
দুইশ বছর ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তানের জন্ম হলো। পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কিছু দিনের ভেতর আমাদের মোহভঙ্গ হলো, যার সূচনা ঘটেছিল পাকিস্তানের তথাকথিত স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাধ্যমে। যখন তিনি উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন তখনই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আর এই রুখে দাঁড়ানোর ভেতর দিয়ে আমাদের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন সূচিত হয়েছিল। ক্রমে আমরা একে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলাম। যার ফলে আমাদের সংগ্রামী উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মাধ্যমে সেই সংগ্রাম আরও বেগপ্রাপ্ত হয়। এরই মধ্যে পাকিস্তান সরকার আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত, ভাষা বিনষ্ট করার জন্য অপচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। আমরা একে একে সেসব প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছিলাম। ১৯৬১ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলে তা ব্যর্থ করে দেওয়ার আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের সংগ্রাম বেগপ্রাপ্ত হয়। শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা নয়, নজরুলকে খণ্ডিত করারও চেষ্টা চলছিল।
সেসব চেষ্টা আমরা রুখে দিয়েছিলাম এবং এতে করে আন্দোলন একটা দৃঢ় সাংস্কৃতিক ভিত পেয়েছিল। সংগ্রাম, আন্দোলন সফল হয়েছিল।
বলা হয় রাজনীতিকরাই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন এবং আমরা স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি। এ কথা সত্য হলেও, এ সত্য আংশিক। পুরো সত্যটা হলো, আমরা একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিলাম, যার হাত ধরে রাজনীতিকরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলবতী করে তুলতে পেরেছিলেন। অন্যথায় সম্ভব হতো না। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে মানসিক ভিত তৈরি করে দিয়েছিল, তার প্রভাবেই রাজনৈতিক আন্দোলন ঘনীভূত হয় এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হয়। সংগ্রাম কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, কত প্রাণ-মান বিসর্জনের ভেতর দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তা সবার জানা। এরপর আমাদের সংবিধান রচনায় আমরা চার মূলনীতি দাঁড় করেছিলাম- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা; যা আমাদের এতকালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল। কিন্তু এরপর মাত্র চার বছরের মাথায় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। পরবর্তী সরকার আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে নিয়ে গেল পাকিস্তানের অপসাংস্কৃতিক আদর্শের দিকে। এরপর, আমি যাকে বলি, পাকিস্তানের ভূত আমাদের ওপর ভর করল, যার কবল থেকে আমরা এখন পর্যন্ত মুক্ত হতে পারিনি। আমরা আমাদের সেই প্রারম্ভিক যুক্তিযুক্ত সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার মূলের কাছে সাংবিধানিকভাবে আর ফিরে যেতে পারিনি। এখানে রাষ্ট্রধর্ম আছে আবার ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে- এটা স্পষ্ট গোঁজামিল। এই গোঁজামিল দূর করার জন্য প্রয়োজন আমাদের সেই প্রথম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাছে ফিরে যাওয়া, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা যা অনেকটাই বিস্মৃত হয়েছি।
এখনও কিছু সাংস্কৃতিক আন্দোলন বজায় আছে কিন্তু দুঃখের বিষয়, এগুলো মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত নয়। কাজেই যদি আমরা পাকিস্তানের ভূত তাড়াতে চাই, নতুনভাবে সেই আদি, জনসম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে, তা বাংলাদেশের জন্মকালীন সেই আদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া দূর করা সম্ভব না।
আমি হাঙ্গেরির দার্শনিক লুকাচের কথা প্রায়ই স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন, সংস্কৃতি হচ্ছে লক্ষ্য, রাজনীতি হচ্ছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় মাত্র। সংস্কৃতিই যে লক্ষ্য- এ কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। এই বিস্মৃতির কবল থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমাদের যে ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন বজায় আছে, তা একেবারেই নগরকেন্দ্রিক। এখানে গ্রামের মানুষের সংশ্নিষ্টতা নেই বললেই চলে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া গ্রামীণ মানুষ এই আন্দোলনের বাইরে বিধায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রকৃত প্রস্তাবে তৃণমূলের মানুষসহ গ্রামবাংলার মানুষকে যদি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত করে তোলা না যায়, তাহলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দূর করা সম্ভব হবে না। সম্ভব না হলে পাকিস্তানের ভূতটিকেও নামানো যাবে না। আমাদের দুর্ভোগও আর শেষ হবে না। প্রকৃত রাজনীতি, প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্যবোধকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাই অবিলম্বে সেই সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টির প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নামতে হবে।
সংস্কৃতি যে সম্যক কৃতি- সে কথা আমি বিভিন্ন স্থানে বলেছি। কিন্তু এই সম্যক কৃতির ক্ষেত্রটা কী? ক্ষেত্রটা হলো প্রকৃতি। প্রকৃতিই মূল এবং এই প্রকৃতির সঙ্গে সম্যক বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই প্রকৃতি হতে পারে বাইরের প্রকৃতি, হতে পারে ভেতরের প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়ায় গিয়ে তাকে পরিবর্তন করে আমরা ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা প্রভৃতি নির্মাণ করে সভ্যতা তৈরি করি। এ হলো বাইরের প্রকৃতি। আমরা সংস্কৃতি বলতে সাধারণত ভেতরের প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া ও তাকে পরিবর্তন করাকে বোঝাই। যেমন গানবাজনা, সাহিত্য, চিত্রকলা প্রভৃতিকে বোঝাই। আমাদের এই বোঝাপড়াটা কিন্তু খণ্ডিত। সংস্কৃতিকে সম্যকভাবে বুঝে প্রকৃতির সঙ্গে লাগসই মধ্যস্থতা করতে হবে। একেই লক্ষ্যে পরিণত করতে হবে। তা না করে আমরা যদি সংস্কৃতির খণ্ডিত বোধকে ধারণ করি, তাহলে সুফল পেতে আমরা ব্যর্থ হব।
দুটো সাংস্কৃতিক ধারা রয়েছে, বৈষয়িক ও আত্মিক। প্রকৃতি-সংস্কৃতি এ দুটোর সমন্বয় জরুরি। আমাদের সংস্কৃতিকে সংস্কৃতির প্রকৃতিগত পথে ফেরানো জন্য যে পরিবর্তন প্রয়োজন, তা বৈষয়িক সংস্কৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ে আসা যেতে পারে। আমাদের আর্থসামাজিক জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি এসব বৈষয়িক সংস্কৃতির উপকরণ। সুতরাং রাজনীতিকে শুদ্ধ করে তুলতে হলে আমাদের সেই বৈষয়িক সংস্কৃতি গতিপ্রকৃতি নিয়ে ভাবতে হবে, তার শুদ্ধির দিকে ফিরতে হবে। লুকাচের কথাই ফিরে ফিরে আসছে। যখন আমরা বৈষয়িক ও আত্মিক দুটোর সমন্বিত রূপকে সংস্কৃতি হিসেবে সামনে আনতে পারব তখনই জনগণের সংস্কৃতিকে ফিরে পাব। আর সেই সংস্কৃতি যখন লালন করব তখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রকৃতির নিয়মেই দূরীভূত হয়ে যাবে।
কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূলে ফিরে যাওয়ার পথে নতুনতর বাধা উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হতে পারে। আর বিচিত্র সাংস্কৃতিক সন্নিবেশের ভেতর দাঁড়িয়ে কাকে গ্রহণ বা বর্জন করব, কোন সাংস্কৃতিক উপাদান প্রকৃতিসম্মত বা তা নয়, তা কী করে নির্ধারণ করব- এর দিকনির্দেশ কিন্তু আমাদের পূর্বজ মানুষেরা রেখে গেছেন। কারণ নানান প্রভাবকের মুখে পড়ে আমরা আজ যে সাংস্কৃতিক সংকটে পড়েছি, তা আমাদের জন্য নতুন হলেও, মানুষের ইতিহাসে নতুন নয়। গ্রহণ-বর্জনের ঘোরাল হিসাবনিকাশে তাঁরা কাকে কষ্টিপাথর করেছেন? আত্মিক সংস্কৃতিতে সর্বজাতিতে ঐক্য রয়েছে বিধায় সেখানে গ্রহণ-বর্জন বৈচিত্র্যের কিছু শর্ত মেনে মান্য করা চলে। কিন্তু বৈষয়িক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু স্পর্শকাতর। এই স্থলে আমার মনে হয় সাম্রাজ্যবাদ বিচার একটা মাপকাঠি। যে বৈষয়িক ধারার সংস্কৃতি সাম্রাজ্যাবাদী, তাকে বর্জন করতে হবে।
বিশ্বে যত রকম অপঘটনা ঘটে, চোখ রাখলে দেখা যায়, সেখানে কোনো না কোনোভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব রয়েছে। এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে না নিলে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমরা তৈরি করতে পারব না এবং সব উদ্যোগ ও স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। প্রত্যাশা থাকবে- অচিরেই আমরা এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারব, যেমনটা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে পেরেছিলাম।
লেখক
প্রাবন্ধিক
শিক্ষাবিদ
মন্তব্য করুন