- বিশেষ আয়োজন
- মাতৃভাষা, রক্তক্ষত ও নয়া আঘাত
মাতৃভাষা, রক্তক্ষত ও নয়া আঘাত

ভাষা একপক্ষীয়, একসূত্রীয় কোনো মাধ্যম নয়। আমাদের কাছে ভাষার এক ধরনের চলতি দৃশ্যমানতা এর প্রকাশভঙ্গি, বিরাজমানতা এবং পরিসরগুলো। যতভাবে ভাষা বর্ণিত ও অবর্ণিত হয়, সবই ক্ষমতা সম্পর্কের সাংগঠনিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। বলা হয়, বহু ভাষা দিন দিন দুনিয়া থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। ভাষা কি দুনিয়া থেকে আদৌ চিরতরে হারিয়ে যায়? নাকি ভাষাকে গুম করে ফেলা হয়, হত্যা করা হয় কিংবা রক্তাক্ত করা হয়? কোনো কোনো ভাষাকে দাবিয়ে রেখে বলপ্রয়োগকারী কোনো কৌশলই কি 'ভাষা' হয়ে ওঠে?
ভাষা পরিসরের ক্ষেত্রে এই বাহাসগুলো তোলা এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রশ্নে এসবের ফয়সালা হওয়াও জরুরি। কারণ, একটি ভাষা দুনিয়া থেকে এমনি এমনি 'হারিয়ে যায়' না। ভাষা গড়ে ওঠে এবং চালু থাকে যেসব শর্ত ও নিয়ামককে ঘিরে, তা বদলে ফেলার ভেতর দিয়েই একটি ভাষাকে বদলে ফেলা হয়। এভাবেই একটি ভাষা তার আপন পালকগুলো হারিয়ে প্রতাপী কোনো কৌশলের ধারণা হয়ে ওঠে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তিত ওই ভাষা কাঠামোকেও তখন আমাদের সামনে ভাষার পালকের নয়া রূপ-ভঙ্গি হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, এটিই ভাষা পরিবর্তনশীলতার অবধারিত নিয়তি। যার টিকে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই, সে কেন টিকে থাকবে? ভাষার ক্ষেত্রে এই জনপদের নিম্নবর্গের একটা দার্শনিক বিশ্নেষণ হলো- ভাষা গড়ে ওঠে চারপাশের প্রতিবেশকে কেন্দ্র করে। সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জটিল পরস্পর নির্ভরতার ভেতর। এর পরিসর বিস্তৃত হয় স্থানিক জীবনযাপন ঘিরেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে আমরা কীভাবে পাঠ করি? গরিষ্ঠ ভাগ নথি একে বিবৃত করে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কেবল বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার চৈতন্য ধারণ করেনি। ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো যখন জবরদস্তি করে 'উর্দু ভাষাকে' রাষ্ট্রের জনগণের ওপর একতরফাভাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, তখন এই ভাষিক ঔপনিবেশিকতাকে সামগ্রিকভাবে প্রশ্ন করে জনগণ। রাষ্ট্রের বারুদের বিরুদ্ধে রোপণ করে মাতৃভাষার রক্তবীজ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হয় এবং কাঠামোগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কিন্তু বায়ান্নর সেই ভাষিক রক্তবীজ কেন আজও, এত দিনেও পত্র-বিটপ-মূলে বিকশিত হতে পারল না? আজও কেন রাষ্ট্রের সব ভাষিক ময়দানে আঘাত আর প্রতিঘাতের দাগ? আজও কেন ভাষিক ঔপনিবেশিকতা আর বাহাদুরি জিইয়ে আছে? প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে বাংলা ভাষার আপন গাঁথুনি আর রূপকল্পের সীমানা। প্রতিদিন উধাও হচ্ছে বাংলা ভিন্ন দেশের অপরাপর জাতিসত্তার মাতৃভাষা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সাল শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। ভাষিক ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যে দেশ লড়েছে, মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির অঙ্গীকার করেছে, সেই দেশে কেন ১৪টি ভাষা বিপন্ন? এমনকি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাও কেন আজ নানা নয়া উদারবাদী আঘাতে রক্তাক্ত? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। কারণ ভাষা টিকে থাকা না-থাকার সঙ্গে বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্ক এবং কাঠামোগত বৈষম্যের বিভিন্ন প্রশ্ন জড়িত; প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের নিরবচ্ছিন্ন বিকাশমানতার গণিত জড়িত।
বাঙালি বাদে বাংলাদেশের আরেক বৃহত্তম আচিক ভাষার জনগোষ্ঠী মান্দি বা গারো। মান্দি আখ্যানমতে, মান্দিদের পূর্বজনরা একসময় হা.চেকে (পর্বত) বড় বড় গাছে বসবাস করতেন। রূরূপা ককথকপা (সজারু) এসে একদিন বলল, তোমরা ঘর বানাতে পারো না? মান্দি সমাজে বালফং নকমা চিপং রাচ্চা (বনের ছড়ার কাঁকড়া) প্রথম ঘর বানিয়ে দেখিয়েছিল। তারপর মেএনপা চেকসেনপা (গলগাঠ্িঠ পোকা) বাঁশের পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর তৈরি করে দেখাল। সারাম্মা দুসিনেম নামের শালবনের এক পাখি দেখাল কীভাবে ঘরে থাকতে হয়। তারপর থেকে মান্দিরা নিজেরাই ঘর তৈরি করে এবং ঘরে থাকা শুরু করে। মান্দি কুসুকে (মান্দি ভাষায়) এই ঘরের নামই নকমান্দি। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের মান্দি সমাজের মান্দি কুসুকে (ভাষায়) আজ আর এই ধারণাগুলো নেই। মধুপুরে যেমন শালবন নেই, নকমান্দি নেই, তেমনি নেই রূরূপা ককথকপা, মেএনপা চেকসেনপা, সারাম্মা দুসিনেমেরাও। মধুপুর শালবনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, দাতা সংস্থা, করপোরেট বিষ কোম্পানির বাজার প্রসারিত হয়েছে। জাতীয় উদ্যান-ঔপনিবেশিক বন আইন-ইকোপার্কের নামে মধূপুরকে বদলে ফেলা হয়েছে। শালবনের আচিক ভাষার বিবর্তন নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি, ঘটছে না। নানা ঘাত, বাহাদুরি আর বিশৃঙ্খলতা সামলে আচিক ভাষা প্রতিদিন চেহারা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বদল সরাসরি প্রভাবিত করে আমাদের ভাষা কাঠামোর বিন্যাসকে। ভাষা ও বৈচিত্র্যবিষয়ক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন উদ্যোগে আমরা বরাবরই এমন প্রসঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো তৎপরতা ও প্রকল্প তৈরি হতে দেখি। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ আর বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ মানে নানা শর্ত ও সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা মাতৃভাষারও বিনাশ। এককালে এ অঞ্চলে কত জাতের যে ধান ছিল তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮২ সালে 'দেশী ধানের জাত' নামে যে পুস্তকটি প্রকাশ করেছিল, তাতেও বারো হাজারের বেশি দেশি ধান জাতের নাম ছিল। এসব ধানের সঙ্গেই আমাদের জনপদের প্রতিবেশগত ভাষাবৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক। নেতপাশা, সমুদ্রফেনা, কবরক, বাজাল, সাদামোটা, বীরপালা, জামাইআদুরী, বোয়ালের দাঁত, লক্ষ্মীদীঘা, গ্যাল্লং, নুনিয়া, গৌড়কাজল, পোড়াবিনি, খাসকানি, গন্ধকস্তুরী, লাখাই, ময়নাশাইল, চেংড়ী, জটাইবালাম, গচি, রাতা, মি. মিদ্দিম, গুয়ামৌরি- এ রকমের কত না বৈচিত্র্যময় ধানের সঙ্গে আমাদের ভাষার ধারণাগত ও প্রতিবেশগত সম্পর্ক। তথাকথিত সবুজ বিপ্লব আর নয়া উদারবাদী করপোরেট কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে চুরমার করেছে। সমতল, পাহাড়, চর, অববাহিকা, দ্বীপ, গড়, বরেন্দ্র, টিলা কী অরণ্য অঞ্চলে বিকশিত মাতৃভাষাও হয়েছে রক্তাক্ত। ধান নেই, পাখি নেই, মাছ নেই, গাছ নেই মানে কিন্তু মাতৃভাষার ময়দানে শত সহস্র শূন্যতা আর ক্ষত। এই শূন্যতা আর ক্ষতকে প্রশ্ন না করে কীভাবে মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি সম্ভব? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চৈতন্য বিকশিত করার তৎপরতায় শামিল হওয়া সম্ভব?
এমনকি আমরা ভাপা পিঠা, আন্ধসা, ক্ষীরপুলি, মালাইকারী, সন্দেশ, সর্ষে ইলিশ, গোদাইয়া, জাউ, খিচুড়ি, জাডহ্, খারি, শরবত সম্পর্কে আমাদের খাদ্যগত ভাষার পরিসরকে জানি। কিন্তু আমাদের চারধারে যখন জবরদস্তি করে জায়গা নেয় ম্যাকডোনাল্ডস, পিৎজা হাট, নেসলে বা কোক-পেপসির বাজার, তখন সেসব বাস্তবতা ভাষার আরও নানা মানে হাজির করে। করপোরেট বার্গার একসময় ভাপা পিঠানির্ভর ভাষার রূপ ও ভঙ্গিকে গায়েব করে ক্ষমতার ভাষার অনিবার্যতা জারি রাখে। এই অনিবার্যতা মেনে নিয়েই নিদারুণভাবে আমরা মাতৃভাষা সুরক্ষার কথা বলি। তাহলে কার মাতৃভাষা? কীভাবে মাতৃভাষা? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের ভাষিক ঔপনিবেশিকতাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল। জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভাষার আঘাত ও প্রতিঘাত প্রশ্নে আমরা এখনও তৎপর নই; সংবেদনশীল ও রাজনৈতিক নই। আমরা তাই আমাদের সবার অংশগ্রহণকে মাতৃভাষার বিকাশ ও চর্চার ময়দানে শামিল করতে পারিনি। ভাষা জান কী জবান পায় চারপাশের বিস্তার ও কারিগরি থেকেই। চারপাশই যদি বদলে যায়, জবরদস্তি করে বদলে দেওয়া হয়, তখন ভাষার আর কী থাকে, কয়েকটা খরখরে হাড্ডি ছাড়া? মেঘনা ফার্টিলাইজার অ্যান্ড এগ্রোকেম ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানির চা বাগানে ব্যবহূত উইপোকা মারার একটি রাসায়নিক বিষের নাম আস্থা। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানিদের কাছে 'আস্থা' মানে সমষ্টির বিষয়। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর শিমের এফিড পোকা মারার জন্য এস এস ভিশন লিমিটেড কোম্পানিকে 'দোয়েল' নামে একটি বালাইনাশকের অনুমোদন দেয় রাষ্ট্র (নিবন্ধন নং-এপি ১৯৮৮)। সিনজেন্টা, মনসান্টো, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, এসিআই, লালতীর, ইনতেফাসহ বহুজাতিক কৃষি বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো লাগাতার রাষ্ট্রভাষা বাংলার নানা ঐতিহাসিক প্রত্যয় ও রূপকল্প ব্যবহার করে তাদের বিষ কী বিনাশী বীজের নাম দিয়ে যাচ্ছে। দেশের পাখপাখালি, নদী, বাদ্যযন্ত্র, মাতৃভূমি, দেশজ শিকার অস্ত্র, সম্পর্ক, বিশ্বাস, ধর্ম, মূল্যবোধ, দুর্যোগ ও বিপর্যয় কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি- মোট কথা জীবনপ্রবাহের সব ভাষিক আঙ্গিক কী রূপকল্প সবই বিষ বিক্রির ধান্ধায় ব্যবহার করে চলেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। ভাষিক ঔপনিবেশিকতার এই নয়া উদারবাদী ধরন ও মাতৃভাষার ওপর করপোরেট আঘাতকে প্রশ্ন করা জরুরি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন জনবিদ্রোহের রক্তস্ম্ফুরণে আমাদের এই বার্তাই জানিয়েছিল। কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ, বিচ্ছিন্নতা, নিশ্চিহ্নকরণ কখনোই ভাষার কোনো রূপ হতে পারে না; এটি হতে পারে পণ্যকরণের কোনো যোগাযোগ কৌশল। এটি ভাষা নয়। ভাষা নিরন্তর গড়ে ওঠে, বিরাজিত থাকে, রূপান্তরিত হয় চারপাশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিবরণ ঘিরেই। মাতৃভাষার সুরক্ষা ও বিকাশ প্রশ্নে রাষ্ট্রকে এই বিবরণ ও সম্পর্ক বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। মাতৃভাষার রক্তক্ষত ও নয়া আঘাতগুলোকে প্রশ্ন করে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার করতে হবে।
লেখক
গবেষক
প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন