- বিশেষ আয়োজন
- গেরস্থালিতে প্রযুক্তি
গেরস্থালিতে প্রযুক্তি

একটা সময় উৎসব আয়োজনে তো বটেই, নিত্য সংসারের রান্নায় মসলা পিষতে মা-খালাদের ঘাম ছুটে যেত। এখন আঙুলের স্পর্শে নিমিষে ছাতু হচ্ছে হলুদ-মরিচ-দারুচিনি। হামানদিস্তা বা শিল-পাটার জায়গা নিয়েছে ব্লেন্ডার। এভাবেই ঘর-গেরস্থালিতে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, জুসার, গ্যাসস্টোভের মতো প্রযুক্তি পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে সহজ। পেশাজীবী নারীর জীবনে এনেছে দুর্বার গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও মাটির চুলায় গোবরের ঘুঁটে জ্বালানোর মতো কষ্ট গৃহিণীদের কমই করতে হচ্ছে। মুহূর্তে গ্যাসস্টোভে রান্না চড়িয়ে রিমোট হাতে এলইডি টিভির সামনে সময় কিংবা ওয়াশিং মেশিনে অনায়াসে পরিস্কার করে নিতে পারছেন পরিবারের সবার পোশাক।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ছাপ পড়েছে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনে। তারে আয়-রোজগার বাড়ার সঙ্গে জীবনযাপনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালি পণ্য। গৃহে বিনোদন ও আরাম বাড়াতে আছে টিভি ও এসির মতো ইলেকট্রনিক পণ্য। বিদ্যুতায়নের ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের চাহিদা বেড়েছে। বড় হচ্ছে বাজারের পরিধি। মাত্র এক দশকেই দেশে তিন গুণ বেড়ে প্রায় ২৪০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে এসব পণ্যের বাজার। বাণিজ্যসংশ্নিষ্টরা জানাচ্ছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ এটি চার গুণ বেড়ে পৌঁছাতে পারে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকায়। আনন্দের বিষয়, চাহিদার বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের বেশিরভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করছে। শুধু তাই নয়, সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য তারা মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। অপার সম্ভাবনা রয়েছে রপ্তানিরও। তবে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের বাজার প্রসারে দরকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ এবং সরকারের আরও নীতিসহায়তা।
বিশ্নেষকরা বলছেন, স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সরকারের কর ও শুল্ক্ক ছাড়ের মতো নীতিসহায়তার সুযোগ নিতে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন কারখানা। ফলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে এই খাত। এতে একদিকে দেশের চাহিদা মিটছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানও বাড়বে।
দেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের বাজার নিয়ে গত বছরের শেষদিকে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিনিয়োগ সংস্থা-ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট। এতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজার চারগুণ বেড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। বর্তমান এই পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ২২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। গত দশকে এই খাতের বাজার ১৪ শতাংশ হারে বাড়লেও আগামী দশকে তা ১৭ শতাংশ হারে বাড়বে।
ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান সমকালকে বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে স্পষ্ট, হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যটি বর্ধনশীল খাতের দিকে এগোচ্ছে। মূলত সরকারের কিছু নীতিসহায়তার কারণে এই খাতের বিকাশ ঘটছে। তিনি আরও বলেন, আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগের রুচি বেড়েছে। ফলে ভবিষ্যতে এই খাত অর্থনীতির অন্যতম চালকের আসনে বসবে। মূলত স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হওয়ায় এসব পণ্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে। তবে সরকারের সহায়তার মাধ্যমে এসব শিল্প আরও বড় হলে তাঁরা ভোক্তার জন্য পণ্য আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করেন রাশেদুল হাসান।
যেভাবে বড় হচ্ছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাত :দেশব্যাপী বিদ্যুতায়ন, মাথাপিছু আয় ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, পণ্য ক্রয়ে সহজ অর্থায়ন ও সহায়ক নীতির কারণে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গ্রামে কিংবা শহরে ছোটবড় সব পরিবারেই এখন ফ্রিজ প্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। মানুষ খাবারের উৎস থেকে যত দূরে সরবে, ততই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠবে ফ্রিজ। কারণ, পচনশীল খাবার পথে বহনের সময়ে এবং বাসায় নেওয়ার পর ঠিক রাখতে হলে অবশ্যই সেগুলো ঠান্ডায় রাখতে হবে। এ কারণেই ফ্রিজের বিকল্প নেই।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রা। এর ফলে বিশাল চাহিদা তৈরি হচ্ছে এয়ার কন্ডিশনার বা এসির। অফিস-আদালত, শপিং মলের পাশাপাশি শহরের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতেই এখন ব্যবহার হচ্ছে এসি। অন্যদিকে, গ্যাসের সরবরাহে টান পড়ায় বহু মানুষ ব্যবহার করছেন ইলেকট্রিক ওভেন বা প্রেসার কুকার। এভাবেই প্রতিটি হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, বড় হচ্ছে এই খাত।
হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের ধরন :হোম অ্যাপ্লায়েন্স মূলত এমন সব যন্ত্রপাতি, যা আধুনিক ও কর্মব্যস্ত জীবনে গেরস্থালির প্রাত্যহিক কাজকে আরও সহজ এবং আরামদায়ক করে তোলে। যেমন- ফ্রিজ, এসি, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, আয়রন, ইলেকট্রিক কেটলি, ওভেন, ব্লেন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ফ্লাস্ক ও ক্লিনার, গ্যাসস্টোভ ইত্যাদি। যদিও এসব পণ্যের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ফ্রিজ।
কী বলছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা :হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, খাতটি এখন সোনালি যুগ পার করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বাসাবাড়িতে মানুষ ব্যাপকহারে এসব পণ্য ব্যবহার করছেন। স্বস্তির বিষয়, এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে এই খাতের বিভিন্ন পণ্য। বিশেষ করে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ফ্রিজ ও ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টিভি দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। গড়ে উঠছে ফ্রিজ, টেলিভিশন, এসি, ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদনকারী বহু কারখানা। এতে দেশীয় উৎপাদনকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, যার সুফল পাচ্ছেন ভোক্তারা। সাধ্যের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষের এসব পণ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
খাত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে গত এক দশকে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের বাজার ৬ থেকে ৮ গুণ বড় হয়েছে। আগামী এক দশকে তা আরও ৩ থেকে ৪ গুণ বড় হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দু-একটি দেশীয় কোম্পানি তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও শুরু করেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি ও মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশ ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য নিচ্ছে। এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে দরকার দক্ষ জনবল। ফ্রিজ এখন নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই সরকারের উচিত এই খাতে শিল্পবান্ধব নীতিসহায়তা ও কাঁচামাল আমদানি সহজ করা।
বাজারের আকার কত :ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের গবেষণায় হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজারের বর্তমান আকার ২২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা বলা হলেও এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এটি আরও বেশি। তাঁদের ধারণা, দেশে হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বার্ষিক বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বড় অংশই হচ্ছে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজের, যা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার। আর ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার বাজার এলইডি টিভির। অন্যান্য পণ্যের বাজার আছে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর আকার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ওরিয়ন হোম অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের চিফ মার্কেটিং অফিসার মো. আবু তারিক জিয়া চৌধুরী বলেন, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এই খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে নতুন বাজেটে কিছু ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এ খাতের উন্নয়নে অন্তত ১০ বছরের একটি নীতি-পরিকল্পনা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন