কোনো কঠিন কাজকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যখন কেউ উঠে-পড়ে লাগে, গ্রামের লোকজন তাঁকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে। সেই কাজটিতে যখন সফলতা আসে তখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। এ ধরনের একটি কাজে সফলতা পেয়েছেন নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পাঁচুপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা জগদাস গ্রামের উদ্যমী যুবক কবির হোসেন প্রামাণিক। তিনি পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তা চাষে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন এলাকাজুড়ে। ইতোমধ্যে সারাদেশের দুই শতাধিক বেকার যুবককে দিয়েছেন প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব যুবকের মধ্যে অর্ধশতাধিক বেকার পুকুরে মুক্তা চাষ করছেন।

উদ্যমী কবিরের এই কর্মকাণ্ডকে এলাকাবাসী প্রথমে পাগলামি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সাগরের মুক্তা পুকুরে চাষ করে সফলতা আসায় গ্রামের নামও পাল্টে গেছে। এখন জগদাস গ্রাম 'মুক্তার গ্রাম' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

জগদাস গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম ও গৃহবধূ আনোয়ারা বেগমের ছেলে কবির হোসেন ২০১৯ সালে উপজেলার আত্রাই আহসানউল্লাহ ডিগ্রি কলেজে বিএসসি তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়ার করার সময় আর্থিক অনটনের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ বছরের ওই যুবক চাকরির সন্ধানে ঢাকায় চলে যান। মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে একটি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সেই কাজ হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এ সময় ইউটিউবে মুক্তা চাষের একটা সাফল্যময় গল্প দেখে তিনিও উৎসাহিত হন।

স্থানীয় মৎস্য বিভাগের মাধ্যমে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে মুক্তা চাষের ওপর তিন দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন কবির হোসেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে ফিরেই মাত্র ৪০ শতকের একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষের পাশাপাশি ঝিনুকে মুক্তা চাষের প্রকল্প হাতে নেন। তাঁর এ পুকুরে গিয়ে দেখা যায় পুকুরের পানিতে তিন ফুট পর পর ভাসছে ফাঁকা প্লাস্টিকের বোতল। সেখানে পানির এক ফুট নিচে রয়েছে একটি করে প্লাস্টিকের ডালা। সে সব ডালার প্রতিটিতে রয়েছে ২০টি করে ঝিনুক। এভাবে তিনি ওই পুকুরে প্রায় ২০ হাজার ঝিনুক বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাষ করছেন। ওই ঝিনুকের মধ্যে প্রতিটিতে কমপক্ষে দুটি করে বিভিন্ন ডিজাইনের নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দশ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এসব ঝিনুক থেকেই উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের মুক্তা।

কবির হোসেন জানান, 'প্রথমেই আমি ৮ হাজার ঝিনুকের মধ্যে বিভিন্ন ডিজাইনের প্রায় ১৫ হাজার নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে। এ সময় কিছু ভুলের কারণে প্রথম তিন মাসের মধ্যে বেশ কিছু ঝিনুক মারা যায়। পরে আর আমাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম বছরেই পুকুরে মুক্তা চাষ করে সব ধরনের খরচ বাদে আমার আয় হয় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। বর্তমানে আমি তিনটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষ করছি।

এসব পুকুরে বর্তমানে ৪০ হাজার ঝিনুকে মুক্তা চাষ হচ্ছে।' পুকুর লিজ, ঝিনুক সংগ্রহ, পরিচর্যা, নিউক্লিয়াস ক্রয় ও সংস্থাপন ইত্যাদি বাবদ মোট খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এই এক বছরে ওই ঝিনুক থেকে উৎপাদিত মুক্তা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন। ইতোমধ্যে তিনি পাঁচশ ঝিনুক সংগ্রহ করে বিক্রি করেছেন প্রায় ১ লাখ টাকায়। তিনি বলেন, 'মুক্তা দুই ধরনের রয়েছে- একটি প্রাকৃতিক মুক্তা ও একটি ডিজাইন মুক্তা। এই ডিজাইন মুক্তাই বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরে চাষ হচ্ছে। এসব মুক্তার বাজার রয়েছে ভারতের কলকাতায় এবং বাংলাদেশে আড়ং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে।'


তাঁর এই মুক্তা চাষ প্রকল্পের গ্রামের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানও হয়েছে। বর্তমানে তাঁর প্রজেক্টে ৮ থেকে ৯ জন বেকার যুবক কর্মরত। তাঁরা প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরি পাচ্ছেন। ওই প্রকল্পে কর্মরত আইনুল, সাজু, সাজেদুর, সুমন ও হাফিজুল জানান, 'গ্রামে বেকার অবস্থায় ঘুরে বেড়াতাম। বাড়িতে খেয়ে নিজ গ্রামেই এখন উপার্জন করতে পারছি, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে।'

শুধু তাই নয়, তাঁর সফলতা দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা অন্তত দুইশ বেকার যুবককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কবির হোসেন। প্রতিদিনই তাঁর কাছে লোকজন আসছেন কীভাবে পুকুরে মুক্তা চাষ হয় জানতে। ইতোমধ্যে গ্রামটি মুক্তা চাষের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। জগদাস গ্রামের দুই উদ্যোক্তা আবু বাশার ও মানিক জানান, কবিরের সাফল্য তাঁদেরও মুক্তা চাষের দিকে আকৃষ্ট করেছে। ইতোমধ্যে ওই দুই যুবকসহ গ্রামের অন্তত ২০ জন বেকার যুবক ঝিনুকে মুক্তা চাষের ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তাঁরাও আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে এই মুক্তাচাষ প্রকল্প শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কবির হোসেন এসব প্রকল্পে নিজে উপস্থিত থেকে নতুন উদ্যোক্তাদের মুক্তা চাষের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য রহিমা বিবি বলেন, 'কবিরের কাজ দেখে গ্রামের লোকজন তাঁকে পাগল বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, এখন তারাই তাঁর প্রশংসা করছে। বর্তমানে কবিরের জন্যই গ্রামের নাম হয়েছে মুক্তার গ্রাম। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন। এলাকার অর্থনীতির চাকাও সচল হয়ে উঠেছে। পাল্টে গেছে এলাকার সার্বিক চিত্র।'

এ ব্যাপারে উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, 'ইতোমধ্যে উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তাচাষ শুরু হয়েছে। এলাকায় ব্যাপক সাড়াও পড়েছে। তবে মুক্তা চাষের পুকুরে কোনো ছায়া থাকা যাবে না, পর্যাপ্ত রোদ পড়তে হবে। ঝিনুকের খাদ্যের জন্য পুকুরে পানি সবুজ থাকতে হবে। অর্থাৎ সবুজ শ্যাওলা তৈরি করতে হবে।'

নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আমিনুল এহসান বলেন, 'পুকুরে মুক্তা চাষে ঝুঁকি কম ও লাভজনক। মানসম্মত মুক্তা চাষ করতে পারলে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। তাই মানসম্মত মুক্তা চাষে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সার্বিক প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ আমরা প্রদান করছি। আগামীতে এর আরও প্রসার ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।'
লেখক
নওগাঁ প্রতিনিধি