
ক্রিকেটে তবে কি বাংলাদেশ বনসাই হয়ে উঠল?
ওয়ানডে র্যাঙ্কিং সাত। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে ৯ নম্বরে স্থবির। এই জায়গাটায় ঘোরাফেরা চলছে অনেক দিন থেকে। উন্নতি যেহেতু নেই, অবনতির চোখ রাঙানি সব সময়। সে কারণে প্রশ্ন উঠছে, ক্রিকেটের আগামী কেমন; রঙিন, ধূসর নাকি অন্ধকার?
অথচ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে, এই খেলায় পিছিয়ে পড়ার কোনো কারণই নেই। ২০০০ সালের পর থেকে সময় যত গড়িয়েছে, বাংলাদেশের খেলাধুলা আর ক্রিকেট যেন সমার্থক শব্দ। ব্যাট-বলের দাপটে কোণঠাসা হয়েছে অন্য খেলাগুলো। কোনো সমাজের জন্য বিষয়টা মোটেও আদর্শ নয়। ক্রিকেট খেলুড়ে অন্য দেশগুলোতে বিষয়টা এমন নয়। এই যে আইপিএল বিশ্বের কাছে আরাধ্য ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর, সেই ভারতেও ফুটবলের আইএসএল, প্রো-কাবাডি, ব্যাডমিন্টনের ফ্র্যাঞ্চাইলি লিগ, দাবা কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তিগত ইভেন্ট নিয়ে মাতামাতি আছে। ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্য খেলার পেছনেও ছোটে মিডিয়া আর স্পন্সররা। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটটাই আমরা বেশি ফলো করি। কিন্তু অলিম্পিকের অন্যতম বড় শক্তি যে এই দেশ, অনেকেরই হয়তো অজানা। অসিদের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকায় রাগবি এগিয়ে ক্রিকেটের চেয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেটারের চেয়ে অ্যাথলেটের জন্ম হয় বেশি। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জন্ম দিলেও ফুটবল সেখানে যোজন যোজন এগিয়ে।
'বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান' বিজ্ঞাপনের খুব জনপ্রিয় এই লাইন জানিয়ে দেয় ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি ঠিক কতটা। বিজ্ঞাপন কিংবা বিদেশি লিগে সাকিবের চাহিদা ঠিকই আছে, কিন্তু তাঁকে ঘিরে টাইগার ক্রিকেটের বদলের সম্ভাবনা এখন মলিন। পঞ্চপাণ্ডবের হাতধরে ২০০৬ সালে যে সাফল্যযাত্রার শুরু, তা ২০২০-এর পর থেকে পড়তির দিকে। টেস্টে এখন সাকিব, তামিম, মুশফিক- তিনপাণ্ডব, ওয়ানডেতে এই তিনজনের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ। আর টি-টোয়েন্টিতে সাকিব একা। আনুষ্ঠানিক অবসর না নিয়েও মাশরাফি এখন পুরোপুরি অতীতকাল। এই তারকাদের সবাই মিলে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে প্রত্যাশিত জায়গায় নিয়ে যেতে ব্যর্থ। একইভাবে ক্রিকেট উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে বিসিবিও পারেনি পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা আনতে। দায় দু'পক্ষেরই। যদিও একে অন্যকে দায় দেওয়ার যে সংস্কৃতি সমাজে বিদ্যমান, এ ক্ষেত্রেও সেটা শোনা যায় মিডিয়ায় কান পাতলে।
২০১৯ বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ড একটা তিন জাতি প্রস্তুতি টুর্নামেন্ট ছাড়া আর কোনো ট্রফি নেই ছেলেদের ক্রিকেটে। ছোটরা ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে যতটুকু মান রাখার রেখেছে। সেই দলের ক্রিকেটারদের নিয়েও পরের পরিকল্পনা এগিয়েছে এলোমেলোভাবে। পারভেজ ইমন, শামীম পাটোয়ারীদের কেন নেওয়া হয়েছিল, আর কেনই বা ছুড়ে ফেলা হলো বোঝা মুশকিল। দলে নির্বাচনের প্রক্রিয়া টেস্ট স্ট্যাটাসের ২২ বছর পরও স্পষ্ট নয়। এখনও কোনো ক্রিকেটারকে দলে ফিরতে নিজের কিছু করতে হয় না। দলে থাকা অন্যরা খারাপ খেলে বলেই বাইরে থাকা ক্রিকেটার ঢুকে পড়ে জাতীয় দলে। নইলে কোথাও কিছু না করে সাব্বির-সৌম্যরা কীভাবে দলে ফেরে? তাও কিনা আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে! টাইগার ক্রিকেটের দৈন্য এখানেই।
ক্রিকেট আজ টি-টোয়েন্টির চাপে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। এই ফরম্যাটটা কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছে না বাংলাদেশ। ঠিক যেভাবে ২২ বছর পেরোনোর পরও টেস্ট ক্রিকেটে টাইগাররা বড্ড সাদামাটা। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ আটকে আছে সাত নম্বরে। টেস্টে ৯ নম্বর অবস্থায় প্রায় পাকা হয়ে গেছে। আর টি-টোয়েন্টিতে আপাতত ৯ নম্বরে থাকলেও আফগান হুমকিতে যে কোনো সময় ১০-এ নেমে যেতে হতে পারে। বৈশ্বিক টি-টোয়েন্টি আসরে এখন কম করে হলেও ৫-৬ জন আফগান ক্রিকেটারের চাহিদা আছে, সেখানে সাকিব ছাড়া আপাতত আর কোনো বাংলাদেশি ওই পথে হাঁটার সুযোগ পাচ্ছেন না। বিপিএলকে টপকে গেছে অন্য সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আসর। ঘরোয়া ক্রিকেটের দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই।
ক্রিকেটে আমাদের অবকাঠামো শক্তিশালী হয়নি। আজও মিরপুর একাডেমি মাঠই অনুশীলনের সবেধন নীলমনি। একটা জিমেই কাজ চালায় জাতীয় দল, এ দল, নারী দল, হাই পারফরম্যান্স দল ও বয়সভিত্তিক দল। দায়সারা ইনডোর আজও আধুনিক ইনডোর হয়ে উঠতে পারেনি। ঢাকার বাইরের ভেন্যুগুলোর অবস্থা ভালো নয়। ফতুল্লা ময়লার ভাগাড়, খুলনা-বগুড়া ঘরোয়া আয়োজন দিয়ে টিকে আছে। চট্টগ্রাম আর সিলেটে ম্যাচ হয় বটে, তবে এখনও ৭০ ভাগ ম্যাচ ঢাকাতেই রাখা হয়। রাজধানীর ওপর নির্ভর করে একটা খেলার কতটুকুই বা উন্নতি সম্ভব?
সত্যি বলতে বিসিবির করার আছে অনেক কিছুই। কারণ তারাই তো ক্রিকেটের অভিভাবক। সাফল্যের কৃতিত্ব যেমন তাদের, ব্যর্থতার দায়ও নিতে হবে তাদেরই। তবে এদেশে দায় নেওয়ার সংস্কৃতির যে বড্ড অভাব। কোনো কারণে ক্রিকেট যদি তার আবেদন হারিয়ে ফেলে, তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখুন তো। ৯০ দশকের ফুটবল কখনও বুঝতে দেয়নি, আগামীর দিনগুলো কত হতাশার হবে। চোখে সামনে ফুটবলের আবেদন হারানোর উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে। অন্য খেলাধুলা এমনিতেই যখন পিছিয়ে পড়েছে, তখন ক্রিকেটই তরুণ প্রজন্মের মূল ভরসার জায়গা।
পরের প্রজন্ম ঠিকঠাক দায়িত্ব না নিলে ক্রিকেটের সামনে অনিশ্চিত পথ। হয়তো পুরোপুরি অন্ধকার নয়, কিন্তু ধূসরই বটে!
লেখক
সাংবাদিক
বিষয় : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২ ১৮ বছরে সমকাল
মন্তব্য করুন