- বিশেষ আয়োজন
- ভালো-মন্দের সমীকরণ
ভালো-মন্দের সমীকরণ

আমরা মুক্তচিন্তা বলতে কী বোঝাই, সেটা খুব একটা পরিস্কার না। বিভিন্ন মানুষের কাছে এর বিভিন্ন মানে। আজকের বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা বলতে যেটা মনে করা হয়; তার ওপর সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে বাংলাদেশের বেশ কিছু নিয়মকানুন। এই কানুনগুলো প্রয়োগ করা হয় যাঁরা 'মুক্তচিন্তা' করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে। মোটামুটি রাজনৈতিক ও দলীয় একটা অবস্থান থেকে সরকার যাঁদেরকে মনে করে বিপজ্জনক, তাঁদের প্রতি এমনটা করতে পারে। এটাই মুক্তচিন্তার পথে প্রধান বাধা। প্রধান কারণ, বাধাটা সবচেয়ে ওপরের পর্যায়- সরকার থেকে আসে। সরকার মানে 'প্রাতিষ্ঠানিক' যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের মুক্তচিন্তার ধারা। এবং তাদের বিপক্ষে যারা আছে তারাও প্রাতিষ্ঠানিক। তারা উঠতি প্রাতিষ্ঠানিক। পূর্বের যা প্রাতিষ্ঠানিক, তাকে প্রতিস্থাপন করতে চায়। একজন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়; আরেকজন ক্ষমতা দখল করতে চায়। দুইয়ের যে দ্বন্দ্ব; সেই থেকে মুক্তচিন্তা সম্বন্ধে সাধারণ সনাতনী ভাবনার জন্ম হয়েছে।
অন্য যে বিষয়টা আছে, সেটা হচ্ছে সামাজিকভাবে মুক্তচিন্তা। সামাজিক মুক্তচিন্তার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে। মুক্তচিন্তার ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে চর্চা, চিন্তাভাবনা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক যে মুক্তচিন্তার পরিসর আছে, তার বাইরে গিয়ে মুক্তচিন্তার কথা ভাবতে পারি না। আমাদের কাছে যা মুক্তচিন্তা তা পুরোটাই রাজনৈতিক মুক্তচিন্তা।
গবেষণাতে আমরা অনেকবার দেখেছি, শহর আর গ্রামের মধ্যেও মুক্তচিন্তার মধ্যে পার্থক্য আছে। ঐতিহাসিকভাবে মানুষ মুক্তচিন্তা বা যে কোনো চিন্তা করে কেবল তার সুবিধার জন্য। মুক্তচিন্তার ঐতিহাসিক সূত্রগুলো কী? টিকে থাকার জন্য মানুষ যা করতে চেয়েছে সেটাই মুক্তচিন্তা। প্রথম মুক্তচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিষ্ঠানটা কী? ধর্ম। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের ভেতর ধর্ম হচ্ছে প্রধান। কারণ ধর্ম কাঠামোগতভাবে বলছে- এটা কোরো, এটা কোরো না। এটা বোলো, এটা বোলো না। একেবারে আদি যুগ থেকে; তা যে কোনো ধর্মই হোক। ধর্মকে আমরা দেখেছি যে ওপর থেকে আসে; আল্লাহ পাঠান বা ভগবান নির্ধারণ করেন। এর বাইরে পৌরাণিক যে বিষয়গুলো আছে, তার বাইরে সমাজই তৈরি করে নেয়- তার কোনটা চিন্তা করলে সুবিধা হবে, কোনটায় অসুবিধা। মধ্যপ্রাচ্যে সেসব সমাজে একেশ্বরবাদ জনপ্রিয় ছিল, যেসব সমাজে 'এক' বিষয়টাকে জনপ্রিয় করার দরকার ছিল। সেই সমাজগুলোয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল। রাজত্ব প্রতিষ্ঠা কখন শুরু হয়েছিল? যখন যথেষ্ট উদ্বৃত্ত জমেছিল। যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকার ফলে ছোট ছোট কেন্দ্র তৈরি হচ্ছিল। গ্রামের উদ্বৃত্ত দিয়েই কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, যেখানে একটু নগর-নগর ভাব। সেই কেন্দ্রগুলোয় ধারণাগুলো প্রথম আসতে থাকে।
সর্বক্ষেত্রে যে এমন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এই যেমন ভারতে যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে কিন্তু একেশ্বরবাদ তৈরি হয়নি। তার মানে, ভারতের যে বাস্তবতা, সে বাস্তবতায়ও মুক্তচিন্তাটা করতে হয়েছে সমাজের যেটা কাজে লাগে, সুবিধা হয়, সেটা নিয়ে।
আজকের দুনিয়ায় কোনটা দাঁড়িয়েছে? পৃথিবীর সব দেশে রাজনৈতিক মুক্তচিন্তা সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বেশি সীমাবদ্ধতা ছিল কোন সময়? যেসব সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল, সেখানে ভাবা হতো, মুক্তচিন্তা করলে যে রাষ্ট্রটা তৈরি হয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ছিল না। পশ্চিমা দেশগুলো আবার বিষয়টিকে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো কেন ব্যবহার করেছে? ওরা বলছে, ওখানে স্বাধীনতা নেই। মানুুষের জীবন উন্নত না; মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে না। তো দেখা যাচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক দেশ- যেগুলোকে বলা হচ্ছে জনগণের জন্য; সেসব দেশে কিন্তু বাকস্বাধীনতা নেই; মুক্তচিন্তা করার পরিসর নেই। আমি এই দেশগুলোতেও কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে আসলেই যেটা লক্ষণীয়- আমি হার্ভার্ডের জার্নালেও কথাটা লিখেছি। আমি দেখিনি যে মানুষ বলছে, আমার মুক্তচিন্তা করার দরকার। এটা কিন্তু খুব মৌলিক। এই ভাবনাটা মনে রাখা দরকার। অনেক মানুষই মনে করেছে, 'আমার তো দরকার নেই। আমাকে খেতে দিচ্ছে, পরতে দিচ্ছে; সব করতে দিচ্ছে। আমি কেন মুক্তচিন্তা করব?' তাহলে তার কাছে সুবিধার জায়গা থেকে মুক্তচিন্তার প্রয়োজনটা নেই।
মুক্তচিন্তার প্রয়োজন থাকতে হবে। মুক্তচিন্তার প্রয়োজন যদি না থাকে সে তা করবে না। 'সোশিও বায়োলজিক্যাল' জায়গা থেকে আমি বলব, আমি মনে করি তা-ই। মানুষের 'অবজেক্টিভ' আর 'সাবজেক্টিভ' যে সম্পর্ক আছে, ওই সম্পর্কটা আমরা দেখি না। আমরা ভাবি যে মুক্তচিন্তা যে কোনো মানুষ যে কোনো সময় করতে পারে। তাহলে একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সে তো একটা অসুবিধার কারণ হয়ে উঠতে পারে। পুলিশ মানুষকে ধরে। অর্থাৎ, মুক্তচিন্তা কোনো ঐশী ব্যাপার না। এটা সামাজিক, সমাজগত ব্যবস্থা। বিভিন্ন সমাজ বিভিন্নভাবে এটাকে ব্যবহার করে।
রাজনীতিও একে ব্যবহার করছে। আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় আছে তারা যেসব আইন করেছে; অনেক আগে থেকে আইনগুলো চলছে এবং অনেকেই ভুক্তভোগী। একাধিক সময়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কারণ সরকার বা সরকারের ঘনিষ্ঠ মানুষ মনে করেছে- এ যা বলেছে, তাতে আমার অসুবিধা হতে পারে। আমাকে ধরে নিতে হবে যে ওর ক্ষমতার জন্য আমি একটু অস্বস্তিকর হয়ে গেছি। এর ফল যা হবে তা বড় হতে পারে, ছোটও হতে পারে।
আমাদের সমাজে কী হচ্ছে? সমাজ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে চায় কিনা। সমাজ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে চায় না। কেন চায় না? চায় না দুটো কারণে। এক- স্বাধীনভাবে চিন্তা করে সে কী লাভটা পাবে। সে তো কোনো গোষ্ঠী পাবে না; একা হয়ে যাবে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সাহসটা আজকের দুনিয়ায় এসে অসুবিধাজনক। সে একাকিত্বে ভুগবে। আর একাকিত্বে ভুগলে তার যে উদ্বৃত্ত সংগ্রহ, তা অসুবিধায় পড়বে। তার গোষ্ঠী থাকবে না। সে তাই দলের সঙ্গে থাকল।
ফেসবুকের জগৎ এর একটা উদাহরণ। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুক খুব ভালো। ফেসবুক নিয়ে গবেষণা করা যায়। ফেসবুকটা দুই ভাগে বিভক্ত। পক্ষ, বিপক্ষ।
আমার মনে আছে, আমি তখন বিবিসির করেসপন্ডেন্ট ছিলাম। আমি এক রাজনৈতিক নেত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সঙ্গে ওই দলের মূল তফাতটা কী। তিনি ৫ মিনিট চিন্তা করে বলেছিলেন, ওরা খারাপ, আমরা ভালো।
এই যে সমীকরণ- ওরা খারাপ, আমরা ভালো; এটা কিন্তু সবলভাবে প্রতিষ্ঠিত। এর ঐতিহাসিক ধারণা কোথা থেকে এসেছে? মানুষ যদি পেছনে চলে যায় তাহলে দেখতে পাবে এর সূত্র রয়েছে ধর্মে। পাপী ও পুণ্যবান। অতএব আমরা যে খুব একটা এগিয়েছি ১০ হাজার বা ৫ হাজার বছরে, তা না। বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছি, কিন্তু আমাদের স্বাধীন মুক্তচিন্তা বলতে যা বোঝায়, তা তৈরি হয় নাই।
লোকে সক্রেটিসকে এত কিছু বলে। যারা সক্রেটিস নিয়ে গবেষণা করেছে বা সক্রেটিস নিয়ে আধুনিক বই পড়েছে তারা দেখবে, সক্রেটিস ভীষণ রকম মুক্তচিন্তাবিরোধী ছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁকে গণ্য করি। কারণ আমরা যে সমাজ থেকে এসেছি, অর্থাৎ কৃষিসমাজ, সেখানে আমাদের তা বোঝার দরকার নাই। আমার কৃষি করতে হবে, কোনো ব্যাঘাত যেন না হয়; প্রকৃতির অসুবিধা না হয়। সবকিছু আমরা করব, যাতে আমরা খেতে পাই। মানুষের জীবনে রুজিটা হচ্ছে প্রধান। এবং রুজি হওয়ার পর রুজি থেকে যখন উদ্বৃত্ত হবে, তখন দ্বিতীয় জিনিস সে 'ভাবতে' যাবে। তার আগে সে ভাবতে পারবে না। যে দেশে যখনই অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন হয়তো বিচিত্র ভাবনা আসবে। আমাদের দেশে বিচিত্র ভাবনা না করেই অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়া সম্ভব। সে কারণে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা করি না। যদি করি তাহলে আমরা কী করি, তা দেখার জন্য ফেসবুকটা এবারও ভালো উদাহরণ। ফেসবুকে আমরা গালি দিই এবং সে গালি মানব ইতিহাসে আমরা কখনও দিইনি। যে মানুষটা বলছে, এই সরকার খারাপ সরকার; সেই মানুষটাও, যে বলে এই সরকার খুব ভালো সরকার, তার সমান গালিটাই দেয়। অতএব, বিষয়টা হচ্ছে নিজের অবস্থানটা রক্ষা করা। সামাজিক সূত্রগুলো কী? নিজেদের অবস্থানকে রক্ষা করা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটা ইতিহাসের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
শেষ কথা বলে দিই। সেটা হচ্ছে, 'ফ্রি উইল অ্যান্ড ডিটারমিনিজম'। ফ্রি উইলে অনেকে বিশ্বাস করে। আমি ফ্রি উইলে বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি না যে, মানুষ স্বাধীন। আমি মনে করি, 'সাবজেক্টিভ' কন্ডিশনের কারণে 'অবজেক্টিভ' অনুধাবন হয় আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তাই বলে।
কৃষক কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করল? সে বাংলা ভাষার জন্য অংশগ্রহণ করেনি; বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য করেনি। তার জীবনের ওপর যখন সরাসরি আঘাত এসেছে, প্রতিবাদ করে তখন সে যুদ্ধে গেছে। তাকে আক্রমণ করলে সে যুদ্ধে যাবে। আমি আফসান চৌধুরী যুদ্ধে গেছি অন্য কারণে; হতে পারে। আমি যুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধের কোনো লাভ হয়নি। আমার মতো দশটা গেলেও কোনো লাভ হতো না। যেহেতু শত শত মানুষ গেছে, হাজারো মানুষ গেছে এবং তারা প্রতিটা গ্রামে একেকটা মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠা করেছে- পাকিস্তান আর্মি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির কি কোনো উপায় ছিল ২৫ মার্চের রাতে আক্রমণ করা ছাড়া পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার? না। পাকিস্তান আর্মি স্বাধীন ছিল না। ওই যে মুক্তচিন্তা করার পরিসরটা; সে যে মুক্তভাবে চিন্তা করবে- আমি গণহত্যা করব, নাকি করব না; তার কোনো উপায় ছিল না। তাকে গণহত্যাটা করতেই হতো। যে পাকিস্তান তারা '৪৬ সাল থেকে বানিয়েছে; সেই পাকিস্তান টিকিয়ে গণহত্যা অবধারিত ছিল।
আমি অবধারিত্বের মানুষ। ইতিহাসে অবধারিত্বই প্রধান। আমাদের সেই কথাটা স্মরণ রাখা দরকার। তবে আমরা এটা প্রশ্ন করতে পারি- কতদিন হলে একটা অবধারিত্বের পরিবেশ তৈরি হয়?
আমি দেখেছি, '৪৭-এর আগে, ৩০-৪০ বছরের ইতিহাসে পরিবর্তন করা সিদ্ধান্তগুলো অসম্ভব ছিল। একটা উদাহরণ দিই- লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন পশ্চিম পাকিস্তান হওয়ার কথা ছিল। ১৯৪৬ সালে দিল্লি প্রস্তাব দিয়ে একক একটা রাষ্ট্র তৈরি হয়। যখনই তা হলো, পরের ২৫ বছরের ইতিহাস নির্ধারিত হয়ে গেল।
কী হলো? স্বাধীন করার উদ্যোগ হলো।
কী হলো? আওয়ামী মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি হলো।
কী হলো? ছয় দফা হলো।
কী হলো? স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো।
অতএব অবধারিত্ব আমাদেরকে নির্ধারণ করে এবং সেই অবধারিত্বের কথা স্মরণ করে আমাদের মনে রাখা দরকার- মুক্তচিন্তা সীমাবদ্ধ।
লেখক
সাংবাদিক
গবেষক
মন্তব্য করুন