
মতিউর রহমান ফয়সাল। সংগঠক হিসেবে ময়মনসিংহ নগরে যাঁর পরিচিতি। এ পর্যন্ত তাঁর নানা উদ্যোগের মধ্যে সাড়া জাগানো উদ্যোগ হচ্ছে 'ক্লিন আপ ময়মনসিংহ'। তাঁর এই উদ্যোগ ময়মনসিংহ নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং বিভাগের অন্য জেলা ও উপজেলাজুড়ে বিদ্যমান। নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা ও সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁর এ লড়াই। মাত্র চারজনের যাত্রা এখন ছড়িয়েছে চারপাশে। ময়মনসিংহ বিভাগের ২১ উপজেলায় অন্তত দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে কাজ করছেন তারুণ্যদীপ্ত ফয়সাল। কিশোর-তরুণদের সুনাগরিক ও ইতিবাচক পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ফয়সালের সংগঠনটি সচেতনতামূলক নানা কাজও করছে। শুধু যে পরিচ্ছন্ন দেশ বিনির্মাণে কাজ করছেন ফয়সাল এমনটি নয়। তাঁর সামাজিক উদ্যোগের মধ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বয়স্কশিক্ষা প্রসার, বৃক্ষরোপণ, তরুণদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা, তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সাধারণ মানুষকে আইনি সেবা ও আইনকানুন সহজবোধ্য করা।
মতিউর রহমান ফয়সাল ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রাজগঞ্জ গ্রামের শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা স্থানীয় লেতু মণ্ডল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। পরিবারের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের রাজগঞ্জ বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরে লেতু মণ্ডল উচ্চ বিদ্যালয় ও মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ২০০৬ সালে। ময়মনসিংহ শহরের আলমগীর মনসুর মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমান। আইন পেশায় ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি (অনার্স) ও নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে বার অ্যাট ল' কোর্স করছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশিপ সনদ প্রাপ্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতি ও পরে ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়ে জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত।
পরিচ্ছন্নতার যুদ্ধ
ক্লিন আপ ওয়ার্ল্ডের ধারণা থেকে মাথায় আসে কীভাবে নিজের শহর ময়মনসিংহকে পরিচ্ছন্ন করা যায়। তখন যত্রতত্র ময়লা ফেলা, চারপাশে দুর্গন্ধে জীবন কাটাতেন পথচারী মানুষ। ফয়সালের ভাবনায় সঙ্গী হন তাঁর তিন বন্ধু মাহমুদুল হাসান তুষার (ফার্মাসিস্ট), ইফতেখার হোসেন (ব্যবসায়ী), আবদুল্লাহ আল ফয়সাল (প্রকৌশলী)। পরিকল্পনা করে 'ক্লিন আপ ময়মনসিংহ' নামে তারুণ্যনির্ভর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে ময়মনসিংহ নগরীকে একটি পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে গড়ে তুলতে নাগরিক সচেতনতায় ২০১৪ সাল থেকে কাজ শুরু করেন ফয়সাল। অন্তত দুই বছর তাঁরা অনলাইনভিত্তিক প্রচার কাজ করে মানুষকে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝাতে শুরু করেন। মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেন ২০১৬ সালে। পরিচ্ছন্ন মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ একটি পরিচ্ছন্ন সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে- এই চেতনায় চলে কাজ। নাগরিক সচেতনতায় ক্লিন আপ ময়মনসিংহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র সমাবেশ, শপথ করানো, পরিচ্ছন্নবিষয়ক বিতর্ক, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করে। শুরুতে মানুষ বাঁকা চোখে দেখলেও ফয়সালের যাত্রায় ধীরে ধীরে জুড়তে থাকেন বহু স্বেচ্ছাসেবী পালক। স্বেচ্ছাসেবী সবাই তরুণ। সংগঠনটি বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগের ২১ উপজেলায় অন্তত ২ হাজার তরুণ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে কাজ করছে। মানুষের মন্দ অভ্যাস পরিবর্তন করতে ও প্রশাসনকে পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে সংগঠনটি সহযোগিতা করছে। ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পরিচ্ছন্ন টিম গঠনের মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের সুনাগরিক ও ইতিবাচক পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সংগঠনটি আন্দোলন করছে, সচেতনতামূলক নানা কাজ করছে। ময়মনসিংহ মহানগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে একযোগে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, শহরের হকারদের ডাস্টবিন ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজ করছে তারা।
পথশিশুদের জন্য
ফয়সাল ২০০৮ সাল থেকে পথশিশু বা পথকলিদের শিক্ষা প্রদান ও পিছিয়ে পড়া শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। দীপ্ত শিখা ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ঢাকা, জয়পুরহাট ও ময়মনসিংহে পথশিশুদের স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নানা ধরনের উদ্যোগ নেন। নিজে ঢাকার উত্তরায় পথের শিশু, টোকাইদের নিয়মিত পাঠদান করা ও সরকারি স্কুলমুখী করতে কাজ করেছেন। বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ফর রিয়েল ফ্রিডম সংগঠনের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পথশিশুদের স্বাক্ষরতাদান, ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় পথশিশুদের ঈদে নতুন জামা, শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা কাজ করেছেন। ময়মনসিংহ নগরীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্মনিবন্ধন সহজ করা ও তাদের মানোন্নয়নে কাজ করছেন।
শুরুটা যেভাবে
ফয়সালের সামাজিক কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শুরুটা মাত্র সাত বছর বয়স থেকে। জীবনকে অন্যরকমভাবে তৈরি করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী কাজের বিকল্প নেই শিক্ষক বাবার কাছ থেকে এমন প্রেরণায় কাব স্কাউটিং শুরু করেন। নগরীর মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্কাউটিংয়ের জন্য বাংলাদেশ স্কাউটসের সর্বোচ্চ প্রেসিডেন্টস স্কাউট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন ২০০৫ সালে; যা সামাজিক ও মানুষের জন্য কাজ করতে আগ্রহ বাড়ায় ফয়সালের। ২০১২ সালে ইউনিট লিডার হিসেবে বাবার নামে স্কাউটার রফিকুল ইসলাম ওপেন স্কাউট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।
উদ্দেশ্য কিশোর-তরুণদের আদর্শবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবেন। কিশোর ও তরুণদের নানা সামাজিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করছেন মানবিক হতে। ২০১৮ সালে উডব্যাজ অর্জনের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন ফয়সাল। ২০২১ সালে কাজের স্বীকৃতস্বরূপ মেডেল অব মেরিট ও বার টু দ্য মেডেল অব মেরিট পুরস্কার অর্জন করেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার আগ্রহ থাকায় স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ফয়সালের। বাংলাদেশ স্কাউটস, ঢাকা ইয়েস থিয়েটার, টিআইবি ইয়েস গ্রুপ, গ্লোবাল কোয়ালিশন অব এনভায়রন চেঞ্জার, গ্লোবাল গুডইউল অ্যাম্বাসাডর, কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, ক্লিন আপ ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ যুব নাগরিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
করোনাকালে ছিলেন মানুষের পাশে
শৈশব থেকেই স্বেচ্ছাসেবী কাজের মাধ্যমে মানুষের জন্য কাজ করা ফয়সাল করোনা দুর্যোগেও ছিলেন মানুষের পাশে। দেশের যে কোনো দুর্যোগ ও মহামারিতে সামনে থেকে কাজ করেন তিনি। করোনা মহামারিতে ক্লিন আপ ময়মনসিংহের ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবক ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে ও করোনা রোগীদের হাসপাতালে নিতেও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেন।
ময়মনসিংহ যুব নাগরিক সোসাইটি তরুণ-যুবদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রতিকূল পরিবেশে মানুষকে সহযোগিতা করা ও বিভিন্ন সামাজিক অসংগতি প্রতিরোধে কাজ করছেন নিয়মিত। পরিবেশের জন্য বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ময়লা-আবর্জনা অপসারণ, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সচেতনতামূলক কাজ পরিচালনা করছেন নিয়মিত। জামালপুর, ময়মনসিংহের ধোবাউড়াসহ বিভিন্ন স্থানের বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ, উদ্ধার কাজে সংগঠনের তরুণ সদস্যরা কাজ করেন। ময়মনসিংহ নগরীর হকার্স মার্কেটের আগুন নেভানো ও পরবর্তীকালে সম্পদ সংগ্রহ উদ্ধার কাজে ফয়সালের স্বেচ্ছাসেবীরা ছিলেন নিবেদিত।
ফয়সালের চোখে আগামী
মতিউর রহমান ফয়সাল বলেন, 'বর্তমানে দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ তরুণ। সবাই বলছেন তরুণদের প্রতি আস্থা রাখতে, তাঁদের এগিয়ে নিতে। কিন্তু বাস্তবে তার ফল দেখা যায় না। বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন তরুণদের মেধা, শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করছে। কিন্তু তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে তা কাজে লাগছে না। তরুণদের আদর্শবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।
সত্য সুন্দর সাম্য প্রতিষ্ঠা তরুণদের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই এ তরুণ জনশক্তিকে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে ভালো মানসিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।' তিনি আরও বলেন, 'তরুণদের স্বপ্ন অপার, কেউ কারও স্বপ্নও কুক্ষিগত করে রাখার অধিকারী নয়, তাই আমার লক্ষ্য এ তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন, পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষে পরিণত করে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে চাই। অপরিচ্ছন্ন নোংরা মানসিকতার কারণে অসভ্যতা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও পরিবার তৈরি হচ্ছে। এখনই সময় আমাদের অভ্যাস বদল করা। তাই পরিচ্ছন্ন মানসিকতা গড়তে আন্দোলন করছি।'
লেখক
ময়মনসিংহ
প্রতিনিধি
বিষয় : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২ ১৮ বছরে সমকাল
মন্তব্য করুন