আমার জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট, বাংলা ১৩৪৩ সনের ২ ভাদ্র। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় চন্দপাড়া নামে একটি ছোট্ট গ্রাম আছে। ওই গ্রামে আমার জন্ম, সেটি একটি অজ পাড়াগাঁ।
আমার বাবার কোনো ভাই-বোন ছিল না। এর ফলে আমার ঠাকুর মা সব সময় চিন্তা করতেন, আমাদের বংশ বুঝি লোপ হয়ে যাবে! আমার জন্মের আগে এক বোন জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কিছুদিন পরই তার মৃত্যু হয়। এতে আমাদের পরিবারের মধ্যে আরও বিষাদ নেমে আসে। তখন আমার ঠাকুর মা মানত করতেন- আমাদের বংশ যেন লোপ না হয়। আমার জন্মের খবর ধাত্রীমুখে শুনে ঠাকুর দা বললেন-
আজ থেকে আমাদের শান্তি হলো এবং এর নাম রাখলাম শান্তি।
আমার ডাকনাম শান্তি। আমাদের এলাকার অনেক মানুষ এখনও আমাকে শান্তি নামেই চেনে।
ছোটবেলায় আমার বেড়ে ওঠাটা অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে খানিক আলাদা। অন্য ছেলেমেয়েরা বেড়ে ওঠে খেলাধুলা করে। আমার খেলাধুলার সঙ্গে সম্পর্কই ছিল না। এই সম্পর্ক না থাকার প্রধান কারণ হলো- আমার ঠাকুর মা কোনোভাবেই আমাকে খেলাধুলায় যুক্ত হতে দিতেন না। সব সময় ভয় পেতেন- আমি হয়তো খেলতে গিয়ে আঘাত পাব, মরে যাব। তিনি বলতেন-
তোকে মাথায় রাখি না উঁকুনে খাবে; মাটিতে রাখি না পিঁপড়ায় খাবে। তোকে কোলে করে রাখি।
কোল থেকে বের করে ঠাকুর দাদা (পিতামহ) রামদয়াল সরকারের কাছে তুলে দিতেন।
ছোটবেলায় ঠাকুর দা আমাকে নিয়ে পড়তে বসতেন। তিনি এমন সব কথা আমাকে শিখিয়েছেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা এসব জানবে- সেটা চিন্তাও করা যায় না। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, আমার যখন ছয় বছর বয়স তখনই আমি কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়া হয়ে গেছে। এইভাবে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে তোলেন তিনি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় ও মহাপুরুষদের সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দিয়ে চললেন। এইভাবে আমি ঠাকুর দার কাছে বড় হয়ে উঠেছি।
আমি খেলাধুলা তো প্রায় করতামই না, শুধু পড়তাম আর পড়তাম। ছোটবেলায় শুধু রামায়ণ না, মহাভারত, বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলি পড়া হয়ে গিয়েছিল। ম্যাট্রিকের আগেই বঙ্কিম রচনাবলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে শরৎচন্দ্রের অনেক বই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল। এভাবে আমার পড়াশোনার ব্যাপ্তিটা গড়ে উঠেছিল।
তখন আমার বয়স ১০ বছর। আমার মামার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকায়। সেখানে আমাকে যেতে হলো। এটি ১৯৪৬ সালের কথা। পাকিস্তান হবে হবে। হিন্দুরা খুব ভয়ে আছে যে, পাকিস্তান হলে আমরা এ দেশে থাকতে পারব না। মামার বাড়িতে আমি সবার মধ্যেই এমন অবস্থা দেখেছি। একদিন মামার বাড়ি থেকে কিছু দূরে গাবতলী হাটে গেলাম। দেখলাম এক লোক কবিতা পাঠ করছে। চার পৃষ্ঠা কাগজের মধ্যে লেখা সে কবিতা। কবিতার নাম 'পাকিস্তানের কবিতা'। কবির নাম ইউনুস আলী। আমার এখনও মনে আছে কবিতার কথাগুলোতে তিনি কী বলতে চেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে- পাকিস্তান হলে কী হবে- এমন অনেক কথা আছে। কবিতায় আরও বলা হয়- 'ঢাকায় রাজধানী হবে, উন্নতি হবে, বাংলাদেশের ভাই। হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে থাকতে যেন পারি।'
অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এবং আমাদের গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতজনেরা পাকিস্তানকে কোনোমতেই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে দেখেননি। পাকিস্তান হয়েছে, হিন্দু-মুসলমান সব মিলে মিশে থাকবে, এটাই ছিল তাঁদের চাওয়া। ইউনুস আলীর কবিতার মধ্যে এ রকম দৃষ্টান্তও তিনি রেখেছেন- 'দেখো, কদর আলী আর ঠাকুর দার এক উঠাইন্যা বাড়ি।' দু'জন ভিন্ন ধর্মের মানুষের বাড়ির এক উঠান। তারা পরস্পর মিলেমিশে একে অপরের উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে। পাকিস্তান হলেও এভাবেই চলবে। আমি ছোটবেলায় প্রাকৃতজনদের মধ্যে এটাই লক্ষ্য করেছি। প্রাকৃতজনের সঙ্গে থেকেই আমি বড় হয়ে উঠেছি।
১৯৪৮ সালের কথা বলছি। নেত্রকোনা শহরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে চন্দ্রনাথ স্কুলে আমি ভর্তি হয়েছিলাম। তখন এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম। সেখানে আমি অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছি, যদিও সেখানে মাত্র এক বছর ছিলাম। আমি তো ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ঠাকুর দা আমায় অনেক কিছু শিখিয়ে ফেলেছিলেন। অনেক কিছুই আমি জানতাম, বুঝতাম। ওই স্কুলে একজনকে চমৎকার বক্তৃতা দিতে শুনেছিলাম। এত সুন্দর বক্তৃতা আর হয় না। সম্ভবত তাঁর নাম শুভেন্দু চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যাপক। তাঁর কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিল, অধ্যাপকের চেয়ে বড় কিছু নেই। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাকে কলেজের অধ্যাপক হতে হবে। অন্য যারা বক্তৃতা করলেন, তারাও অধ্যাপক ছিলেন। সেই ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত; জিন্নাহ সাহেব যখন বললেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ক্লাস করছিলাম। নবম-দশম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্র দৌড়ে এসে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল। তারা বলল, জিন্নাহ সাহেব আমাদের ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁকে বলা হয়, কায়েদে আজম, জাতির পিতা; তিনি কখনও এগুলো হতে পারেন না। চলো, তোমরা বেরিয়ে এসো। পুলিশ অত্যাচার করেছে, পুলিশের জুলুম বন্ধ করতে হবে। সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসো। আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম। তখন নেত্রকোনায় কোনো কলেজ ছিল না। তিনটি হাই স্কুল ছিল ছেলেদের আর একটি মেয়েদের। ছেলেরা সব বেরিয়ে এসেছিল, মেয়েরাও এসেছিল। তারা মোক্তারপাড়া মাঠে এক সভা করল। সেখানে এমনভাবে জিন্নাহর বিরুদ্ধে কথা বলা হলো, যা অবাক হওয়ার মতো। যে জিন্নাহ জাতির পিতা, কায়েদে আজম, তার বিরুদ্ধে যে এভাবে কথা বলা যেতে পারে, তা মানুষের ধারণায় ছিল না। কারণ, আমার ওই আত্মীয় অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেলেন। যে কারণে এক বছর পর আমাকে নেত্রকোনা শহর থেকে চলে আসতে হলো। তখন আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছে এক স্কুলে ভর্তি হলাম।
পাকিস্তান আমলে শিক্ষিত মানুষ সব নানা দিকে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। আজ একজন শিক্ষক আসেন তো কাল চলে যান। এমন অবস্থায় আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া একরকম হয়নিই বলা যায়। এভাবেই ক্লাস সেভেন পাস করলাম।
অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম- তখন ১৯৫০ সাল। পাকিস্তানে একটা দাঙ্গা সংঘটিত হলো। যা-ও হিন্দু ছিল এ দেশে, তার অনেকেই সেই দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে চলে গেল। আমরাও স্কুল থেকে চলে আসতে বাধ্য হলাম- কারণ, তখন সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটা বাধ্যতামূলক ক্লাস ছিল, আমরা তাতে সংস্কৃত পড়তাম। কিন্তু স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক পণ্ডিতমশাই ভারতে চলে গেলেন। কাজেই ওই স্কুলে আর পড়া হলো না।
আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। দাঙ্গায় অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে বাবা জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র সরকারের সেই চিকিৎসা পেশা বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের পরিবারের দারিদ্র্য আরও বেড়ে গেল। আমি সেই সময় আমাদের বাজারের কাছে একটা গাছতলায় পান-বিড়ি-সিগারেট ও বিভিন্ন মনোহারি দ্রব্য নিয়ে দোকানদারি করতে বসে গেলাম। সেই দোকানদারি করেছি বটে, তবে সেখানে বসে বসেও আমি বই পড়েছি। তখন একাডেমিক লেখাপড়ার দিকে যদিও আমার মনোযোগ ছিলই না একপ্রকার, পাঠ্যবইগুলো আমাকে পড়তে হতো ঠিক 'রোগী যেন নিম খায় মুদিয়া নয়ন'-এর মতো। কিন্তু মূলত আমি যা পড়েছি, তা হলো- 'অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব/ সামনে আছে খোলা/ কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য/ কুলুঙ্গিতে তোলা।'
গ্রামের পূর্বদিকে তিন মাইল দূরে আরেকটি স্কুল ছিল- আশেকী হাই স্কুল। সেখানে আমার বাবাও পড়তেন। দোকানদারি করেটরে তখন সেই স্কুলে পড়া শুরু করলাম। সেই স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক জয় চন্দ্র রায় আমাকে বলতেন নাতিছাত্র। সেই স্কুলে সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। সেখানে সংস্কৃতসহ পড়লাম। তবে বিনাবেতনে পড়তে না দিলে সেখানে পড়াও আমার জন্য সম্ভব হতো না তখন। ১৯৫৪ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করি।
তখন ১৯৫২ সাল। আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। খবর এলো যে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। এ খবরের পর আমরা ছাত্ররাও ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে এলাম। স্কুলের খানিক দূরের ছিল বসুর বাজার। সেই বাজারে গেলাম। ওই বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে লাগলাম। মাইক ছিল না, টিনের চুঙ মুখে দিয়ে আমরা বক্তৃতা দিয়েছি। জানতাম তো কম কথা। এর সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে কথা বললাম। সবাইকে বললাম, আমাদের ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করার জন্য। এর বিরুদ্ধে আমাদের আজ হরতাল করতে হবে। আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার বক্তৃতা শুনে অনেকে কেঁদে ফেলল। তাঁরাও ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানায়- আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার জন্য শহরে পাঠাই। আর সেখানে তাঁদের গুলি কর মারে। এসব কাজ যাঁরা করে, তাঁরা নাকি আবার ভোট চাইতে আসবে। এঁদের ভোট না দিয়ে ঝাঁটা মারতে হবে। এরপর সেদিন হাটে হরতাল হয়ে গেল।
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়ার মধ্য দিয়েই কিন্তু আমার চিন্তা-চেতনা গড়ে উঠেছে। এগুলো না পড়লে কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি যা পেয়েছি, না পেতাম না। এই শৈশবই আমার পরবর্তী জীবনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। তখনকার দিনেই শুধু নয়, এখনকার দিনেই অভিভাবকদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, অপাঠ্য বই যাঁরা পড়ে, তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো করে না, তারা বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আমার অভিভাবক ছিলেন ভিন্নরকম। আমার বাবা, ঠাকুর দা আমাকে কথিত অপাঠ্য পুস্তক পাঠ করতে অনুপ্রাণিত করতেন। বাবা বলতেন, সকালে আর সন্ধ্যায় স্কুলের পাঠ্যবই পড়বে। আর সারাদিন আমি অন্য বই পড়তাম। সেই সঙ্গে যেসব বই ছিল নিষিদ্ধ সাধারণের কাছে, সেগুলোও আমি ছোটবেলায় পড়ে ফেলেছি। আর এমন বই পড়ার মধ্য দিয়েই আমি বড় হয়ে উঠেছি।

বিষয় : প্রচ্ছদ যতীন সরকার

মন্তব্য করুন