্রহণ করেছি।

কালের রীতিতে বছর ঘুরেই ২৬ মার্চ ফিরে ফিরে আসে। শুধু কথা বললেই হবে না। দিনটিকে সামনে রেখে আমাদের আত্মসমালোচনার কষ্টিপাথরে নিজেদের যাচাই করতে হবে। তা যদি যাচাই করি, তবে উন্নয়নের কথা আমরা স্বীকার করব অবশ্যই। দেখব, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ আরও অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে- কিন্তু এই উন্নয়ন দেশের আপামর জনসাধারণ ভোগ করতে পারছে না, সেই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২৬ মার্চ দিনটিকে প্রতিপালন করতে হবে। এই দিনে আমাদের সবাই প্রতিজ্ঞা করব- স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে সংবিধান লাভ করেছি, সেই সংবিধান অবিকৃতরূপে গ্রহণ করব।

বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে যে কথা বলেছিলেন, তা স্মরণ করছি। তিনি শোষিতের গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। শোষিতের গণতন্ত্র বাস্তবায়নে তিনি চার দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এক. বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম সমবায় গঠন, দুই. মধ্যস্বত্বভোগী গ্রামীণ জোতদার, মহাজন, ধনিক বা বণিক শ্রেণির উচ্ছেদ, তিন. উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন শক্তির বিকাশ সাধন, চার. আমলাতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের ব্যাপক গণতন্ত্রায়ন। এই বিষয়গুলোর মধ্যে যে সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন নিহিত আছে, এটা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি জোর দিয়েছিলেন বহুমাত্রিক সমবায়ের ওপর। এই সমবায়ের মধ্য দিয়ে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা তথা সমাজের আমূল রূপান্তর ঘটে যেতে পারে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উদ্ভাবিত সমবায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে সমবায়ের চিন্তা করেছিলেন তার কোনো মিল ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সে সমবায়ের চিন্তা থেকেও আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। ধনী আরও ধনী আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে, এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

স্বাধীনতার সুফল আমাদের সবার কাছে যেন পৌঁছে এবং স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এ ক্ষেত্রে তৎপর ও দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের কাছে আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস যে তুলে ধরতে পারিনি, এটা সত্য। এই সত্য স্বীকার করে নিয়ে, স্বাধীনতার ইতিহাস, মূল্যবোধ বুঝাতে হবে। আশা করি, এর মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতাকে যথার্থ অর্থবহ করে তুলতে পারব।

লেখক
শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক