বন্যা আর বর্ষা ঋতুর রূপ-বৈচিত্র্য মানে বাঙালির চিরকালীন এবং চিরচেনা এক অভিজ্ঞতা। বর্ষা ও বন্যা একে অপরের অঙ্গে জড়িয়ে আছে। স্মরণাতীত কাল থেকে বর্ষা এলে আমাদের এ নিম্ন-গাঙ্গেয় বদ্বীপ জলে প্লাবিত হয়। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের আওতায় কোম্পানির শাসন অর্থাৎ যখন জেলা শাসন ব্যবস্থা চালু হয় তখনই ব্রিটিশ সরকারের কাছে এটি চিহ্নিত ছিল জলাশয় অঞ্চল হিসেবে। এখানে খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি মানুষের নিত্যসঙ্গী। যদিও কম বর্ষার নেতিবাচক ফল নিয়ে আমরা কখনও বেশি উদ্বিগ্ন নই। আমরা হয়তো গভীরভাবে ভাবি না প্লাবনের সঙ্গে জমির উর্বরতার সম্পর্ক নিবিড়। বেশি হলেই যত সমস্যা, যত কষ্ট-বেদনা ও মানবিকতার প্রশ্ন ওঠে। সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞগণের আলোচনা আর তর্ক-বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। সরাসরি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াই এবং আঙুল তুলে বলি, বন্যার জন্য এই প্রকল্প দায়ী, ওই রাস্তা বা বাঁধ দায়ী এবং পুরো দায় সরকারের। অন্য কিছু বিষয় নেই। এমন অবিবেকি, গতানুগতিক চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে ভেতর থেকেই এর যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে। আমরা সবাই জানি, উজানের ঢলে, বাঁধভাঙা জলে, ডুবে যাওয়া ফসলের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি। এসব আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবেই দৃশ্যমান। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অভাবনীয় মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতাও বন্যাসহ সব দুর্যোগের জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী। নব্বইয়ের দশক থেকে 'ধরিত্রী সম্মেলন' নামে বিশ্ব সম্মেলনে এ গীত গাওয়া হয়ে আসছে। স্থায়ী সমাধানের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিলের অন্ত নেই। আর আজকের বিশ্ব মানে প্রযুক্তিনির্ভর সচেতনতার বিশ্ব। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী এদেশ ওদেশকে দোষারোপ করার হেতু কী- জানি না। আমার কাছে স্পষ্ট নয়, বোধগম্যও নয়।

২) নিজের জীবদ্দশায়, এখনও অল্প মনে পড়ে ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কথা। শুনেছি, এর কোনো রাষ্ট্রীয় পূর্বাভাস ছিল না। তিন দিন পর ঢাকায় পত্রিকা পড়ে নাকি মানুষ জেনেছিল দেশের উপকূলবর্তী জেলায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর খবর। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, গবাদি পশু, ফসল গাছপালা সবই চলে যায় এক নিমেষের আকস্মিকতায় এবং অকালে। স্বাধীনতার পর আমরা জেনেছি, এমন ভয়ংকর ও অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশল।

৩) ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা স্পষ্টভাবে মনে পড়ে। সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা; স্বজনহারা মানুষের আহাজারি তখনও থামেনি; রক্তের দাগ ও ক্ষত শুকায়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে কেবল নরহত্যা নয়; মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমহানি নয়; তাদের কারণে হাজার হাজার ব্রিজ-কালভার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরই মধ্যে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে দেশব্যাপী নেমে আসে প্রবল বন্যা। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের মানুষের নৌকা-জীবনের সাক্ষী হয়ে আছি আমি নিজেই। নৌকার প্রাচুর্য ছিল বিধায় তখন মানুষ নৌকায়ও রাত্রি যাপন করেছে। তখনও দেশের মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটিতে সীমিত ছিল। বন্যার্ত মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ-দুর্দশা দেখেছিলাম চোখের জলে। চাল-ডালের কঠিন সংকট মোকাবিলার চেয়েও সর্বাধিক আলোচিত ছিল লবণের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়। এ মূল্য ছিল অকল্পনীয় এবং আকাশছোঁয়া। সে সময় স্থানীয় বাজার থেকে খুব অল্প পরিমাণ লবণ কেনার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিজেরই আছে। বন্যার পানি নেমে গেলে নানা রোগবালাই ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র গ্রামবাংলায়। সেদিনও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করেছিল।

অনুন্নত সড়ক যোগাযোগের মধ্যে সরকারের দেওয়া সীমিত ত্রাণও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল বলে মনে পড়ে।

৪) ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত বিশাল বাংলাকে অবলোকন করেছিলাম খুব কাছে থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করা এক আশাবাদী যুবক আমি। বন্যায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। পল্টনের নিকটে মতিঝিল শিল্পাঞ্চলজুড়ে থৈথৈ জল। রিকশা করে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাওয়া দুস্কর হয়ে উঠেছিল। বন্যাদুর্গত এলাকায় সরবরাহ করার নিমিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাশ্রমে গণ স্যালাইন তৈরির এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তৎকালীন ডাকসুর উদ্যোগে মধুর ক্যান্টিনের বিপরীতে নব প্রতিষ্ঠিত ডাকসু ভবনের ক্যাফেতে দিনভর স্যালাইন বানানোর উৎসবে অংশ নিয়েছিলাম। ছাত্র-শিক্ষক সবাই এ কাজে স্বতঃস্ম্ফূর্ত হয়ে উঠেছিলেন। সেদিন মানুষের জন্য কিছু একটা করার আকুতি নিয়ে সবাই দৌড়েছি এদিক-ওদিক। সেই স্যালাইন প্রস্তুতকালে শিক্ষকদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেছিলেন এক অসাধারণ রম্য রচনা, যা নিরঙ্কুশ আনন্দের খোরাক হয়েছিল সবার। মনে পড়ে, সে সময় ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি কলেজে লেকচারার পদে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। বন্যায় ভেসে গেছে গোটা দেশ। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চালু থাকলেও কানায় কানায় বন্যার জলে ছুঁই ছুঁই। ময়মনসিংহ শহর থেকে অন্যত্র যাওয়া মানে নৌকার কোনো বিকল্প ছিল না।

কোনো কোনো স্থানে রেললাইন পানির নিচে তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও রেল যোগাযোগও সাময়িক বন্ধ ছিল। ঢাকায় ফিরে আসার দীর্ঘ বিড়ম্বনার কাহিনি কখনও ভোলার নয়।

৫) ১৯৯১ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ভেসে গিয়েছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামের আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও জনপদে। সরকারি চাকরির সুবাদে নিজেই অংশ নিয়েছিলাম ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, মিরসরাই; কক্সবাজারের চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী এলাকা সাগরের জলোচ্ছ্বাসে দুমড়েমুচড়ে যায়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের বসতি ঘরবাড়ি, গরু-মহিষের পাল, দোকানপাট, ব্যবসাপাতি যাবতীয় গ্রামীণ অর্থনীতির অনুষঙ্গ। খোলা আকাশের নিচে সন্দ্বীপের হাজার হাজার মানুষকে রাত্রি যাপন করতে দেখেছি। প্রাপ্ত দেশি-বিদেশি ত্রাণ কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে দিয়েছিলাম নিঃস্ব, সর্বহারা মানুষের হাতে। সেদিনও সরকারের পাশাপাশি শত শত এনজিও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিল।

৬) দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় উতরিয়ে ক্রমাগত সাফল্য অর্জন করার বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী বাংলাদেশ। আমাদের জন্মই হয়েছে প্রকৃতির বিরূপতাকে অকুতোভয় সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। এখানে পরাজিত হওয়ার কোনো অতীত নেই; আছে অগণিত গৌরবগাথা। দুর্যোগে পরাভব মানে না বাঙালি। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ ভেদ না করে একতা, সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমবোধ নিয়ে এগিয়ে এলে এবারের বন্যাও সহজে মোকাবিলা করা যাবে। তা ছাড়া প্রতিটি দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতাও অর্জন করে চলেছি। এই মুহূর্তে সমালোচনা করে সময় নষ্ট করার মতো কাজ থেকে সবারই বিরত থাকা জরুরি। শুরুতে সরকারের জনমুখী উদ্যোগকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা দরকার; একই সঙ্গে ত্রাণ তৎপরতা সহজীকরণ ও দ্রুততার সঙ্গে করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। দেশে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করছে অসংখ্য এনজিও এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। তারাও কালবিলম্ব না করে সরকারের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে মানুষের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াক। আর বৃহত্তর সিলেট সব সময় বিলাতের ঐতিহ্যে উদ্ভাসিত। তাঁরাও যেন বানভাসি, জলবাসী অসহায় মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। বন্যা কখনও হতে পারে না বাঙালির কান্না।

হোসেন আবদুল মান্নান: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক