বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, এর গড়ন ও দাবিনামার দিক থেকেই, শ্রেণিগত মাত্রাসম্পন্ন ছিল। একে দেখার প্রশ্নে এখনও আমি শ্রেণিগত মাত্রাকে লঘু করবার এতটুকু কারণ খুঁজে পাই না। খুব সাফ করে বলবার আছে যে, ভাষা আন্দোলনকে জাতীয়তাবাদী স্মারকে পর্যবসিত করার মাধ্যমে কেবল যে এর কারিগরিকে বুঝতে চিরকালীন সমস্যা করা হয়েছে তাই-ই নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে উত্তরকালের ভাষা প্রশ্নকে অহেতুক সব বোকাবোকা গৌরব/উচ্চম্মন্যতা আর হীনম্মন্যতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। অবশ্য, উচ্চম্মন্যতা আর হীনম্মন্যতা যে একসাথেই মিলেমিশে থাকে সেটাও তার্কিকদের অনেকে জানেন ও মনে রাখেন বটে। আবার অনেকেই মনে করিয়ে দিতে ভুলবেন না যে জাতীয়তাবাদের মুখ্য বুনিয়াদই আসলে ওই উচ্চম্মন্যতা। এসব কথাবার্তার বিপদ অনেক। আধাসতর্ক লোকজন হারেরেরে করে বলতে শুরু করবেন জাতীয়তাবাদের ভাষাকেন্দ্রিকতার কথা কিংবা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা; জাতিরাষ্ট্র গঠনে এর কেন্দ্রীয় ভূমিকার কথা। এঁদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে কেবল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জজবাকেই কারণ হিসেবে মনে রেখেছেন (এবং কিছুতেই শোষণ-বঞ্চনা ও সম্পদপ্রণালির অপারপর দিকগুলোকে আর আলাপে রাখতে আগ্রহী থাকেন না) তাঁরা আরও এককাঠি এগিয়ে গিয়ে ধমকাতে পারেন : 'তো ভাষা আন্দোলন না হলে কী মনে করেন আমাদের রাষ্ট্রটা স্বাধীন হতো?' এমনিতেই কী হলে কী হতে পারত ধরনের আলাপে আমার কোনো দক্ষতা, এমনকি আগ্রহ, নাই; উপরন্তু কথা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয় নিয়ে। এখানে এমন কিছু বলতে আমি একেবারেই অনিচ্ছুক যাতে করে জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। বিশেষত, জাতীয়তাবাদীদের ক্রোধের সম্মুখে পড়তে আমি অপছন্দ করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এখনও খোয়া-না-যাওয়া দলিল দস্তাবেজ থেকেই সকলে জানতে পারবেন যে মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটা জাতীয়তাবাদী জজবাক্রান্ত ঘটনা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের বৌদ্ধিক পাটাতনের কেন্দ্রে ছিল শোষণ-বঞ্চনার বোধ এবং সামরিক বাহিনীর মোড়লিপনার বিরুদ্ধাচরণ। আচ্ছা, এই কথাতে ঝামেলা বাধতে পারে চিন্তা করে খোলাসা করেই বলি যে 'পাকিস্তানের' সামরিক বাহিনীর মোড়লিপনার বিরুদ্ধাচরণ।
তবে তার দুই দশক আগে ভাষা আন্দোলনের সময়কালেই নিজরাষ্ট্রবাসনা দানা বেঁধে উঠেছিল পূর্ব-পাকিস্তানবাসীদের হৃদয়ে, এটা যাঁরা যুক্তি হিসেবে দেন তাঁদের সেই কল্পনাতে আমি বাধা দিতে চাই না। তবে আমি ধরে নেবার পক্ষে যে, ১৯৫২ সালের নাগরিক প্রতিবাদটা ছিল নাগরিকমনস্ক, রাষ্ট্রপ্রজা-ভাবাপন্ন, যে প্রজারা 'নিজের' রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতিকে আপন মনে করতে পারেন নাই। এসব কথাকে আমার বাহুল্য ও চর্বিত মনে হওয়া সত্ত্বেও স্পষ্টতার স্বার্থে আবারও উল্লেখ করছি যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষানীতিটা কেবল পূর্ব-পাকিস্তান বা পূর্ববাংলার জন্যই অনাপন ছিল না, ছিল এমনকি পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষজনের জন্যও। বস্তুত, ভারতের রাষ্ট্রভাষার নীতিটাও নানান অঞ্চলে আপনভাবে গৃহীত হয় নাই; এখনও হয় নাই বহু অঞ্চলে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটার আকস্মিক কল্পনার কারণেই হোক, সেই কল্পনার কল্পকারগণ নিখিল ভারতের উচ্চবংশজাত হবার কারণেই হোক, আর জনমিতিক বিচারে পাকিস্তানের প্রদেশ সংখ্যাটা ভারতের মতো বেলাগাম না-হবার কারণেই হোক, পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ভারতের মতো মসৃণভাবে আগায়নি। ফলত, কেবল তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা নীতিটা মোকাবিলার মধ্যে পড়েছিল পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেও। বিশেষভাবে, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে। তুলনামূলকভাবে পাঞ্জাবে যে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণাটি কম উত্তেজনা তৈরি করেছিল, সেটার অনেক রকম ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যে ব্যাখ্যাটা বেশ সাধারণ বোধবুদ্ধির তা হচ্ছে, রাষ্ট্র হিসেবে উদিত হবার বছর তিন চারেকের মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রে পাঞ্জাবি জাতির প্রাবল্য বেশ ভালোমতোই প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। অন্তত জন-আমলাতন্ত্র আর সামরিক বাহিনীর মতো দুইটা মুখ্য কেন্দ্রে পাঞ্জাবের মানুষজনের আধিপত্য সহজে ওই জাতিকে রাষ্ট্রের প্রতি গোস্‌সা করতে দেয়নি। তারপরও উর্দু বনাম পাঞ্জাবি ভাষার সুপ্ত-গুপ্ত টানাপোড়েন কমবেশি পাকিস্তান রাষ্ট্রে মাঝেমধ্যেই অনুভূত হয়েছে।

এটা বেশ পরিতাপের যে, বড় বড় ডিগ্রিধারী লোকজনও সহজ কিস্তিতে কিছুতেই ভাষা আন্দোলনের শ্রেণিগত মাত্রাটি বুঝতে চান না। বিশেষত, আবেগপ্রবণ হৃদয় নিয়ে, আর ভারাক্রান্ত গলায় গান গেয়ে বা আবৃত্তি করে 'বাংলা ভাষার প্রতি প্রেমখানিকে' যে রকম সৌধ বানিয়ে গত পাঁচ দশকের বাংলা মুল্লুকে লালন করা হয়েছে, সেই জাদুঘরীয় বৈশিষ্ট্য বা সৌধময়তার মধ্যে ভাষার জানগণিক আটপৌরে চেহারাটা নিয়ে আর আলাপ তোলার সহজসুলভ পরিবেশ নেই। তাঁদের দরবারে বারেবারে এটা ব্যাখ্যা করা লাগে যে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণাটি পূর্ব-পাকিস্তানের একভাষিক মানুষজনের জন্য তাৎক্ষণিক ভীতি বয়ে এনেছিল। সাধারণ মানুষজন তাঁদের পেশাজীবনকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিটা শ্রমিক শ্রেণির মানুষজনের জন্য এক ধরনের এবং চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের জন্য আরেক ধরনের বাস্তবতা এনেছিল। আবার এই দুই বাস্তবতার মধ্যে যোগসূত্রও ছিল। ফলে, রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া মানুষজনের একেবারে মৌলিক অস্তিত্বের জায়গা থেকে উৎসারিত ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানের বনেদি অংশের উর্দু তালিম ছিলই। ফলত, চূড়ান্ত বিচারে প্রতিপক্ষতাটা কেবল বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে বা অন্য ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না; বরং কীভাবে একটা পলিসি পূর্ব-পাকিস্তানের বিরাট কর্মজীবী অংশকে কার্যত অযোগ্য সাব্যস্ত করে ফেলেছিল তার প্রতিবাদ। ভাষা আয়ত্ত থাকা না-থাকার জিজ্ঞাসাটি অস্তিত্বের গাঢ় সংকটের সাথে সম্পর্কিত। আরও বিশেষে, যখন তা সাধারণ চাকরি কিংবা শ্রমনিয়োগের শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, এই অঞ্চলের একভাষিকতার বিষয়টা রীতিমতো ভাবার মতো। বনেদি শ্রেণির বহুভাষিকতার বিষয় বাদ দিলে মোটের ওপর বাংলা অঞ্চলের মধ্যবিত্ত, আরও বিশেষে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশই কোনো ভাষা শিখতে বিস্ময়কর রকমের গোঁয়ার্তুমির পরিচয় দিয়েছে। দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের পর উপনিবেশকারীর ভাষা না শেখা তামাম দুনিয়াতেই খুব বিরল উদাহরণ হবে। উপরন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক বনেদিদের মধ্যে হলেও উর্দু ও ফারসি ভাষার বেশ প্রচলন যে ছিল এই অঞ্চলে তার কোনোরকম লক্ষণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অন্য ভাষা না-আয়ত্ত করার প্রশ্নে এই অঞ্চলের বাংলাভাষীদের প্রবণতার কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা।


ভাষার প্রবাহ গভীরভাবে রাজনৈতিক। ভাষা শিক্ষণের তাগিদ রাজনৈতিক ও সাধারণভাবেই মৈত্রীকামী। দাক্ষিণাত্যের চারটি রাজ্যের মধ্যকার ভাষাসংযোগ নিয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাবার আছে। একটা সরল ব্যাখ্যা হতে পারে সংস্কৃতি কারখানাকে ঘিরে: চলচ্চিত্রের স্বার্থে ও মাধ্যমে তামিল, তেলুগু, কানাড়া ও মালয়ালম ভাষার মানুষজন পরস্পরের সাথে একটা নূ্যনতম ভাষা যোগাযোগের পটভূমিতে থাকেন। কারণটা কারখানা হোক, কিংবা কারখানাটাই ওই প্রবণতার ফলাফল হোক এ রকম কোনো তুলনীয় পরিস্থিতি বাংলাভাষীরা অভিজ্ঞান করেন না। উড়িয়া বা অহমিয়া ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক আগ্রহগুলো এখানে তৈরি যে হয়নি সেটাও রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ বা সংহতিবোধের অভাবে। একটা পর্যায়ে সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পলিসিরও প্রশ্ন। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই আশাবাদ বেশ বেখাপ্পা হতে বাধ্য। কারণ, খোদ বাংলাদেশের মধ্যে অন্যান্য জাতির ভাষা বিষয়েও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পলিসি এবং প্রবল জাতির সদস্যদের মনোভাব দুই-ই মারাত্মক রকমের বৈরী। এর প্রমাণ কাগজে-কলমে দেবার জন্য কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে, কিন্তু সাধারণ বোধবুদ্ধি থেকে অনুভব করা খুবই সহজ। যে ঢাকা শহরে স্বাধীনতার আগে, সেই মোগল যুগ থেকেই, বহুজাতির ও বহুভাষার মানুষজনের অধিষ্ঠান ছিল, সেই ঢাকা শহর স্বাধীনতার পর এক দশক যেতে না যেতেই একটা জাতির ও ভাষার বিচরণস্থল হয়ে পড়ল। এ রকম জাতিগর্বী রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই ভাষা ও জাতি প্রশ্নে আমাদের মনোভাবের প্রমাণ মিলেছে। ভাষাকে রাজনৈতিক প্রপঞ্চ হিসেবে উপলব্ধির একটা বড়সড় ঘটনা অবশ্য বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করা গেছে। নির্বিশেষে না বললে, প্রবণতাটি ঢাকাকেন্দ্রিক। আরও বিশেষে বললে এটা সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রীয় একটা প্রবণতা; চলতি ভাষায় বললে আর্টকালচার করিয়েদের একাংশের চৈতন্য হিসেবে একে দেখা যেতে পারে। 'পূর্ববঙ্গের ভাষা' অভিধাতে এই চৈতন্যের একটা উল্লেখযোগ্য প্রকাশ ঘটেছে গত দেড় দুই দশকে। বেশ কয়েকজন কবি, সাহিত্যিক, চিন্তক ও চলচ্চিত্রকর্মীর একান্ত কাজকর্মের মধ্য দিয়ে এই ধরনের একটা প্রতীতি বাংলাদেশে জাগরূক হয়েছে। এই অভিব্যক্তিটার মূল দাবি হলো পশ্চিমবঙ্গের বাংলা থেকে এই অঞ্চলের বাংলার স্বতন্ত্র বিকাশ ও প্রকরণ রয়েছে। এই দাবিটি প্রায় না বললেও চলে ধরনের একটা দাবি। না-বললেও-চলে কথাটিকে আমার তরফে সুনির্দিষ্ট করার আছে। বীরভূম অঞ্চলের বাংলা যে মেদিনীপুর অঞ্চল বা বর্ধমান অঞ্চলের বাংলা নয়, সেটা ভাষাবিদ্যার অত্যন্ত সাধারণ বোধবুদ্ধির বিষয়। এই দাবিনামাটি এত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হয়ে উঠবার কারণ কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য-তৎপরতার শ্রেষ্ঠত্বকে, এবং বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠত্ববোধকে, এই ধারা চ্যালেঞ্জ করতে উদ্যত হয়েছে। অভিব্যক্তিটির মুখ্য কারিগরদের একটা তালিকা এখানে উল্লেখ করছি না; তবে অন্য কোনো স্বতন্ত্র আলাপে তার দরকার পড়তে পারে। বিস্ময়ের না যে প্রবণতাটি যথেষ্ট বিরুদ্ধতার মধ্যেও পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু চিন্তকের কাছ থেকে। কমবেশি দেড়-দুই দশকের এই নিবিড় সাহিত্যিক তৎপরতাটির সাথে আমার সম্বন্ধ খুব বিচিত্র ও গড়ে দূরত্ববাচক। বেশ কয়েক জায়গাতেই টুকরা-টুকরা সেসব বিষয়ে আলোকপাত করলেও আজকের সুযোগে আরও একবার সংগঠিতভাবে বলার উদ্যোগ নিচ্ছি। বেশ কয়েকটা কারণেই এই তৎপরতাটি আমার জন্য দূরবর্তী।

প্রথমত, এই সম্ভাব্য বিতর্ক বা আলাপমালাটি ভাষাকে মুখ্যত কথ্য একটা সমগ্র হিসেবে আন্দাজ করে নেয়। আর তারপরে মুখ্যত প্রমিত-অপ্রমিত বাংলার ভেদবিচারটা মুখ্যত উচ্চারণ বিষয়ক আলাপমালাতে পর্যবসিত হয়। দ্বিতীয়ত, ও সম্পর্কিত, লেখ্য ভাষার রূপবিন্যাস, প্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রয়োগপ্রণালি ইত্যাদি বিষয়ে এই আলাপমালাটি আধামনস্ক থাকে। আধুনিক লেখ্য ভাষা হিসেবে বাংলা সিনট্যাক্সের যে গুরুতর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে সেখানে প.ব. বনাম পূ.ব. অকেজো ভেদবিচার। তৃতীয়ত, ও সম্পর্কিত, লেখ্য বাংলাকে কথ্য বাংলার অনুরূপ করার প্রচেষ্টাতে এবং সেটাকে পশ্চিমবঙ্গীয় (এখানে প্রাতিষ্ঠানিক এবং/বা লেখ্য বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গীয় হিসেবে দেখার পদ্ধতিগত ত্রুটিটাও স্মর্তব্য) বাংলার বিরুদ্ধরূপ হিসেবে দেখতে গিয়ে কেবল ক্রিয়াপদ ও সর্বনামের কিছু কারিগরিতে অকারণ ভার দেওয়া হয়েছে। এখানে, এটা আমার তরফে বলা অতি জরুরি যে, লেখ্য ও কথ্য ভাষার রূপগুলোকে আকছার অদলবদল ঘটানোর আমি আন্তরিক গ্রাহক একজন। তবে এখানে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে যেখানে কিছু ক্রিয়াপদের স্থানীয় কথ্যরূপগুলোকে লেখ্যরূপে ব্যবহারে আমি খুবই প্রীত বোধ করি; কিন্তু সেটাকে একটা যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণাকে বালখিল্য ও ছায়াযুদ্ধ হিসেবে দেখতে পাই, কারণ (আধুনিক) ভাষার সিনট্যাক্স ও ভারীবোধসম্পন্ন যৌগিকতাকে প্রত্যাখ্যান করার কোনো নিদান বা বিধান তা নয়। চতুর্থত, খোদ কলকাতীয় আমমানুষের কথ্য-বাংলা এমন কিছু সংগঠিত-প্রমিত নয়, তাই গুরুতর প্রতিপক্ষও নয়। আরও একটু নিবিড় মনোযোগ দিলে আরও কিছু কারণ হয়তো জড়ো করা যায়। কিন্তু এখানে আমি সাংস্কৃতিক-লোকেশনগত আরেকটা বড় বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করতে চাইছি। বেহুদা মূল্যমান আরোপের সমস্যা সেটা। নিখিল ভারতের মেট্রোপলিসসমূহের অভ্যন্তরীণ-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে যে কলকাতা ক্রমাগত নিজের ক্ষুদ্রকায় হতে-থাকা নিয়ে আর্তনাদ করে চলেছে, আসে যায় না আর্তনাদটার যথার্থতা আছে কিনা, সেই কলকাতাকে অতিকায় কেন্দ্র সাব্যস্ত করে অকলকাতীয় বাংলাচর্চা আরেকটা ছায়াযুদ্ধ আমার জন্য। ভাষা প্রশ্নে নিছক কথ্যোচ্চারণের প্রমিতগিরিতে আমার যেমন আগ্রহ নাই, তেমনি সেই প্রমিতগিরিটাকেই ভাষার আত্মা ভেবে লড়াই চালিয়ে যাওয়াতেও শক্তিক্ষয়ের আশঙ্কা পাই। আয়রনি হলো, এই দ্বিমুখী দলে আমার সামাজিক ইমেজটা বেশ চাপের। আমি যেভাবে বাংলা কথন চালাই তাতে কলকাতীয় বনাম ঢাকাই বাংলার বাইনারিতে আমাকে শ্রোতাকুলের একটা অংশ নির্দি্বধায় কলকাতাপন্থি তথা প্রমিতপন্থিতে ঠেলে দিয়ে রাখেন। আমি তা নই, সে রকম সাব্যস্ত হয়ে থাকতে চাই না। বড়জোর ভাষা প্রসঙ্গে এই সারফেসের লড়াইয়ে আমি আগ্রহ বোধ করি না মাত্র; আর নিছকই দৈবাৎ আমি বিবিসির বাংলাকে শৈশবে আচমকা গলায় তুলে বলতে শুরু করেছিলাম মাত্র।

বলছিলাম, বাংলাদেশের মধ্যকার ভাষাগুলির অস্তিত্ব বিষয়েও নির্লিপ্ত জাতিগর্বী অবস্থান বাংলাদেশের প্রবল জাতির। কিন্তু আরও নিবিড়ভাবে ভেবে দেখলে, এমনকি বাংলাভাষী মানুষদের ভাষার জিজ্ঞাসাটিও আন্তরিকভাবে এখানে বিবেচিত নয়। একদম প্রাথমিক বিষয়টুকু সকলেই জানি- বিস্তর মানুষ নিরক্ষর এখানে। কিন্তু যদি আপাতত সেই রাজনৈতিক বেদনা দূরেও রাখি, যাঁরা বিদ্যালয়ে যেতে পারছেন, তাঁদেরও ভাষার তালিম অত্যন্ত মন্দ। বাংলাদেশে প্রত্যন্তের অধিকাংশ স্কুল-কলেজেই বাংলা শিক্ষাদানের যে হাল, তাতে দু'চারজন যে বাংলা পারেন সেটাই বিস্ময়কর। কিন্তু এই মুহূর্তে বসে ভাষার রাজনীতি প্রসঙ্গে ভাবতে গেলে কেবল বাংলা শিক্ষার হাল দিয়ে বুঝলে হবে না। স্কুলগামী প্রায় ১০০ ভাগ বাচ্চাই যে ইংরেজির তালিম পায় না, সেটাও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। ইংরেজিতে তালিম থাকা না-থাকা এখন শিক্ষাব্যবস্থার ঐচ্ছিকতার প্রসঙ্গ নয়; যত দুঃখজনকই হোক, এটা এখন হকিকত। সেই ভাষাটার তালিম বাংলাদেশে কেবল অল্প কিছু উচ্চবিত্তীয় মানুষজনেরই থাকা সম্ভব। কোটি কোটি দরিদ্রের ভাষা প্রসঙ্গকে রাষ্ট্রের পলিসি কীভাবে দেখে- সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন ভাবতে বসলেন! যাঁদের শিক্ষাব্যবস্থার সনদ দেওয়া হচ্ছে তাঁরা নিজ-ভাষাতে অদক্ষ, আর 'আন্তর্জাতিক' ভাষাতে অযোগ্য হয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করছেন। এটা যদি ভাষানীতি হয় কিংবা শিক্ষানীতি, তাহলে বলতে হবে নির্বাক পয়দা করার নীতি এটা। ভাষার দর্শন টেলিভিশনে গলা মোটা করে সংবাদ পাঠের প্রশিক্ষণ নয়। কিংবা ১৯৮০-এর দশকের বাংলাদেশের মতো হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে সাইনবোর্ড বাংলাকরণের কর্মকাণ্ড নয়। ভাষার দর্শন আসলে চিন্তা করার সামর্থ্যের তালিমের সাথে আর চিন্তাভাবনা অভিব্যক্তির প্রবহমানতার সাথে সম্পর্কিত।

লেখক
কথাশিল্পী
প্রাবন্ধিক