- বিশেষ আয়োজন
- কিছু তারা ঝরে গেছে আকাশ মনে রাখে
কিছু তারা ঝরে গেছে আকাশ মনে রাখে

এবারের বিশ্বকাপকে মান্না দের 'কফি হাউসের' সঙ্গে তুলনা করা যায়। 'টেবিলটা আছে আজও', পেয়ালাও খালি নেই। তবু রয়ে গেছে একটা হাহাকার। তিন যুগ মাঠে, ডাগ আউটে নয়তো স্টেডিয়ামের ভিআইপি লাউঞ্জে যাঁর সরব উপস্থিতি ছিল, বিশ্বকাপের আকাশে যিনি রংধনু এনেছেন, মঞ্চে এনেছেন উচ্ছ্বাস, সেই দিয়েগো ম্যারাডোনা এবার নেই! ফুটবলের মহাযজ্ঞে নেই 'ফুটবলের ঈশ্বর'! নেই লিওনেল মেসিদের সেরা শুভাকাঙ্ক্ষী। লিওর হাতে বিশ্বকাপটা যিনি সবচেয়ে বেশি করে দেখতে চেয়েছিলেন এবার, সেই ম্যারাডোনা নেই। সবই আছে আগের মতো, বিশ্ব মঞ্চে ফোটার অপেক্ষায় কত নতুন কুঁড়ি, 'শুধু সেই সেদিনের মালি নেই'। 'ভিনগ্রহ' থেকে ফুটবল খেলতে আসা এই কিংবদন্তি ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে চলে গেছেন। দু'বছর হলো। তবু তিনি রয়ে গেছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে। দিয়েগোর মতো কিছু তারা ঝরে গেলে আকাশ যে মনে রাখে!
১০টি বিশ্বকাপ জুড়ে ছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ছিলেন ২১ বছরের এ 'নিষ্পাপ দৈত্য'। কেবল কুঁড়ি থেকে ফুটছেন। বোকা জুনিয়র্স মাতালেও বিশ্বমঞ্চে হাঙ্গেরির বিপক্ষে জোড়া গোল ও বাকি ম্যাচে ঝলক ছাড়া কিছু দেখাতে পারেননি তিনি। সুদে-আসলে যা ১৯৮৬ আসরে পূরণ করে দিয়ে 'ফুটবল ঈশ্বর' বনে গেছেন। মনকাড়া ড্রিবলিংয়ে প্রতিপক্ষকে নাচিয়ে বেড়ানো, 'গোল বাই হ্যান্ড অব গড', 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি' মিলিয়ে পাঁচ গোলের সঙ্গে পাঁচটি সহায়তা, ম্যাচের প্রতিটি মিনিট খেলা, আর কী দেখাতে পারতেন তিনি! পরের বিশ্বকাপেও ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। তবে ম্যারাডোনাসহ ইনজুরিজর্জর দল শিরোপা জিততে পারেনি। ৩৪-এর ম্যারাডোনার ১৯৯৪ বিশ্বকাপ আরেক বেদনার নাম। দুই ম্যাচ খেলে ড্রাগ নেওয়ার দায়ে নিষিদ্ধ হন তিনি। যদিও দিয়েগো দাবি করেছিলেন, এনার্জি ড্রিংকসের কুফলের শিকার হয়েছেন।
পরের ছয় বিশ্বকাপে আকাশি-সাদা জার্সি পরে মাঠে না নামলেও, পায়ের জাদু না দেখালেও ম্যারাডোনা ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। মর্তে বসে তাঁর দেখা শেষ বিশ্বকাপের কথাই ভাবুন। রাশিয়ায় গ্রুপ পর্বে বিদায়ের শঙ্কায় আর্জেন্টিনা। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে থাইয়ের ওপর বল ফেলে অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোল করলেন তাঁর শিষ্য লিওনেল মেসি। হাই প্রেসারের ম্যারাডোনা উল্লাস করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন! হাফ-টাইমে চেকআপ করে চিকিৎসক তাঁকে রুমে যেতে বললেন। ম্যাচ শেষ করে ইনস্টাগ্রামে মারাডোনার উত্তর, 'ওদের (আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়) ফেলে কী করে যাই!' আবার কোচিংয়ের তেমন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১০ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার ডাগ আউটে। তরুণ মেসি, ডি মারিয়া, হিগুয়েইন, ওটামেন্ডি, মাশ্চেরানোয় সেবার যেমন আলো ছিল, আলো ছিল ম্যারাডোনার ওপরও। যেটাকে 'ফুটবল ঈশ্বর ও তার সন্তানদের দল' বলা হচ্ছিল। উড়ন্ত আলবিসেলেস্তেরা কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-০ গোলে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিলে 'আমি কাল থেকে আর চাকরিতে নেই' বলে হাঁটা দেন তিনি।
ম্যারাডোনা যুগের পর আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ ১৯৯৮ সালে। বাইরে থেকে তিনি যেন কোচের ভূমিকায় ছিলেন। ম্যাচের আগে ভেরনকে নিয়ে বলেছিলেন, 'আমার পক্ষ থেকে ওকে বলো, মাঠে যেন স্বাভাবিক ফুটবল খেলে। কারও কথায় কান না দেয়।' আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচে ডেভিড বেকহ্যামকে লাল কার্ড দেখানোয় প্রশ্ন উঠেছিল। ম্যারাডোনা বলেছিলেন, 'ওসব বাজে কথা ১৯৯৮ সালের আগে থেকেই শুনে আসছি।' ২০০২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্বে বাদ পড়লে ঢাল ধরেছিলেন ওই একজন ম্যারাডোনা, 'এবারের বিশ্বকাপে সিরিয়াস দল ছিল একটাই; আর্জেন্টিনা।' ইংল্যান্ডকে পেনাল্টি পাইয়ে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে 'অযোগ্য, মিডিওকার' বলেছিলেন। মেসিদের মাথার ওপর থেকে ওই ছায়াটা সরে গেছে। ওই কিংবদন্তির পদচিহ্ন ছাড়াই মাঠে গড়াচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ। তবু পরলোক থেকে যদি কিছু করা যেত, আর্জেন্টিনা ও মেসির জন্য ম্যারাডোনা নিশ্চয় সবটাই করতেন!
মন্তব্য করুন