- বিশেষ আয়োজন
- প্রকৌশলীদের অসাধ্য সাধন
প্রকৌশলীদের অসাধ্য সাধন

খরস্রোতা প্রমত্ত পদ্মায় সেতু নির্মাণ সম্ভব- এ বিশ্বাসই ছিল না অনেকের। মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীরা পদ্মা নদী দেখার পর সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়- এমন মতামত দিয়ে কেটে পড়েছিলেন। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে কারিগরি ও প্রকৌশল দক্ষতায় তিলে তিলে তৈরি হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
এ সেতু নির্মাণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা নদীই। নদীর তলদেশের মাটি নরম। কয়েকশ মিটার গভীরেও পাথরের স্তর নেই। এমন একটি নদীতে কাদার ওপর কীভাবে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ ও তাকে টিকিয়ে রাখা হবে- এটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেতু বিভাগের প্রতিবেদনে ১৩ চ্যালেঞ্জের কথা উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইকম সেতুর নকশা তৈরি করে। বিশ্ববিখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখা যায়, তাদের সিগনেচার স্থাপনায় রয়েছে পদ্মা সেতুও। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে সদর কার্যালয় হলেও দুনিয়াজুড়ে কাজ করে বহুজাতিক প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এইকম। ৫১ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছে সংস্থাটির। পদ্মা সেতুর লিড ডিজাইনার ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। তবে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও অনেকেই।
সেতুর জন্য শক্ত ভিত তৈরিতে প্রথমে ড্রেজার দিয়ে বালু সরিয়ে নদীতে পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলো একেকটি ৮০০ থেকে হাজার কেজির। প্যানেল অব এক্সপার্ট সদস্য আইনুন নিশাত জানান, ভিত তৈরির পর শুরু হয় পাইল বসানোর কাজ।
পদ্মা সেতুর পিলার (খুঁটি) তৈরিতে পরীক্ষামূলক পাইলিং শুরু হয় ২০১৫ সালের ১ মার্চ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর। চীন থেকে সাগর পথে বাংলাদেশে আসে পাইলিং পাইপ বানানোর ইস্পাতের পাত। ৬০ মিলিমিটার বা ২ দশমিক ৩৬ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাতগুলো। একেকটির ওজন ১৩ টন। এসব ইস্পাতের পাতকে দানবীয় শক্তির বেন্ডিং মেশিন দিয়ে সিলিন্ডারের আকৃতি দেওয়া হয়। ৩ দশমিক ২ মিটার বা ১০ ফুট ব্যাসের একেবারে নিখুঁত গোলাকার ২৫টি সিলিন্ডার একত্রে যোগ করে তৈরি এক একটি পাইলপাইপ। ৯৮ থেকে ১২৫ দশমিক ৪৬ মিটার দীর্ঘ ছিল পাইলপাইপ। এগুলো নদীর তলদেশে পোঁতার পর ভেতরে রড ও সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে পিলারের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে।
পদ্মায় স্রোতের কারণে পাইল ড্রাইভিং বা পাইল বসানোও দুরূহ ছিল। প্রথমে নদীর তলদেশ পর্যন্ত পাইল গাইড বসানো হয়। এর মধ্য থেকে পানি সেচে ফেলা হয়। এরপর ক্রেন দিয়ে কিছু আনুভূমিকভাবে পাইলিং পাইপ পোঁতা শুরু হয় শক্তিশালী হাতুড়ি বা হাইড্রোলিক হ্যামার দিয়ে পিটিয়ে। তিনটি জার্মান ও দুটি ডাচ হাতুড়ি ছিল। এগুলোর প্রতি আঘাতের ক্ষমতা ছিল তিন হাজার কিলোজুল পর্যন্ত।
পাইল বসাতে গিয়েই সবচেয়ে বড় কারিগরি বাধায় পড়ে পদ্মা সেতু। নকশা অনুযায়ী, প্রতিটি পিলারের নিচে ছয়টি পাইল বসানো হবে। নদীর তলদেশের ১২৮ মিটারে পাথরের স্তর পাওয়া যায়নি। নদীর বুকের ৪০ পিলারের মধ্যে ১৪টিতেই ছিল এ সমস্যা। এ কারণে দুই বছর এসব পিলারের কাজ আটকে ছিল। এ কারণে নকশা সংশোধন করতে হয় প্রকল্পের মাঝপথে। তবে স্থায়িত্বের জন্য ২২ পিলারে একটি করে বাড়তি পাইল করতে হয় ছয় পাইলের মাঝখানে। মিহি সিমেন্ট ঢুকিয়ে পাইলের শেষ প্রান্তে পাথরের মতো শক্ত ভিত্তি তৈরি করা হয় কৃত্রিমভাবে। বাকি ১৮ পিলারে ৬টি করে পাইল করা হয়েছে। নদীর তীরের মাটিতে নির্মিত ১ ও ৪২ নম্বর পিলারে ১৬টি কংক্রিট পাইল করা হয়েছে। সবমিলিয়ে সেতুতে পাইলের সংখ্যা ২৯৪।
২০২১ সালের মার্চে সব পিলার তৈরি হয়। তখন বাধা হয়ে যায় ট্রাস নামে পরিচিতি পাওয়া স্প্যান জটিলতা। পদ্মা সেতু ইংরেজি 'এস' অক্ষরের মতো। এ কারণে সেতুর ৪১টি স্প্যান এবং দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবে ভিন্নতা রয়েছে। নির্দিষ্ট দুই পিলারের মাঝে স্থাপনের জন্য নির্মিত ট্রাস ও রোডওয়ে স্ল্যাব অন্য কোথাও স্থাপনের সুযোগও ছিল না। নদীর তলদেশের সমস্যায় পিলার নির্মাণে বিলম্বের কারণে নির্মিত ট্রাস ও রোডওয়ে স্ল্যাব নিয়ে কারিগরি সমস্যা পোহাতে হয়।
পদ্মার স্রোত শুধু সর্বনাশা নয়, আশীর্বাদও। এই স্রোতের কারণে পদ্মার ইলিশ দুনিয়াজুড়ে বিখ্যাত। ইলিশ বাংলাদেশের জিডিপির ১ শতাংশ জোগান দেয়। সেতুতে নির্মাণকাজের কারণে ইলিশ পদ্মাবিমুখ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সে কারণেই পদ্মায় পিলারের সংখ্যা যমুনার তুলনায় কম, যেন স্রোত ব্যাহত না হয়, যাতে চর পড়ে নদী সংকুচিত না হয়। আইনুন নিশাত জানান, মাছের জন্য পাইলিংয়ের সময় শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন