
রাতে কোনো মানুষ অভুক্ত ঘুমাবে না। যে-ই আসুক না কেন, রাতে পেটপুরে খেতে পেয়েছেন। বলছি আজিজুল আলম বেন্টুর মেহমানখানার কথা। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে রাজশাহী মহানগরীর সাগরপাড়ায় আজিজুল আলম বেন্টু 'লবঙ্গ' নামের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এই রেস্টুরেন্টে যাঁরা খেতে আসেন তাঁরা অর্ডার করার পরই শুরু হয় খাবার তৈরি। সুতরাং খাবার বাড়তি থাকার সুযোগ নেই। তাই আজিজুল আলম বেন্টু প্রথম দিন থেকেই এলাকার হতদরিদ্র, দুস্থ, অসহায় গরিব মানুষ, রিকশাচালক, ছিন্নমূল পথশিশু, নাইটগার্ডদের জন্য চালু করেন আলাদা মেহমানখানা। লবঙ্গ রেস্টুরেন্টের সামনেই প্রতিরাতে দেড় থেকে দুইশ মানুষের আহারের ব্যবস্থা করছেন। আজিজুল আলম বেন্টু জানান, রাত ৯টার পর রেস্টুরেন্টে ব্যবসার চাপ কমতে থাকে। তখন শুরু হয় গরিব মানুষের মেহমানদারির রান্না। সাদা ভাতের সঙ্গে কোনো দিন মাছ, কোনো দিন মাংস বা ডিম দেওয়া হয়। সবজি থাকে প্রতিদিনই। রাত ১০টা বাজার পরপরই শুরু হয় রেস্টুরেন্টের সামনে হতদরিদ্র মানুষের ভিড়। কেউ রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে থামেন, কেউ আগেই এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত ১১টা বাজতেই শুরু হয় খাবার পরিবেশন।
আজিজুল আলম বেন্টু পেশায় ব্যবসায়ী হলেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নাম লেখান গত বছর। সবাই যখন ব্যবসা খুলে লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন তিনি এই ব্যতিক্রমী আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন। অবশ্য এই আয়োজনের বর্ণনা যতটা সহজে দেওয়া হলো, প্রতিদিনের আয়োজনটা এত সহজ নয়। কারণ প্রতিদিনই এই মেহমানদারির জন্য বাজার করতে হয়। প্রতিদিনই আলাদা করে রান্নাও করতে হয়। ঝড়-বৃষ্টি-শীত যা-ই হোক না কেন এ আয়োজন বন্ধ হয় না। এমনকি ঈদে রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলেও বন্ধ থাকে না এই গরিবের মেহমানখানা। তখন বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের সঙ্গে বেন্টু নিজেই খাবার দেওয়ার বিষয়টি তদারকি করেন। তিনি জানান, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবার অপচয়ের সুযোগ নেই। কারণ, ক্রেতারা অর্ডার করলেই কেবল খাবার তৈরি হয়। তবে হতদরিদ্র মানুষের জন্য রেস্টুরেন্টে আলাদা করে রান্না করান তিনি। প্রথম দিন থেকেই ভাত, মাছ, মাংস, ডিম দিয়ে মেহমানদারি করছেন তিনি। সেই খাবারই খান হোটেলের কর্মচারীরাও।
সরেজমিন রাত ১০টায় নগরীর সাগরপাড়ায় আজিজুল আলম বেন্টুর 'লবঙ্গ' চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দেখা যায়, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ সেখানে আসতে শুরু করেছেন। চালকরা পাশেই রিকশা রেখে বসে পড়ছেন শামিয়ানা বিছানো ফুটপাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলো কয়েকজন পথশিশু। তাদের একজন ক্রাচে ভর করে এসে বসলো বেন্টুর মেহমানখানায়। নাম রাজিয়া (১৪)। একটি পা নেই। রাজিয়া জানায়, তার বাড়ি দিনাজপুরে। মা, বাবা দু'জনই মারা গেছেন। সেখানে তার নানি ভিক্ষা করাতেন তাকে দিয়ে। টাকা কম হলে চলত নির্যাতন। রাগ করে রাজিয়া ট্রেনে চেপে চলে এসেছে রাজশাহী স্টেশনে। সেখানেই সারাদিন বেলুন বিক্রি করে রাতে ঘুমায়। আয় না হলে অনেক রাত না খেয়েই স্টেশনে ঘুমিয়ে পড়ে রাজিয়া।
রাজিয়া আরও জানায়, প্রায় রাতই তার খাওয়া হতো না। গত কয়েক মাস ধরে বেন্টুর মেহমানখানায় রাতের খাবার খায় রাজিয়া। রাজিয়া জানায়, 'পেট ভরে খাওয়া যায়। খুবই ভালো খাবার খাওয়ানো হয়। মাছ, মাংস, ডিম, সবজি খাওয়া যায় ভাতের সঙ্গে।'
রিকশাচালক শাহজালাল বলেন, 'একদিন রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় দেখি- খাওয়ানো হচ্ছে। এরপর থেকে আমিও চলে আসি। রাতে পেট ভরে ভালোমানের খাবার পাওয়া যায়। এটা খুবই ভালো লাগে। দোকান কর্মচারী লুৎফর রহমান বলেন, 'করোনার পর থেকে আয় নেই। সংসার চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই প্রতিদিন রাতে এখানে খেয়ে বাড়িতে যাই। অন্তত একবেলার খাবার খরচ লাগছে না। সামর্থ্যবান সবাই যদি এভাবে এগিয়ে আসত তাহলে আমাদের মতো গরিব মানুষের কষ্ট কমে যেত।' রমজান আলী নামের আরেকজন বলেন, 'অনেকেরই টাকা আছে। কিন্তু মন নেই। তারা আমাদের একবেলা খাওয়াতে পারে না। বেন্টু ভাই আমাদের প্রতিরাতেই খেতে দেন। কোনো দিন মুরগির মাংস ভাত, কোনো দিন সবজি ডাল ভাত, কোনো দিন মাংস খিচুরি থাকে। বিনামূল্যে খাওয়ালেও মান খুবই ভালো। এই খাবার খেয়ে আমরা খুবই খুশি।' নাইটগার্ড সাত্তার বলেন, 'প্রতিরাতেই এখানে খেয়ে ডিউটি শুরু করি। জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে নিজের আয়ে সংসার চলে না। একবেলা ভালো খাবার বিনামূল্যে পাওয়া আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।'
লবঙ্গ রেস্টুরেন্টের রাঁধুনি আরাফাত হোসেন বলেন, 'একই খাবার প্রতিদিন দেওয়া হয় না। প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন খাবার দেওয়া হয়। একই খাবার প্রতিদিন দিলে মানুষের খেতে অসুবিধা হবে। রুচি নষ্ট হতে পারে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন খাবার রান্না করি।'
মেহমানখানার উদ্যোক্তা আজিজুল আলম বেন্টু বলেন, 'জীবনে অনেক ব্যবসা করেছি। এখন আর লাভকে সামনে রেখে চিন্তা করি না। রেস্টুরেন্ট করেছিলাম সখের বশে। রেস্টুরেন্টে বাবুর্চি আছে, কর্মী আছে তারাই রান্না করে। শুধু আলাদা করে বাজার করাতে হয়। এতে আমার ভর্তুকি দিতে হয় প্রতিদিনই। তবে লক্ষ্য যেহেতু ছিল মানুষের জন্য কিছু করার, তাই ভর্তুকি কোনো বিষয় নয়। মানুষকে আমি আগে থেকেই খাওয়াতে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা থেকেই মনে হলো করোনায় অনেক মানুষের আয় কমেছে। অনেকেই খাবারে কষ্টে আছেন। তাই এ উদ্যোগ হতদরিদ্র মানুষকে সামনে রেখেই। জীবনে যতদিন আমার সাধ্য থাকবে, এ রেস্টুরেন্ট যতদিন টিকে থাকবে ততদিন এ মেহমানদারি চলবে।' তিনি আরও বলেন, 'সব সামর্থ্যবান যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে এভাবে এগিয়ে আসেন, তবে অনেক মানুষেরই কষ্ট কমবে।'
লেখক
ব্যুরোপ্রধান
রাজশাহী
বিষয় : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২ ১৮ বছরে সমকাল
মন্তব্য করুন