- বিশেষ আয়োজন
- বিবেক ও কর্তব্যজ্ঞানের অপেক্ষায়
কালের যাত্রা ২০২৩
বিবেক ও কর্তব্যজ্ঞানের অপেক্ষায়
রাজনীতি

নববর্ষ নিয়ে অনেক লিখেছি, অনেক বছর ধরেই লিখছি- বৈশাখের প্রথম দিবসে, জানুয়ারির ১ তারিখে। দুই দিনপঞ্জির নববর্ষ, দুই ঋতুতে যাদের আবির্ভাব, কিন্তু একই তাদের আহ্বান :পুরোনো বছরের অপ্রাপ্তি-অপূর্ণতা-অনর্থ-অবসাদ ঘুচিয়ে নতুন আসছে, তাকে বরণ করো। নতুনের পথে নতুন আশা, যার উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু করো; এতদিনের পাপ-তাপ-ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করো ইত্যাদি। এই ডাক নববর্ষ অবশ্য দেয় না; মহাকালের যাত্রায় কোনো একটি দিন, যতই বিশিষ্ট তা হোক না কেন, আলাদা উল্লেখের কোনো দাবি রাখে না; নববর্ষও না। এই ডাক আসলে আমরা নিজেদেরই দিয়ে যাই, একে গুরুত্ব দিতে নববর্ষের নামটা শুধু তাতে জুড়ে দিই। একটা বছর ধরে যত কিছু ঘটতে থাকে- ঘরের চার দেয়ালের ভেতর থেকে নিয়ে বিশ্বের বিস্তৃত ভূগোলে- সেসবের অভিঘাতে আমরা বিপর্যস্ত হতে থাকি। বছরটা আমরা শুরু করি অনেক আশা নিয়ে, সেগুলো উবে যায় কঠিন বাস্তবের ঝাপটায়। সে জন্য বছর যত ফুরায় তত নতুন বছরটার দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি। ভাবি, ভালো দিন আসবে। আমাদের কষ্টও ফুরাবে।
ফুরায় না। বাড়ে বরং। কারণ আমরা এখন যে পৃথিবীতে আছি, যে পৃথিবী মরে গিয়েও বেঁচে গেল দুই মহাযুদ্ধের পর, তা শুধু সংকটই দেখছে- সভ্যতার সংকট, অসভ্যের তৈরি অস্তিত্বের সংকট, ভদ্রতা আর সংস্কৃতির সংকট, রুচির সংকট। এর সঙ্গে অর্থনীতি, সমরনীতি, কূটনীতি, রাজনীতি এবং এ রকম নীতিহীন আরও কিছু নীতি যোগ হয়ে সংকটের বীভৎসতা আর পরিত্রাণহীনতাকে নির্বাণের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক সংকটের ভেতরে আছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমাদের নিজেদের তৈরি অসংখ্য সংকট- যেগুলোর হিসাব নিতে গেলে হতাশ হতে হয়। এসবের মূলে আছে বৈষম্য, অধিকারহীনতা, দারিদ্র্য, সমরতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা, উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং অপরাজনীতি। সংকট তীব্র হয়েছে চিন্তা আর স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায়; আইনের শাসন দুর্বল হওয়ায়। এক প্রকৃতি বিজ্ঞানী লিখেছেন, মানুষের যে কোনো সংকট প্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলে; প্রকৃতি তাতে পাল্টে যায়। বস্তুগত লোভ কীভাবে জলবায়ুতে ভয়ানক সব পরিবর্তন এনে প্রকৃতিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে, তিনি তাঁর উদাহরণ দেন। আমার বিবেচনায় আমাদের যত সংকট, সেসব বদলে দিয়েছে আমাদের মানবিক প্রকৃতিকেও। আমরা অন্যের দুঃখে দুঃখ পাই না, নিজের সচ্ছলতা আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে দু'বার ভাবি না। নিজের ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নিয়ে বড়াই করে অন্যের জীবন কঠিন করে ফেলি। আমাদের বাইরেটা চকচকে থাকে, ভেতরে থাকে আদিম অন্ধকার।
২০২০ সালে বৈশ্বিক সংকটকে খাদের গভীরে নিয়ে গেল যে কভিড মহামারি- যা চীনে এখন নতুন তাণ্ডব ছড়াচ্ছে- তার আঘাতে অনেক শক্তিশালী দেশও বিপর্যস্ত হলো। বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই কভিড সংকট সামাল দিচ্ছিল, কিন্তু বিশ্বে যে নতুন এক সহিংসতার বান জাগল রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধে, তার প্রভাব কভিডকেও ছাপিয়ে গেল। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এবার সত্যি সত্যি কঠিন এক পরিস্থিতিতে পড়ল; যা অর্থনীতি, সমাজ, স্বাস্থ্য, কৃষি ও খাদ্য সব ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতির সুফল কেড়ে নিল। ২০২২ সালটা শুরু হয়েছিল কভিডমুক্তির এক বিশাল স্বস্তি নিয়ে, ঘুরে দাঁড়ানোর একটি প্রত্যয় নিয়ে। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি আমার বিশ্বাস ছিল, বছরটা হবে বাংলাদেশের। আমার আশা ছিল, কভিড থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এগোব এবং অনেক দূর যাব। কভিড আমাদের আতঙ্ক কী জিনিস শিখিয়েছে, স্বার্থপরতা এবং মানুষকে দূরত্বে রাখা শিখিয়েছে। আমরা বুঝেছি মানুষ একা বাঁচে না, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হয়। একের সঙ্গে অন্যের বন্ধনটা দরকার। সবাই মিলে পথ হাঁটলে পথের ক্লান্তিটা থাকে না; যাত্রাটাও অর্থপূর্ণ হয়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা হঠাৎ আমাদের দেখিয়ে দিল, আমাদের ভাগ্য এখন আমাদের হাতে নেই; এটি এখন বিশ্বমোড়লদের মালিকানায়।
আমাদের অর্থনীতির দালান দু'এক জায়গায় ভেঙে পড়ল। গ্যাস-তেলের সংকট শুরু হলো। ডলারের দাম একলাফে ২০ শতাংশ বেড়ে গেল। বোঝা গেল, আমাদের বিত্তশালীরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সঞ্চয় করতে চান। শক্তিশালীরা ব্যাংক লুট করে বিদেশে শুধু বেগমপাড়া নয়, বেগমগঞ্জও বানাতে পারেন। ঘুষ খাওয়াকে পান-সিগারেট খাওয়ার মতো সহজ করে ফেলতে পারেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আমার আশাবাদ ছিল, আমরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে দেশ গড়তে নামব। বাস্তবে আমি যা দেখলাম, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যত অপকর্ম আর অপরাধকে আরও নিখুঁত করতে শিখেছি। ফলে এখন অপরাধ যত বড় এবং অপরাধী বিত্তগত ও সামাজিকভাবে যত শক্তিশালী, তার রাজনৈতিক সংশ্নিষ্টতা যত দৃঢ় তত তার গায়ে আঁচড়টি না পড়ার নিশ্চয়তা।
২০২২ সালের শেষ দিকে এসে হঠাৎ দেখা গেল, রাজনীতির মাঠ গরম হচ্ছে। বিএনপি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তার হাত ধরে জামায়াতসহ অনেক দলও। আওয়ামী লীগ কিছুদিন চুপচাপ থেকে মাঠে নামল। আমাদের দেশে সরকারি দল মাঠে নামা মানে ওই মাঠে আর কারও ঢোকার মতো জায়গা না পাওয়া। তারপরও আমরা চাই, সহিংসতা পর্যন্ত না গিয়ে উত্তেজনা হোক; মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে চলে গিয়েছিল, তারা আসুক। পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে কথা বলুক, তর্ক করুক, কিন্তু তর্ককে খুনাখুনিতে নিয়ে না যাক। কিন্তু সেই আশা কত দিন টিকিয়ে রাখা যায়, সে এক প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত কথার লড়াই হচ্ছে, দু'পক্ষ থেকে হুঙ্কার তোলা হচ্ছে, ধরপাকড় চলছে, কিন্তু নতুন বছরে আরও শীত নামলে পরিস্থিতি যেন শীতল হয়। কয়েক মাস ধরে আমি বিশ্বের পরিস্থিতির ওপর একটা চোখ রেখেছি, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ চোখ রেখেছি বাংলাদেশের ওপর। বিশ্ব নিয়ে আমার তেমন উচ্ছ্বাস নেই। পশ্চিমা বিশ্ব পুঁজিবাদ আর উপনিবেশবাদ নামে দুই মশাল জ্বেলে, তাদের ভাষায়, বিশ্বকে আলোকিত করেছে; পুঁজি শিল্পায়ন, নগরায়ণ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বকে আধুনিক করেছে; উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। আর উপনিবেশবাদ, পশ্চিমের ভাষায়, পুবের সভ্যতাকে উন্নত ও সম্প্রসারিত করেছে; পুবের জ্ঞান, প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করেছে। কিন্তু উপনিবেশবাদ যা করেছে :বিশ্বকে নিঃস্ব করে পশ্চিমকে সম্পদশালী করেছে। এ দুই মশাল যে আলোয় পশ্চিমকে আলোকিত করেছে, সেই আলো পুবের বাড়িঘরে এদের লাগানো আগুনের। পশ্চিম বদলায়নি, এখনও এ দুই মশাল হাতে দাঁড়িয়ে। তবে আগুন লাগানোর কায়দাটা বদলেছে।
বিপদ আমাদের শুধু এই যুদ্ধ বা মহামারি আনেনি; বিপদ আনছে জলবায়ু পরিবর্তন, আবহাওয়ার তুঘলকি মেজাজ, কৃষি ও উৎপাদনে তার প্রভাব। যে সংকট গত তিন মাসে এক কঠিন বাস্তবতায় আমাদের এনে ফেলেছে, তা একদিকে এত দিনের অর্জিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, রপ্তানিতে ৫০ বিলিয়ন ডলার পার হওয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লবী পরিবর্তন আনা- এসব ম্লান করে দিচ্ছে। ২০২৩ সাল আরও কঠিন হবে। ধরে নিলাম ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে যে সরকার ক্ষমতায় এল এবং যাঁরা সংসদের ডান-বামে বসলেন, সবাই দেবদূতের মতো। তারপরও ওই সরকারের হাত বেঁধে দিত বৈশ্বিক সংকট। সেই সরকার কিন্তু সংকটটা কাটাতেও পারত। কারণ আমাদের সংকট গভীর হওয়ার মূলে যেসব সমস্যা বড় ভূমিকা রেখেছে, সেসব অনেকটাই তখন থাকত না। বাংলাদেশের দিকে ঘনিষ্ঠ চোখ রেখে আমি দেখেছি আমাদের মূল সমস্যাগুলো হচ্ছে- দেশপ্রেমের অভাব, প্রচণ্ড রকমের স্বার্থপরতা এবং লোভ, ভবিষ্যৎকে দেশের বাইরে ঠেলে দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার প্রত্যয়, বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে আপদে-দুর্যোগে, এমনকি রোজার মাসে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতার বাইরে ঠেলে দেওয়া, শৃঙ্খলার প্রচণ্ড অভাব, ভালো-মন্দ বিচারের অক্ষমতা এবং অসহিষুষ্ণ ও উগ্র নানা মতের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া। এসব সমস্যা কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের নয়; যারা দেশের সিংহভাগ। এগুলো তৈরি করছে শিক্ষিতরা, উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাবানরা, বাজার দখল করা ব্যবসাজীবীরা, পথভ্রষ্ট পেশাজীবী এবং মানুষকে জিম্মি করে কিছু একটা করার ক্ষমতা যাদের আছে, তারা। এরা ওই কৃষক-শ্রমিকের পাশে দাঁড়ালে সংকট অনেকটাই কমত, কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা বিপরীত বরং। এই সঙ্গে যদি এবার রাজনীতির মাঠে সংঘাত তৈরি হয়, হতে থাকে, তাহলে তার অভিঘাতে সমাজের সব স্তরে অস্থিরতা এমন বাড়বে যে অর্থনীতিসহ সব কর্মরথের চাকা অচল হয়ে যাবে।
২০২৩ সালে আমার আশাবাদটা পুরোনো যেন দেশটা শান্তিতে থাকে, আমরা মিলেমিশে চলতে পারি, দেশটাকে নিয়ে ভাবি এবং কাজ করে যাই। আমি জানি, এ জন্য দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা বোধ আসতে হবে; যার নাম দেশপ্রেম। শব্দটি পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু যে কবির কলম থেমে গিয়েছিল ইংরেজ উপনিবেশ শাসনের শেষ প্রান্তে, তাঁর থেকে কিছু কথা ধার করে আমার আশাবাদটা জিইয়ে রাখব। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কথাগুলো তখন যতটা মূল্যবান ছিল, এখন, আমাদের সময়ে আরও বেশি। আজ থেকে একশ বছর আগে প্রকাশিত যুগবাণীর একটি প্রবন্ধে (গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!) তিনি লিখেছিলেন- দেশের পক্ষ হইতে আহ্বান আসিতেছে, কিন্তু কাজে আমরা কেহই সাড়া দিতে পারিতেছি না। অনেকে আবার বলেন যে, অন্য কে কী করিতেছে, আগে দেখাও, তারপর আমাদিগকে বলিও। এই প্রশ্ন ফাঁকিবাজের প্রশ্ন। দেশমাতা সকলকে আহ্বান করিয়াছেন, যাহার বিবেক আছে, কর্তব্যজ্ঞান আছে, মনুষ্যত্ব আছে, সেই বুক বাড়াইয়া আগাইয়া যাইবে...নেতা কে? বিবেকই তো তোমার নেতা, তোমার কর্তব্য জ্ঞানই তো তোমার নেতা! ...কর্তব্য-জ্ঞানের কাছে, ত্যাগের কাছে সম্ভব অসম্ভব কিছুই নাই।
২০২৩ সালে আমাদের বিবেক জাগুক, কর্তব্যজ্ঞান জাগুক। এ দুই শক্তির উদ্বোধনে দেশটা বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো লাল-সবুজের ভূখণ্ড হতে পারে।
লেখক
কথাশিল্পী
শিক্ষাবিদ
মন্তব্য করুন