সংবিধান, সরকারি দাবি এবং প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা দেখি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রমে ইংরেজিই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইড, জাইকাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার ঋণে নানা প্রকল্প পরিচালিত হয়। এসব প্রকল্পের ব্যাপারে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর যেমন আগ্রহ থাকে, তেমনি গ্রহীতা হিসেবে সরকারি আমলা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদেরও আগ্রহ থাকে। কারণ এগুলোর সঙ্গে মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশ সফর, প্রজেক্ট কর্তা হিসেবে আমলাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসায়ীদের ক্রয়-আমদানির মুনাফা, কনসালট্যান্টদের বাড়তি আয় সম্পর্কিত। সুতরাং প্রয়োজন থাকুক না-থাকুক, ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক যাই হোক, এসব প্রকল্পে ভরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়, থিংকট্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব গবেষণা প্রকাশনা হয়, তার ভাষাও প্রায় সবই ইংরেজি। এত সব প্রতিষ্ঠানের এত সব গবেষণা, এত সব প্রকল্প- সবই বাংলাদেশের উন্নয়নসংক্রান্ত; যেমন নারী-গরিব-প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিরাষ্ট্রীয়করণ, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ ভবিষ্যৎ নানা কর্মসূচি। অথচ এসব গবেষণা-প্রকল্পের রিপোর্ট সবই ইংরেজি। যাদের নিয়ে ব্যয়বহুল এসব রিপোর্ট, তার কোনোটাই সেই মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না; তাঁদের সম্মতি তো অনেক দূরের বিষয়।

সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি মহাপরিকল্পনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। একটি হলো 'ডেল্টা প্ল্যান ২১০০'; আরেকটি হলো 'জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা'। আরও আছে। বাংলাদেশে বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সরকারিভাবে নিজেদের সব উন্নয়নকাজের চালিকাশক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এসব পরিকল্পনা দলিল, তার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৈরি বিভিন্ন গবেষণাপত্র সবই ইংরেজি ভাষায় প্রণীত। জনগণ তো দূরের কথা, সেগুলো দেশের বিদ্যায়তনগুলোতেও সুলভ নয়। বাংলাদেশের মানুষের অজানাই থাকে সরকার তাদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে, তাদের অগ্রগতির কী কী রিপোর্ট আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত করছে।
তার মানে বিদেশি ভাষাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষার অবস্থানে নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সব নীতিমালা প্রণয়ন করছে। দেশ ও জনগণ সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর অংশীদার বাঙালি উচ্চ ডিগ্রিধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছে এক সংখ্যালঘু জগৎ; যার পা মাটিতে নেই। এসবের মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের জগৎ তৈরি হচ্ছে, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দুই জগতে জ্ঞানের/চিন্তার/ভাবের/কল্পনার/পরিকল্পনার এই বিভেদ দিন দিন বাড়ছে কেবল।


উচ্চশিক্ষার ভাষা ও বিপদ
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর বাজারের চাহিদার ক্রম শক্তি বৃদ্ধিতে সব পর্যায়েই ইংরেজির আধিপত্য দ্রুত বেড়েছে। সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে প্রধানত ইংরেজি বই-ই দেওয়া হয়। দিতেও হয়, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় মানসম্মত পাঠ্যবই, সম্পর্কিত গবেষণামূলক গ্রন্থ পাওয়া যায় না। অর্থনীতি বিভাগসহ সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন- সব ক্ষেত্রেই এটি সত্য। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে ১২ বছর ইংরেজি পড়ে আসার পরও সবচেয়ে কাবু থাকে এই ভাষা নিয়েই। ১২ বছর ধরে ইংরেজি পড়লেও সেই ভাষায় লিখতে-বলতে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও বিপন্ন বোধ করে। কিন্তু এ দেশেরই অনেক শিক্ষার্থী জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে গিয়ে দ্রুত সে দেশের ভাষা শিখে ফেলতে পারে। অনেকে সে ভাষায় পিএইচডি পর্যন্ত করে। ইংরেজি শেখার ব্যর্থতার কারণ প্রজাসুলভ ভীতি এবং শিক্ষার ভুল ধরন ছাড়া আর কী হতে পারে? ইংরেজি নিয়ে এত আয়োজন যে ভেতর থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এবং অসফল, তা এখান থেকে বোঝা যায়। শিক্ষার্থীদের তাই ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে হয় বিষয়বস্তু নিয়ে না যতটা, বিদেশি ভাষা ইংরেজি নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি। হাতেগোনা কয়েকজন বাদে বাকিরা তাই কার্যত অনুসন্ধান করতে থাকে বাংলা বই। তারা পেয়ে যায় কিছু বই, যেগুলোর বেশিরভাগ গাইড বই ধরনের- নিম্নমানের কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে সফল। অর্থাৎ ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, এতে না ভাষা শিক্ষা হয়; না বিষয়বন্তু যথাযথভাবে জানা হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে গভীর হীনম্মন্যতা নিয়ে। তারাই আবার পরে প্রশাসনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়। পুনরুৎপাদিত হতে থাকে হীনম্মন্যতা-অজ্ঞতার দুষ্টচক্র। এ চক্রের চাপে স্বাভাবিক জ্ঞানের নতুন নতুন জগৎ নিয়ে কৌতূহলও মরে যায়, প্রশ্ন আসে না। কৌতূহল আর প্রশ্ন না থাকলে আর কী অবশিষ্ট থাকে, যা দিয়ে জ্ঞানচর্চা অগ্রসর হতে পারে? বহু বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত, যদি শিক্ষার্থীদের ওপর 'ভয় পাওয়া' ভাষার চাপ না থাকত, যদি তারা নিজ ভাষায় ভালো মানের পাঠ্যবই পেত, তাহলে টেক্সট পড়া নিয়ে ভয় এই মাত্রায় থাকত না। রেফারেন্স দেওয়া ইংরেজি বইয়ের বদলে নিম্নমানের বাংলা বই বা নোট বই বা গাইড বই বা বড় আপা-ভাইদের করা নোটের ফটোকপি নিয়ে তাদের ছোটাছুটি এবং নিরানন্দের পড়াশোনার বোঝা বইতে হতো না। তাদের চাপিয়ে রাখা মেধা হয়তো প্রকাশের পথ করে নিতে পারত এবং আমরা আরও আত্মবিশ্বাসী, কৌতূহলী, সৃজনশীল মানুষ পেতাম।

কী করতে হবে?
বিভিন্ন সীমারেখা ধরে জ্ঞান চলে না, যদিও বিভিন্ন সীমা জ্ঞানচর্চা প্রভাবিত করে। কোনো রাষ্ট্রীয় সীমা ধরেও জ্ঞান তৈরি হয় না; সে সীমায় আটকেও থাকে না; কোনো কালেও তা সীমিত থাকে না। জ্ঞানের মালিকানা, কর্তৃত্ব তাই কোনো রাষ্ট্র, জাতি, গোষ্ঠী দাবি করতে পারে না। সে জন্য কোনো জনগোষ্ঠী যদি জ্ঞানের সঠিক সন্ধান পেতে চায়, তাহলে একদিকে তার নিজের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানচর্চা সামনে আনতে হবে; তার সঙ্গে যোগ করতে হবে বিশ্বের নানা প্রান্তের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সার। শুধু নিজেদের মধ্যে আটকে থাকলে যেমন হবে না, তেমনি নিজের শিকড় অগ্রাহ্য করে ঝুলে থেকেও নিজের শক্তি দিয়ে সমগ্রটা ধরা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
সে জন্যই জ্ঞানচর্চাকে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাজ বা তার সীমানায় আটকে রাখা বা শুধু সেটাকেই জ্ঞান হিসেবে মান্য করে কোনো জনগোষ্ঠী তার সমগ্র নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। যদি দাঁড়াতে হয় তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে সব নাগরিকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য বাংলাদেশে প্রথমত, সব পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম প্রধানত বাংলা করতে হবে। এর বাইরে অন্যান্য জাতির ভাষার স্থানও নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষা শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকাশনা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাংলা প্রকাশনাও অনুবাদ করতে হবে অন্যান্য ভাষায়। ব্যক্তি পর্যায়ে এসব কাজ কিছু কিছু হচ্ছে, কিন্তু জাতীয় প্রয়োজন মেটাতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে হবে চালিকাশক্তি। অভিন্ন মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষায় শিক্ষার মধ্য দিয়ে সর্বজনের যে দৃঢ়ভিত্তি তৈরি হবে, তার ওপর দাঁড়িয়েই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে অর্থবহ কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব।
এগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব প্রস্তাব মনে হলেও বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই এ পথের ব্যতিক্রম নেই।

সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে
উন্নয়ন বলতে শুধু ভবন আর অবকাঠামো বোঝায় না। বোঝায় না শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি। এসব ক্ষেত্রে অনেক সাফল্যও একটি দেশকে দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয়, বিপন্নতা ও ঋণগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিতে পারে- যদি তা কতিপয়ের বুদ্ধি-স্বার্থ-বিবেচনাহীনতা দ্বারা পরিচালিত হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে- বন, নদী বিনাশ করে, বায়ু বিষাক্ত করে, দেশকে বিপন্ন করে, জনগণকে শৃঙ্খলিত করেও উন্নয়নের জৌলুস দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি জনস্বার্থ, দেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ কেন্দ্রে না থাকে, তাহলে কোনো জৌলুস, উচ্চ ভবন, আর্থিক বিস্তার সমগ্র বিকাশ বা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না।

দেশের মানুষকে জানতে হবে তার নামে, তার অর্থে কী হচ্ছে; কী নীতিমালায় দেশ চলছে; দেশ নিয়ে কী পরিকল্পনা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তার মতের গুরুত্ব থাকতে হবে, তার অংশগ্রহণ থাকতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাঠামোতে। মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণে দেশে যেসব জনসম্পদ তৈরি হবে, মাতৃভাষায় নীতিনির্ধারণের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির যে ক্ষেত্র তৈরি হবে, তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত জনবান্ধব টেকসই উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণ হতে পারে। সর্বজনের সৃজনশীলতার সব বাধাও দূর হতে পারে কেবল এভাবেই। এর চেয়ে ভিন্ন যাত্রা কী বিষময় জগৎ তৈরি করে, তা তো আমরা চারদিকেই দেখতে পাচ্ছি।

লেখক
শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক