
চঞ্চল চৌধুরী
প্রত্যাশার শেষ নেই; নেই এর সীমা-পরিসীমা। যে মানচিত্রের ভেতর বসবাস, সেই চেনা ভুবনে থেকেও তাকে নানা অবয়বে, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আবিস্কার করছি। আর তা থেকেই প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন দিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ তো চলতেই থাকে। এই ঘর ছেড়ে বেরোলাম- পথে পা দিয়েই শুরু হলো আগামী দিনের রূপরেখা তৈরির কল্পনা। কেন পথ চলতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি? শুরুতেই উঠে আসছে এই প্রশ্ন। এই যে ঢাকা শহরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পেরিয়ে যাচ্ছে- সেখানে কতটা সময় অহেতুক ক্ষয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব-নিকাশও মেলানো কঠিন। রাস্তাঘাটের অব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে না মানা- এগুলোই আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে অনেকটা সময়। যে সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য অনেক কিছু করা যেত। শুধু যানজট নয়, চলতি পথে আমরা কতটা নিরাপদ- সেটাও ভাবনার বিষয়। তাই আইনি ব্যবস্থার সঠিক প্রযোগ হচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নই বারবার উঠে আসে। তাই আগামী সময়ের জন্য রাষ্ট্রের কাছে আমার প্রথম চাওয়া, আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ যেন যথাযথভাবে হয়।
আমার ওঠা-বসা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে। শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলব- এটাই অনেকে ধরে নেন। এখন কথা হলো, শিল্প-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে হলে এর সাধক, অনুসারীদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যে জন্য মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে সবার আগে। বেঁচে থাকার নূ্যনতম প্রয়োজন মেটাতে যখন রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে, তখন বাকি সব বিষয় হয়ে পড়বে গৌণ। তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যের অসম বণ্টন, শিক্ষা, চিকিৎসা- সব দিকেই নজর দিতে হবে। একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের যে অধিকার, তা পূরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই ক্ষমতার চর্চা ছেড়ে মৌলিক অধিকার পূরণের দিকে নজর দিতে হবে। আমি নিরাশাবাদী মানুষ নই। তাই বিশ্বাস করি, সময়ের পালা বদলের সঙ্গে রাষ্ট্রও তার জনগণের কল্যাণে নানা উদ্যোগ হাতে নেবে। আর সেই বিশ্বাস থেকেই রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশার এই কথাগুলো তুলে ধরা।
দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে মুক্তি পেলেই একটি দেশ মৌলিক চাহিদা পূরণে তখনই সয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা সেটা পেরে উঠিনি। উল্টো দেখতে পাচ্ছি, দিন দিন আমাদের স্বার্থপরতা বেড়েই চলেছে। নিজের স্বার্থ নিয়েই বেশি ভাবছি। সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দেখছি, নিজ প্রচার আর লাভ-লোকসান নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। 'সবার জন্য শিক্ষা'- এই স্লোগান অর্থহীন হয়ে উঠছে। শিক্ষা এখন বাণিজ্যের অন্যতম উপকরণ হয়ে উঠেছে। টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে দিচ্ছে কার জন্য শিক্ষার মাধ্যম কোনটি। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ছে। খাদ্য সংকট এবং এর সুষম বণ্টন নিয়ে তো আলাদা করে কিছু বলার নেই- এটাও সবারই জানা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই চাহিদাগুলো পূরণে যখন হিমশিম খাচ্ছি- তখন অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আগেই কেন বিচার-বিশ্নেষণ করতে বসব? তাই 'আগামী' মানেই আমার কাছে দেশ ও জাতির খোলনলচে বদলে নতুনরূপে ধরা দেওয়া।
এবার সেই অঙ্গনকে নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, যেখানে আমার নিত্যদিনের পদচারণা। হ্যাঁ, সংস্কৃতি অঙ্গনকে নিয়ে কিছু বলতেই হয়। ক'দিন আগে একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, প্যাকেজ যুগ শুরুর পরেই কি অভিনয় পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে? সিনেমা নয়, প্রশ্নটা মূলত নাট্যশিল্পীদের জন্য। তাঁর এই প্রশ্নে জবাব দেওয়ার আগে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম, আমরা যাকে শিল্পমাধ্যম বলছি, তা কি আদৌ ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে? আমার এমন প্রশ্ন শুনে তিনিও কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলেন। যে জন্য সঠিক উত্তর তিনি নিজেও দিতে পারেননি। হ্যাঁ, অভিনয় করে কিছু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কিন্তু এটা তো সহজ বাংলায় 'দিন আনি দিন খাই'-এর মতো অবস্থা। কাজ নেই তো পকেটশূন্য। যাপিত জীবনের কোনো ছক তৈরি করা সম্ভব নয় অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে। তাই বাস্তবে শিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতা, নাট্যকার- কারও বেলায় 'পেশাদার' শব্দটা যুক্ত করা কঠিন। তাই অভিনয় জগতে পেশাদার শব্দটা শুধু মুখের বুলি হিসেবেই থেকে গেছে। অনেকে 'পেশাদার' শব্দটাকে ক্ষমতাচর্চার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছেন। যে যাই বলুক, যাই করুক- একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি যে শিল্প-সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একটি দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাই ধরুন- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইথার থেকে ভেসে আসা গান ও অন্যান্য আয়োজন একটি স্বাধীন দেশ গড়ার স্বপ্ন রচনা করেছিল। যাঁরা সম্মুখ সমরে ছিলেন- তাঁদের কাছে মুক্তির গান হয়ে উঠেছিল স্বাধীন দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে আসার অন্যতম হাতিয়ার। সংস্কৃতির শক্তি কতখানি- এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে।
গান-নাটক-সিনেমা শুধু বিনোদন দেয় না, যাপিত জীবন নিয়ে ভাবতে শেখায়। সংস্কৃতির শিকড় হাতড়েই আমরা চিনে নিতে পারি নিজ জাতিসত্তাকে। তাই সংস্কৃতি অঙ্গনে পা রাখার আগে খ্যাতির মোহকে ফেলে আসা উচিত। তাহলেই আমরা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেদের আলাদা করে চেনাতে পারব। তবে সবকিছুর মূলে থাকতে হবে সঠিক শিক্ষা, বিবেকবোধ এবং শিল্পমন ও সৃষ্টির নেশা। না হলে কিছু বিতর্ক থেকেই যাবে। এই যেমন অনলাইন দুনিয়া আমাদের জন্য নাটক-সিনেমা-সংগীতসহ সংস্কৃতির প্রসারের নতুন সব পথ খুলে দিয়েছে, তেমনি আমাদের সৃষ্টি বিতর্কের মুখেও ফেলছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, টিভি চ্যানেলে নাটকের প্রিভিউ করা হয়, চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে সিনেমার সেন্সর করে ছাড়পত্র দেওয়া হয়, কিন্তু ওটিটি কেন এ থেকে মুক্ত? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও সহজ নয়। সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে নীতিমালা থাকা যেমন দোষের নয়, তেমনি না থাকাও ভয়াবহ বলে মনে করি না। যে নীতিমালা কাজের জন্য প্রতিকূল- তা সংশোধন করা উচিত বলেই মনে করি। আর অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার এক ধরনের পরীক্ষার শামিল বলেই আমি মনে করি। আর সেই পরীক্ষাটা হলো, নিজের বিবেক বোধ, ধ্যান-ধারণা, জ্ঞান আর সৃষ্টির পারদর্শিতার। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে- তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে কোনো সেন্সর লাগবে না।
ওটিটি সেই পরীক্ষার মধ্য দিয়েই শিল্পী আর স্রষ্টাদের চিনিয়ে দিচ্ছে। কারণ সবকিছুর পর এটাই সত্যি যে, মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে। তাই পরিচয় তুলে ধরতে কে কী ধরনের কাজ করবে- সে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। নিজের কথাই বলি, আমি যখন কোনো নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করি, তখন দেখে নেওয়ার চেস্টা করি, সেটা দর্শক মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে। সেই কাজ কখনোই করতে চাই না, যা আমার মন সমর্থন করে না। আমি মনে করি, সবারই উচিত কাজের বিষয়ে সচেতন ও সৎ হওয়া। আগামী সময়টা আমাদের সেসব সৃষ্টি আর শিল্পীর মুখোমুখি করুক, যাঁদের কাজ নিয়ে কখনও সেন্সরশিপের প্রশ্ন উঠবে না।
সবশেষে আগামীর প্রত্যাশা নিয়ে এ কথাটাই বলতে চাই, সবার মাঝে জেগে উঠুক দেশপ্রেম। এখন আমরা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশপ্রেম নিয়ে অনেকের মুখে অনেক কথাই শুনি। কিন্তু তাদের কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মুখোশধারী- একটা ভয়ংকর শব্দ। কিন্তু এই শব্দটাই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং সেই বাস্তবতা মেনে নেওয়াও কষ্টের। সেই কষ্ট দূর করতেই প্রজন্ম থেকে প্রজস্মের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার চেতনা। যাতে করে 'মুক্তিযুদ্ধ', 'স্বাধীনতা', 'দেশপ্রেম'- এ শুধু ভাষণ, স্নোগান, নাটক, সিনেমা, গান, গল্প, কবিতাসহ অন্যান্য বিষয়ের ব্যবহূত শব্দ হিসেবে পরিচিত নয়। এই ত্রয়ী শব্দের গহিনে যে জাগরণী শক্তি মিশে আছে, তা সবাই উপলব্ধি করতে পারে। দেশপ্রেমের চেতনায় জেগে ওঠা মানুষ দিন দিন সংখ্যাগুরু হয়ে উঠছে- আগামীর জন্য এমন দৃশ্যই কল্পনা করছি। আমার বিশ্বাস, এই কল্পনা বাস্তব হতেও বেশি দেরি নেই।
লেখক
অভিনয়শিল্পী
বিষয় : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২২ ১৮ বছরে সমকাল
মন্তব্য করুন