- বিশেষ আয়োজন
- অভিবাসীকর্মীর সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে
সমকালের সহযোগিতায় রামরু ও এমএফএ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক
অভিবাসীকর্মীর সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে

অভিবাসীকর্মীদের শ্রম ও ঘামে অর্জিত রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কিন্তু বিদেশে যেতে তাঁদেরই পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশন- সব জায়গায় হয়রানি সইতে হয়। বিদেশে গিয়ে যে কোনো সমস্যায় পড়ে নিজ দেশের দূতাবাসে গেলে তাঁরা সব সময় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান না। এ অবস্থার পরিবর্তনে অভিবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সময় সরকারকে অধিকার বিষয়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি দূতাবাসে কর্মরতদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানি, প্রতারণা আর নির্যাতন থেকে পরিত্রাণে নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। গত ১১ ডিসেম্বর সমকালের সভাকক্ষে 'অভিবাসীকর্মীর সুবিচার প্রাপ্তি :জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব অভিমত তুলে ধরেন বক্তারা। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস্ রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ও মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) আয়োজিত এ গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল সমকাল
বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে মালয়েশিয়ার শ্রমিক নির্যাতন ছিল সবচেয়ে আলোচিত। তখন মালয়েশিয়ার একটি সংগঠন সেখানে বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তাদের গবেষণায় নির্যাতনের সব বিষয় উঠে এলে ওই সংগঠনের প্রধানের নামে মালয়েশিয়ায় মামলা হয়। সে মামলায় আমরা নির্যাতিত শ্রমিক, যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন ও শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করি। সেই সময়ের পরিস্থিতি ও বিচার ব্যবস্থা দেখতে দেশ থেকে আমাদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে মালয়েশিয়া যাই। প্রতিদিন চার-পাঁচ হাজার শ্রমিককে সেবা নিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসতে দেখেছি। কিন্তু দূতাবাস কোনো সহযোগিতা করেনি। সেখানকার দায়িত্বশীলরা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি।
আমাদের সবাইকে নিজের অধিকার ও দায়িত্ব বুঝতে হবে। আর যার যে দায়িত্ব, তা পালন করতে হবে। দেশের দূতাবাসে যাঁরা দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা যদি শ্রমিকদের সহযোগিতা করেন, তাহলে শ্রমিক নির্যাতন অনেকটা কমে আসবে।
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, এমপি
কোনো অভিবাসী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হলে তার সুবিচার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তবে আমাদের দেশের শ্রমিকরা অবিচারের শিকার হলেও আমরা সব সময় তার প্রতিকার নিশ্চিত করতে পারছি না। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় না থাকার কারণে অভিবাসীকর্মীরা নির্যাতন ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মামলা করলেও সুবিচার পাচ্ছেন না। অভিবাসীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে এ-সংক্রান্ত কাজ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হাতে নিতে হবে। অন্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এক ছাদের নিচে আমরা যদি সব সেবা না দিতে পারি, তাহলে মন্ত্রণালয় ভালোভাবে কাজ করতে পারবে না। প্রবাসীকল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। এ জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। অভিবাসীকর্মীর সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আলাদা জুডিশিয়াল ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ যিনি যেখানেই থাকবেন; সংবিধানের আলোকে ন্যায়বিচার পাবেন। বিদেশি কোনো নাগরিক বাংলাদেশে থাকলে তিনিও সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার পাবেন।
তৌহিদ হোসেন
ভারত বা নেপাল থেকে কোনো শ্রমিক মালয়েশিয়া গেলে মাইগ্রেশনসহ খরচ হয় ৭২ হাজার টাকা। বিপরীতে আমাদের দেশ থেকে যেতে লাগে আড়াই লাখ টাকা। এ বৈষম্য দূর করা দরকার। অভিবাসী শ্রমিকদের বড় অংশের টাকা বাইরে চলে যায়। আমাদের দেশের শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হলে বিচার পান না। এ খাতে দুর্নীতির কারণে অভিবাসীকর্মীরা সুবিচার পাচ্ছেন না। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমদের দেশের শ্রমিকরা ধরেই নেন, বৈধভাবে বিদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। যে কারণে তাঁরা রিক্রুটিং এজেন্সিতে মাইগ্রেশনসহ খরচ আড়াই লাখ টাকা জমা দিয়েও বলেন, ৭২ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ টাকা শুধু রিক্রুটিং এজেন্সি খায়, তা নয়; দেশের বাইরেও অনেক টাকা চলে যায়। আমাদের দেশে এ খাতে যে দুর্নীতি হয়; পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন করার সুযোগ নেই। অনেক মানুষ বিদেশ যেতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। নারী শ্রমিকরা বেশি নির্যাতনের শিকার হন সৌদি আরবে। এই নির্যাতনের কারণে নেপাল ও ফিলিপাইন নারী শ্রমিক পাঠাতে অস্বীকার করেছে। তবুও আমাদের দেশ থেকে সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। আমাদের প্রকৃত সমস্যাগুলো খুঁজে সমাধান করতে হবে।
ড. সি আর আবরার
অভিবাসী শ্রমিকদের অর্জন অনেক। তাঁদের জন্য আইন-নীতিমালা সবই আছে। কিন্তু এখনও আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পরিনি মর্যাদা ও অধিকার। অধিকাংশ অভিবাসী শ্রমিক তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। এ জন্য তাঁরা বিদেশে গিয়ে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হন। আবার আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারাও সবসময় যে নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন, তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের নির্লিপ্ততার কারণে মানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়েন। অভিবাসীকর্মী সুরক্ষায় পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক, এনজিও- আমাদের সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। দেশের বিদ্যমান নীতি ও আইনের সঠিক বাস্তবায়ন যদি করা যায়, তাহলে এসব সমস্যার সমাধান বহুলাংশে সম্ভব।
কাজী আবুল কামাল
রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জ্ঞান অনেক কম। নতুন করে আইন সংশোধনের কাজ চলছে। এতে দালালদের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এটি দিলেও সমস্যা দেখা দেবে। বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই বিদেশে যাচ্ছেন দেশের ৭৭ শতাংশ কর্মী। যাওয়ার প্রক্রিয়ায় তাঁদের বেশিরভাগই দালাল ধরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অভিবাসী শ্রমিকদের ভোগান্তি এড়াতে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার বিদেশে ভোগান্তির শিকার হলেও নিজের টাকায় আইনি সহায়তা নিতে হচ্ছে। আমি মনে করি, এই খরচ রাজস্ব খাত থেকে দেওয়া দরকার।
দূতাবাসগুলো এমন একটা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, যারা সব দেশে আইনি সহযোগিতা দিচ্ছে। তা না হলে শ্রমিকদের এ দুর্ভোগ দূর করা সম্ভব হবে না। মামলা করেও লাভ হবে না। মৃত কর্মীদের নিয়ে রামরু একটি কাজ শুরু করেছে। অল্প বয়সে অনেক শ্রমিক কেন মারা যাচ্ছে- এ বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। ২০১৩ সালে একটি আইন হওয়ার পরও কেন এ খাতের সংশ্নিষ্টরা এটি জানবেন না? সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা উচিত।
অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান
অভিবাসীকর্মীদের অধিকার এবং তা না পেলে পদক্ষেপ বিষয়ে তাঁদের সচেতন করতে হবে। তাঁদের সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে কী কী অধিকার আছে; এ থেকে বঞ্চিত হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, এ সব তথ্য তাঁদের জানতে হবে। অভিবাসীকর্মীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। এ জন্য বুকলেট আকারে কিছু তৈরি এবং অনলাইনে তা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানে ৬৪টি জেলায় লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁরা খুব ভালোভাবে কাজ করছেন। প্রবাসী শ্রমিকদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের অভিবাসী শ্রমিক নিয়ে চুক্তি রয়েছে, সেখানে একটি বিষয়ে বেশি জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো যদি আমরা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে বিচারপ্রাপ্তিতে আরও সুযোগ তৈরি হবে।
অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন রয়েছে। এ আইন বিষয়ে গত বছর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, প্রবাসে নির্যাতনের অভিযোগ এলেও পুলিশ সরাসরি আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। বরং এটি পাঠিয়ে দিতে হবে বিএমইটিতে। তারা তদন্ত করে জানাবে, কী ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন বিষয়ে আপত্তি হলে তা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে আইন দুর্বল করে দিয়েছি। নির্বাহী ক্ষমতা ও প্রচলিত আইন আলাদা থাকাই ভালো।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া
অভিবাসী আইন ২০১৩ শ্রমিকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য কতটুক উপযোগী? একজন শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার কিছুদিন পর ফিরে আসছেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, কাজের উপযোগী পরিবেশ নেই। কিন্তু বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আগে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা। প্রকৃতপক্ষে তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে দেশেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাই একজন শ্রমিক যাওয়ার আগে দেশে এবং বিদেশে কোথায় কীভাবে আইন প্রয়োগ হবে, সেটি আরও স্পষ্ট করতে হবে। একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ১১ বছরে বিদেশ থেকে ৩৪ হাজার অভিবাসীকর্মীর লাশ এসেছে। এ তথ্যটি প্রকাশ করার পর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। বিদেশে যাওয়ার পর কয়েক দিন বা এক মাস পর অনেকে আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু যে দেশে যাচ্ছেন, সেখানে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এসব দেশে কি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান নেই? আর আমার দেশ এসব ঘটনায় কী করছে! সমস্যায় পড়লে অনেক দূতাবাসে প্রবাসী শ্রমিকরা যাওয়ার পর মাসের পর মাস ঘুরলেও কোনো সমাধান হয় না। তাই দূতাবাসগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
আলী হায়দার চৌধুরী
একজন অভিবাসী শ্রমিক তাঁর শ্রম আর ঘাম দিয়ে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন শ্রমিক। তাই একজন শ্রমিক বিদেশের মাটিতে যাওয়ার আগে প্রথমে তাঁকে জানতে হবে- তিনি কোন দেশে যাচ্ছেন, কার মাধ্যমে যাচ্ছেন, কত বেতনে যাচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত বেতন ছাড়াও নানা অধিকার তাঁকে জানতে হবে। আর এ শ্রমিকদের পাঠানোর আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বও তাঁকে এসব বিষয় জানানো। অভিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় দূতাবাস, মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্ব আছে। একজন শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়ে সরকার ও বেসরকারি সব সংস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাতে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে। ওমান, কাজাখস্তান, লিবিয়ায় সরকারি মাধ্যমে অনেক দিন ধরে কর্মী পাঠানো বন্ধ। তারপরও এসব দেশে শ্রমিকরা বিভিন্ন মাধ্যমে গিয়ে বেকার হয়ে পড়ে আছেন। সুদানের মতো দেশে এখনও শ্রমিকরা যাচ্ছেন, শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছেন। কিন্তু এসব দেশে কীভাবে যাচ্ছেন? শ্রমিক পাঠানোর এসব মাধ্যমে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে; পরে বিদেশের মাটিতে। এটি কমাতে স্থানীয়ভাবে সচেতনতার পাশাপাশি দূতাবাসকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
মো. নূর খান
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে প্রথম থেকেই কাজ করছি।প্রথমদিকে আমরা প্রতারণা নিয়ে কাজ করতাম, পরে নির্যাতন নিয়ে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে দেশের বাইরে থেকে প্রায় প্রতিদিনই লাশ আসত। এর মূল উৎসস্থল ছিল মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব। এসব লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই সরাসরি দেশে আসত; সরকারও এ নিয়ে তেমনভাবে কথা বলত না। তারা মনে করত, শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বললে যদি দেশের শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়; রেমিট্যান্সের ধারা যদি বন্ধ হয়ে যায়! মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের নির্যাতনের ধরন ছিল বীভৎস। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করে তারাই অনেকটা দোররা মারার মতো মারধর করে শরীর রক্তাক্ত করে দিত। আর খাবারের পরিমাণ এত কম ছিল যে, ওই খাবার খেয়ে দুই মাস পরে মানুষ মারা যেত। এ সময় মালয়েশিয়ার একটি সংগঠন এসব নির্যাতন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষণা শুরুর পর তারা একটি মামলায় পড়ে। পরে ওই সংগঠনটি আমাদের কাছে সহযোগিতা চায়। তখন আমরা সারাদেশে খুঁজে খুঁজে মালয়েশিয়ায় নির্যাতনের পরে যাঁরা ফিরেছেন তাঁদের এবং মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। এসব তথ্য পাঠানোর পর শ্রমিকদের সাক্ষী হিসেবে আদালত গ্রহণ করেন। পরে মালয়েশিয়ার শ্রমিক নির্যাতনের জন্য তৈরি করা সেলগুলো বন্ধ হয়। অভিবাসী শ্রমিক নির্যাতনের আরেকটি দিক সৌদি আরবে নির্যাতন। সেখানে নারীরা বেশি নির্যাতিত। তাঁদের বেতনও নিয়মিত দেওয়া হতো না। অনেক সময় দালালরা বেতনের টাকার একটি অংশ নিজেরাই রেখে দিত। সে ক্ষেত্রে আমরা কিছু ঘটনা নিয়ে বিদেশে সমাধানের চেষ্টা করি। সেখানে দু-একটি ক্ষেত্রে আমরা সফলতা পেয়েছি; অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাইনি। এখানে শ্রমিক নির্যাতন বন্ধে সরকার যখন আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে, তখন যেন শ্রমিকের মর্যাদা আর অধিকার দুটি নিশ্চিত থাকে। মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে যেন শ্রমিকের অধিকারে ওই দেশের শ্রম আইন তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হবে, নাকি অভিবাসীদের জন্য আলাদা- এটিও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আর বিদেশে কোনো শ্রমিক মারা গেলে সে দেশে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ দেশ থেকে যে পদ্ধতিতে শ্রমিকরা যাচ্ছেন, তার ত্রুটি রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। এখন পর্যন্ত সরকার প্রবাসে শ্রমিক পাঠাতে যত টাকা বেঁধে দিয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে দালালরা। এ জায়গা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরলে বিমানবন্দর থেকে তাঁকে মর্যাদা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে যেসব বেসরকারি সংগঠন কাজ করে, তাদেরও নেওয়া যেতে পারে। আর বিদেশ থেকে কোনো অভিবাসী শ্রমিক ফিরলে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা; মৃত শ্রমিকের শবদেহের ক্লিনিক্যাল তদন্ত করতে হবে।
বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক
নির্যাতিত অভিবাসী শ্রমিকরা নানা কারণে বিচার পাচ্ছেন না। মামলা করলেও দীঘর্ দিনে এর সুরাহা হচ্ছে না। নির্যাতনের অনেক প্রমাণ আদালতে জমা দিলেও প্রতিকার মিলছে না। দুর্নীতির কারণে এই নির্যাতন হাইকমিশন ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কপি পরিবারের কাছে না থাকায় হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার শ্রমিকরা মামলা করতে পারেন না। এমনকি যাঁরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তাঁরাও এ বিষয়ে কাজ করতে চান না। অনেক মামলা হলেও বিচার হয় না। বিচার কোথায় পাব, প্রমাণগুলো আদালতে জমা দেওয়ার পর সেগুলো দেখে যদি বিচার করা হতো তাহলে অভিবাসী শ্রমিকদের আরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। এ খাতে দুর্নীতির কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
শরিফুল হাসান
৮২ শতাংশ তরুণ কেন দেশ ছাড়তে চাইছে; শুধু কি অর্থনৈতিক কারণ, না আমাদের দেশে অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে, খুঁজে বের করতে হয়। কেউ বিদেশে যেতে চাইলে প্রথম ভোগান্তির শিকার হন পাসপোর্ট নিয়ে। এটি করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও কেন পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হবে? এটা যে দুর্নীতি- তা বলে বোঝানো যাবে না। মেডিকেল পরীক্ষা নিয়ে আরও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এ প্রক্রিয়া কী জটিল ও ভোগান্তির- একমাত্র প্রবাসী শ্রমিকরাই জানেন।
একজন শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার আগেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। তাঁরা বিদেশে ১৮-২০ ঘণ্টা কাজ করেন। এক কক্ষে বসবাস করেন ২০ জনের বেশি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। গত ১৫ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যা দিনে গড়ে ১০ জন। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের এ মৃত্যুর বেশিরভাগই স্ট্রোক ও হৃদরোগে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কোনো তদন্ত হচ্ছে না। গত ছয় বছরে ৫ শতাধিক প্রবাসী নারী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে, যাঁদের মধ্যে ৮৪ জন আত্মহত্যা করেছেন। কেন আত্মহত্যা করেছেন, তদন্ত পর্যন্ত হচ্ছে না। এত ভোগান্তির পরও প্রবাসী শ্রমিকরা আমাদের দূতাবাসে মানুষের মর্যাদা পাচ্ছেন না। হাতে শিকল পরিয়ে মালয়েশিয়া থেকে শত শত মানুষকে গরু-ছাগলের মতো বাংলাদেশে নিয়ে আসা হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের কর্মীদের সঙ্গে কেন এমন আচরণ করা হচ্ছে, তা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভাবছেন না।
মো. তাজুল ইসলাম
অভিবাসী শ্রমিকরা দেশ থেকেই প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হন। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিজ এলাকায় প্রথম প্রতারণা করা হয়। পরে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে দ্বিতীয় ধাপে হয়রানির শিকার হন। অনেকে আবার সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যান। যে কোনো মাধ্যমে গেলেও বিদেশের মাটিতে অভিবাসী শ্রমিকরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। তাঁদের বেতনের টাকা দেওয়া হয় না। কর্মস্থলে যে সুবিধা ও পরিবেশ দেওয়ার কথা, সেটিও দেওয়া হয় না। আবার শ্রমিকরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হলেও দেশের আইন অনুযায়ী কোনো বিচার পান না। কারণ অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতন-হয়রানির প্রতিকারে দেশে কোনো নীতিমালা বা আইন নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সরকার আইন করবে বলছে; কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় করবে সেটি বিবেচ্য বিষয়। নির্যাতিত শ্রমিকদের বিচার না পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়, তাঁরা অর্থ লেনদেনের সময় কোনো প্রমাণ রাখেন না। অনেক সময় সাদা কাগজে সই রাখা হয়। ফলে পরে সেটি গুরুত্ব পায় না।
মো. আতিকুর রহমান
কুমিল্লায় অভিবাসীকর্মীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত ১৭১টি অভিযোগ পেয়েছি। এসব বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা নিজস্ব বলয়ের লোকজনের কাছ থেকেই প্রতারিত হয়েছেন। একই ইউনিয়নের বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন। এসব অভিযোগ স্থানীয়ভাবে সালিশ-দরবার করে সমাধানের চেষ্টা করি। টাঙ্গাইলে অভিবাসীকর্মীদের এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে স্থানীয়ভাবে সমাধানে সফলতা এসেছে। কুমিল্লায় প্রবাসী শ্রমিকদের এসব প্রতারণার ঘটনায় তথ্য সংগ্রহ করেছি। সমাধানে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তাঁদের প্রতারণার ধরন দেখে বোঝা যায়, তাঁরা টাকা লেনদেনের সময় কোনো প্রমাণ রাখেন না। অনেক সময় প্রমাণ থাকলেও তাতে শুধু স্বাক্ষর ছাড়া কোনো কিছু লেখা থাকে না। আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জনের অ্যাকাউন্টে টাকা নেন। বিকাশে লেনদেনেও টাকা দিলে চিহ্নিত করা যায় না। এসব মাধ্যমে টাকা লেনদেন করলে পরে তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। স্থানীয় পর্যায়ে টাকার লেনদেন করলে সেসব স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান করা যায়। আদালতের কাছে এসব মামলা দিলেও সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। তারা সিআইডির মাধ্যমে তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে।
আবু সাঈদ খান
অভিবাসীকর্মীদের যে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার কথা, সেটা আমরা দিতে পারছি না। এখানে সুবিচার প্রাপ্তির বদলে অবিচার করা হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে তাঁদের নির্যাতন, হয়রানি, চাঁদাবাজি শুরু হয়। তাঁদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ এখনও হয়নি। দেশের শেয়ারবাজারের যে অবস্থা, সেখানেও ইনভেস্ট করার সুযোগ নেই। তাঁদের উপার্জিত অর্থ জাতীয় অর্থনীতিতে উন্নয়ন কাজে ব্যয় হতে পারত। কিন্তু সে ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করতে পারেনি। সেটা করার জন্য যে ধরনের শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে মিলে কিংবা গ্রামীণ পর্যায়ে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা বা কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ অবারিত করা উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি। যে কারণে অভিবাসীদের অর্থ অনেক সময় জমি কেনা বা অন্য কাজে ব্যয় হচ্ছে। অভিবাসীকর্মীদের সব ক্ষেত্রে সম্মান দিতে হবে। শ্রেষ্ঠ রপ্তানিকারকদের মধ্যেও তাঁদের সম্মাননা দিতে হবে। রেমিট্যান্স সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থা ছাড়াই বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা দেশে আসে। এর দায় শ্রমিকদের নয়। সরকারি মাধ্যমে টাকা পাঠাতে যে প্রতিবন্ধকতা, তা দূর করে ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দিতে হবে।
আলোচক
মো. নিজামুল হক নাসিম
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ সুপ্রিম কোর্ট
চেয়ারম্যান, জাতীয় প্রেস কাউন্সিল
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, এমপি
চেয়ার, পার্লামেন্টারি ককাস অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
তৌহিদ হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব
বাংলাদেশ সরকার
কাজী আবুল কামাল
সাবেক যুগ্ম সচিব, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আলী হায়দার চৌধুরী
সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল, বায়রা
মো. নূর খান
নির্বাহী পরিচালক, আইন ও
সালিশ কেন্দ্র (আসক)
বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক
নির্বাহী পরিচালক, রাইটস যশোর
শরিফুল হাসান
প্রধান, ব্র্যাক মাইগ্রেশন
মো. তাজুল ইসলাম
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মো. আতিকুর রহমান
প্রোগ্রাম অফিসার (অ্যাকসেস টু জাস্টিস) রামরু
কি-নোট ও সঞ্চালনা
ড. সি আর আবরার
নির্বাহী পরিচালক, রামরু
সভাপতি
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
অনুলিখন
তবিবুর রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
লতিফুল ইসলাম
নিজস্ব প্রতিবেদক, সমকাল
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্ট, সমকাল
মো. শিমনউজ্জামান
প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, রামরু
মন্তব্য করুন