নাটোরের সিংড়া উপজেলার উদ্যমী ৫১ তরুণ। পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ব্রত নিয়ে তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যাচ্ছেন চলনবিলের দুর্গম কোনো না কোনো গ্রামে। পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রতিটি ঘর যেন বাগানে পরিণত হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১২ ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়া ঘরে ঘরে ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণ করে চলেছেন স্থানীয় উদ্যমী কয়েকজন তরুণ ও যুবক-যুবতী। বৃক্ষরোপণসহ এলাকায় মাদক, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন তাঁরা। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে এসব বৃক্ষরোপণসহ সামাজিক কাজে অংশ নেন তাঁরা। এসব সামাজিক কাজে অনুপ্রেরণা জোগাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধি ও সরকারি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারাও কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তাঁরা স্থানীয়ভাবে গড়ে তুলেছেন 'পল্লীশ্রী উন্নয়ন সংস্থা' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ সংগঠনের সব সদস্যই কোনো না কোনো গ্রামে গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়া ঘরে ঘরে তিনটি করে ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষের চারা রোপণ করছেন।

'পল্লীশ্রী উন্নয়ন সংস্থা'র সভাপতি রণজিত কুমার জানান, পরিবেশ রক্ষায় ২০১১ সালে তিনি ১১ জন তরুণ নিয়ে রাস্তায় ও পাড়া-মহল্লায় স্বেচ্ছায় বৃক্ষরোপণ শুরু করেন। ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫১ জন। তারা এলাকায় এলাকায় মাদক, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সদস্যদের প্রায় প্রতিটি সদস্য নিজস্ব কাজের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণসহ নানা কর্মসূচিতে স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন। তিনি আরও জানান, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁরা উপজেলার এক হাজার ২৯০টি ভূমিহীনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার দেওয়া ঘরের আঙিনায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণ করছেন। এ পর্যন্ত উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার চারা রোপণ করেছেন। আরও ৬০ হাজার বৃক্ষরোপণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রতিটি ঘর যেন বাগানে পরিণত হয় সে লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু করেছেন।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত কুমার জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের প্রতিটি ঘরে তাঁরা বৃক্ষরোপণ করছেন। সংগঠনের সদস্যরা উৎসবের আমেজে এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকেন। উপহারের ঘরে বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন রাস্তার ধারে বৃক্ষের চারা রোপণ করছেন। এ ছাড়া বজ্রপাত রোধে তালগাছের বীজ রোপণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উপজেলার ১২ ইউনিয়নের সড়কের পাশে লক্ষাধিক তালবীজ রোপণের প্রস্তুতিও নিয়েছেন তাঁরা।

ষাটোর্ধ্ব আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'আগে চলনবিলে পানি থাকত। এখন প্রায় সারাবছরই শুকনা থাকে। গাছগাছালি কমে গেছে। ডোবা-নালা ভরাট হয়ে গেছে। আগের মতো সেই পরিবেশ নেই। যেভাবে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলোকে বাগান মনে হচ্ছে।'

বড়িয়া গ্রামের ভূমিহীন আকলিমা বেগম জানান, আগে অন্যের বাড়িতে থেকেছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে একটি পাকা ঘর দিয়েছেন। এবার আবার বাড়ির আঙিনায় গাছ লাগানো হচ্ছে। ওই ঘরেই এখন স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি সুখে রয়েছেন।

চৌগ্রামের ভূমিহীন হাসান আলী ও শাহিদা বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘর পাওয়ায় এখন তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। গাছ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের ঘরের পাশে। গাছগুলো নিজেরাই পরিচর্যা করছেন। তাঁরা আম্রপালি, নিম ও ডালিম গাছ পেয়েছেন। এখন বাড়িটা দেখতে গাছের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে।

'পল্লীশ্রী উন্নয়ন সংস্থা'র রোজিনা খাতুন, ঝরনা রানী ও রাখি রানী জানান, তাঁরা চলনবিলের পরিবেশ রক্ষায় পল্লীশ্রীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বৃক্ষরোপণ করছেন। একই সঙ্গে তাঁরা গ্রামের প্রত্যেককে গাছ লাগানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন।


আরিফুল, অপু কুমার ও আতিক হাসান বলেন, 'উপহার পাওয়া প্রতিটি ঘরে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তিনটি করে ফলদ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের চারা রোপণ করে যাচ্ছি। এ কাজে সবাই উৎসাহ জোগাচ্ছেন। আমাদের এই বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম দেখে অনেকেই তাঁদের বাড়ির আঙিনায় বৃক্ষরোপণ শুরু করেছেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই বৃক্ষরোপণ করার কাজে বেশ আনন্দ পাই। তাই আমরা মনের টানে ছুটে যাই। চলনবিলের প্রকৃত পরিবেশ পুনরায় ফিরে আসবে- এমন প্রত্যাশা নিয়ে এই বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে আমরা অংশ নিয়ে চলেছি।'

উপজেলার পাথুরিয়া কালাইকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশীদ বলেন, 'উপহার পাওয়া ঘরে ঘরে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম উপজেলাব্যাপী সাড়া ফেলেছে। পল্লীশ্রীর বৃক্ষরোপণ দেখে মনে হচ্ছে চলনবিলের হারিয়ে যাওয়া নির্মল পরিবেশ আবার ফিরে আসবে। চলনবিলের পরিবেশ রক্ষায় এখন অনেকেই সোচ্চার হচ্ছেন।'

সিংড়া উপজেলা ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, 'পল্লীশ্রী সংস্থার বৃক্ষরোপণের কারণে সিংড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়া ঘরগুলো দেখে বাগানের মতো মনে হচ্ছে। এলাকার পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয়ভাবে তরুণ ও যুবকদের উদ্যোগে বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ পাখি শিকার ও নিধন বন্ধে কাজ করছেন। এ ছাড়া চলনবিলের জলজ প্রাণী রক্ষায় অবৈধ কারেন্ট ও সোতি জালের বিরুদ্ধে মৎস্য বিভাগকে সহায়তা করে যাচ্ছেন তাঁরা। এসব সংগঠনের একটি পল্লীশ্রী উন্নয়ন সংস্থা। এই সংগঠনের উদ্যমী যুবক-যুবতী ও তরুণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ শুরু করায় অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। উপহারের ঘর পাওয়া ভূমিহীনরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। তাঁরা এখন ঘর এলাকায় নানা জাতের সবজি লাগিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটাচ্ছেন।

পরিবেশবাদী সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'চলনবিলের পরিবেশ রক্ষায় পল্লীশ্রী কয়েক বছর আগে থেকে বৃক্ষরোপণ শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রতিটি ঘর বাগানে পরিণত করার এমন উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এলাকায় সাড়া ফেলেছে। তাঁদের দেখে অনেকেই উদ্যোগী হচ্ছেন।'

চৌগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম ভোলা ও ইটালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান আরিফ জানান, উদ্যমী তরুণদের দলটি চলনবিলের দুর্গম গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘরের আঙিনায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণ করে উপজেলায় সাড়া ফেলেছেন। তাঁদের এই বৃক্ষরোপণের কার্যক্রম দেখে অনেকেই এখন নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন রাস্তায় একটি হলেও গাছ লাগাচ্ছেন। তারা পরিষদের সভাসহ উঠান বৈঠকে সবাইকে গাছ লাগানোর কথা বলে উৎসাহ দেন। সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমএম সামিরুল ইসলাম বলেন, 'উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার এক হাজার ২৯০টি ঘর রয়েছে। প্রতিটি ঘরের আঙিনায় স্বেচ্ছায় বৃক্ষরোপণ একটি মহৎ উদ্যোগ। কারণ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর উপহারের প্রতিটি ঘর যেন বাগানে পরিণত হয়।' এই বৃক্ষ থেকে একটি আয়ের উৎস সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন তিনি।
লেখক
নাটোর
প্রতিনিধি