
কৃষ্ণা রানী সরকার
প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এটি শুধু একটা টুর্নামেন্ট জেতা নয়; বরং দেশের নারী ফুটবলে এক নতুন জাগরণ। এটি খেলাধুলায় নারীদের অগ্রসর হওয়ার কথাও জানান দেয়। যে প্রতিবন্ধকতা আমরা এবং আমাদের আগের খেলোয়াড়রা দেখেছেন, সামনে যাঁরা আসবেন তাঁদের হয়তো এসব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে না। আশা করা যায়, এখন হয়তো মা-বাবা মেয়েদের ফুটবল খেলতে উৎসাহ দেবেন। এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য খেলায়ও মেয়েদের এগিয়ে আসা সম্ভব হবে।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথুলিয়া গ্রামে আমার জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। সংসারে অভাব ছিল। ফুটবলার হয়ে বেড়ে ওঠার পথটি সহজ ছিল না। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ- সবই ছিল বৈরী। ছোটবেলায় ফুটবলের প্রতি আগ্রহী থাকলেও এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। গ্রামে দুরন্ত শৈশব পার করছিলাম। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট যখন শুরু হয়, তখন আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতাম। তাই খেলার স্যার আমাদের কয়েকজনকে বললেন, ফুটবল খেলা হচ্ছে। তোমরা কি খেলতে আগ্রহী? আমি ভাবলাম, অনেক খেলাই তো খেলি, ফুটবল খেলতে দোষ কী! মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলা নিয়ে পাড়ার লোকজন বাজে মন্তব্য করতেন। মা-বাবাকে কথা শোনাতে ছাড়তেন না। মা মাঝেমধ্যেই বকাঝকা করতেন। তবে আমার আগ্রহ দেখে চাচা একদিন ৩ নম্বর ডিআর বল কিনে দেন। মানুষের কটু কথা সহ্য করতে না পেরে মা একদিন বঁটি দিয়ে ফুটবল কেটে ফেলেছিলেন। তবু খেলা ছাড়িনি।
তখন সূতি ভিএম পাইলট স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন স্যার আমার খেলা দেখে পছন্দ করেন। তিনি আমাকে সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করান। একটি নারী ফুটবল দল গঠন করেন। ওই দলে রাখা হয় আমাকে। কিন্তু বাড়ি থেকে সূতি ভিএম স্কুলের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। এত দূরে গিয়ে কীভাবে প্র্যাকটিস করব? তখন কেউ রাজি হননি। বরং মা-বাবা বাধা দিয়েছিলেন। এমন অবস্থায় এগিয়ে আসেন আমার চাচা নিতাই চন্দ্র সরকার। তিনি সাহস জুগিয়েছেন। কোনোদিন সাইকেলে, কোনোদিন ভ্যানে, কোনোদিন হেঁটে প্র্যাকটিস করতে নিয়ে গেছেন। ফুটবলার হয়ে ওঠার পথে এমন আরও অনেক মানুষের অবদান অপরিসীম। ইউনিয়ন পর্যায় হয়ে উপজেলা, জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পাই। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ সাফ চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। সেই টুর্নামেন্টও হয়েছিল নেপালে। ওই দলে ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি।
আমাদের টিমের সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মানুষ আমাদের সব অর্জনের অংশীদার। তবে আরেকজনের নাম না বললেই নয়। তিনি হলেন গোলাম রব্বানী ছোটন (ছোটন স্যার)। আমাদের কোচ। যখন থেকে বয়সভিত্তিক দলে খেলি, তখন থেকেই তিনি কোচ। অনূর্ধ্ব-১৪ দল যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়, তখনও তাঁর প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণাই ছিল মূল। সিনিয়র টিমে আসার পরও তিনি একইভাবে আমাদের অভিভাবক হয়ে পাশে থেকেছেন।
আমাদের টিমে এখন যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গত কয়েক বছর ধরে একসঙ্গে আছি। হাসি-কান্না, দুঃখ-কষ্ট সব এ কয়েকজনকে ঘিরেই। পরিবারের মতোই এখানে টক-মিষ্টি-ঝাল সম্পর্ক রয়েছে একেকজনের সঙ্গে। কে কীভাবে খেলেন, তার সবলতা-দুর্বলতা জানি। এ নিয়ে আলোচনাও করি আমরা। এই টিমের সদস্যদের আরও একটা জায়গায় মিল রয়েছে। সবাই গ্রাম থেকে এসেছি। কেউ ধনী পরিবার থেকে আসিনি। এ জন্য সবার মাঝেই নিজেকে মেলে ধরার, নিজের শতভাগটা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার মানসিকতা কাজ করে। একেকটা মেয়ে শুধু মাঠে নয়, মনে-প্রাণে ফুটবলার হয়ে উঠেছেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা টিম হয়ে উঠেছি। এ টিম বন্ডিংটাই আমাদের এই নতুন জাগরণের মূল।
আমাদের দলের প্রত্যেকেই মেধা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় দিয়ে একেকটা ধাপ পেরিয়ে নিজেদের যোগ্য করে তুলেছেন। আমরা অনেক কিছু ত্যাগ করেছি, অনেক অপূর্ণতা আছে জীবনে। তবে খেলার প্রতি ভালোবাসা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে তা পূরণ হয়ে যায়।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আমাদের সমাজে নারী ফুটবলে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আসে সমাজ থেকে। একটা মেয়ে মাঠে খেলবেন- এখনও অনেকেই এ বিষয়টা মেনে নিতে পারেন না। এটা যে শুধু গ্রামে আছে এমন নয়, শহরেও এ মানসিকতাটা আছে ভালোমতোই। তবে একেকটা অর্জন বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। যদিও এসব অর্জনের পেছনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত এর ফলটাই আগামীদিনের প্রেরণা হয়ে থাকে। অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলের প্রায় প্রত্যেকের পরিবারই সমর্থন জুগিয়েছেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের কটু কথাও বন্ধ হয়ে যায়। এবার মূল জাতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেক পরিবারই মেয়েদের ফুটবল খেলতে উৎসাহ দিচ্ছে। এখন শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারেও এ আগ্রহটা জন্মেছে। এ পুরো ঘটনাক্রম এক ঝটকায় আসেনি। তবে পরিবর্তনটা আগে থেকে দেখা যায় না, ঘটার পরই এর পার্থক্য ও গুরুত্বটা উপলব্ধি করা যায়।
আগে যারা নারী ফুটবলকে গুরুত্ব দিতেন না, কটু কথা বলতেন, এখন তাঁরা আমাদের ফোন দিচ্ছেন, ছোটন স্যারকে ফোন দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অনেক কিছুই বদলাচ্ছে। আজকের নারী ফুটবলকে আগের সঙ্গে মেলানো যাবে না। অসম্ভব উন্নতি করেছেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। খেলোয়াড়দের মধ্যে যেমন পেশাদারিত্ব গড়ে উঠেছে, তেমনি তাদের গতি ও স্কিল ভীষণভাবে বেড়েছে। এখন পুরো ৯০ মিনিট আমাদের নারী ফুটবলাররা মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে পারেন। তবে আরও বড় অর্জনের জন্য এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি। আমরা যদি লক্ষ্যটা সাফ পর্যন্ত না রেখে আরও বড় করি, তাহলে আমাদের নারী ফুটবলের ট্রেনিং ও টেকনিক্যাল সুযোগ-সুবিধা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি অবকাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পেশাদার ক্লাব ফুটবলকে শক্তিশালী করতে হবে। মেয়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হলে, যথাযথ সম্মান পেলে পরিবার ও সমাজে এর প্রভাব পড়বে নিশ্চিতভাবেই। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে তা শুধু নারী ফুটবলের ক্ষেত্রেই নয়, মেয়েদের অন্যান্য খেলায় এগিয়ে আসার পথও সুগম করবে।
দলে আমরা অনেকেই আছি, যাঁরা ফুটবল খেলার নিয়ম-নীতি কিছুই বুঝতাম না, যখন খেলাটা শুরু করি। ছোট একটা বয়স থেকেই আমরা এটুকু বুঝতে পারি, এ খেলাটাই আমাদের জীবনে সুদিনের দেখা দিতে পারে। ফুটবল ঘিরেই আবেগ-অনুভূতি। খেলার প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকেই ফিটনেস ধরে রেখে দীর্ঘদিন খেলে যেতে চাই।
পরিশেষে, সমকালের সব সাংবাদিক ও কলা-কুশলীদের অভিনন্দন জানাই। ১৮ বছরে পদার্পণ করেছে সমকাল। এই দীর্ঘ সময় একটি গণমাধ্যম সমহিমায় মাথা তুলে আছে। খেলাধুলার প্রচার ও উত্তরণে গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সমকাল আগে থেকেই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে খেলাধুলায় নারীদের পথচলাকে এগিয়ে নিতে আরও বেশি কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে দেশের শীর্ষস্থানীয় এ পত্রিকাটি।
লেখক
খেলোয়াড়
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল
মন্তব্য করুন